দেশের জাতীয় পতাকা প্রতিটি মানুষের গর্ব ও অহংকার। এই পতাকা আমরা পেয়েছি দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার মাধ্যমে। তাই আমাদের জাতীয় পতাকা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ পতাকা বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনসাধারণকে একত্রিত করেছিলো। এ পতাকাতলে দাঁড়িয়ে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা শপথ করেছিল দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য। বীর শহিদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। পতাকার লাল বৃত্ত তাই সকল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার পবিত্র রক্তের প্রতীক হয়ে আছে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাস আবেগের। পাকিস্তানিরা রাইফেল তাক করে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলেছে। সেই মুহূর্তে ওপাশের মানুষটি মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে বুকের ওপর রক্ত দিয়ে জাতীয় পতাকার লাল বৃত্ত অঙ্কন করে বলেছেন ‘জয় বাংলা’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এমনটা বহুবার ঘটেছে। আমাদের জাতীয় পতাকা এতটাই শক্তিশালী যে, তখন মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শেষ আশ্রয় ছিল লাল-সবুজ পতাকা! লাল-সবুজে মিশে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ পতাকা পুরো দেশকে ধারণ করেছে বুকে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জড়িয়ে রয়েছে বলেই এর প্রতি আমাদের আবেগটাও অন্যরকম।
জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব প্রতীক হিসেবে পতাকা ব্যবহৃত হয়। পতাকা একক- বস্ত্রবিশেষ, যা কোনো গোষ্ঠী, দল, জাতি, দেশ বা সংগঠনের এমনকি বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের প্রতীক তথা পরিচায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত চারকোণা একটু বড় সাদা বা রঙিন কাপড় ব্যবহৃত হয় পতাকা হিসেবে। পতাকার এক প্রান্ত একটি দণ্ডের সঙ্গে বেঁধে ওড়ানো হয়। পতাকার বন্ডে ব্যবহৃত বিশেষ কোনো রং, নকশা, প্রতিকৃতি বা চিহ্নের দ্বারা কোনো আদর্শ কিংবা বার্তা উৎকীর্ণ থাকতে পারে। আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রেরই একটি স্বতন্ত্র পতাকা আছে, যা জাতীয় পতাকা হিসেবে বিবেচিত। তেমনিভাবে বাংলাদেশেরও একটি নিজস্ব জাতীয় পতাকা আছে যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। ঘন উজ্জ্বল সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি, তারুণ্যের উদ্দীপনা ও বিস্তৃত গ্রাম বাংলার প্রতীক, বৃত্তের গাঢ় লাল রঙ উদীয়মান সূর্য ও স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের প্রতীক।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারিভাবে গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় একই রকম দেখতে একটি পতাকা ব্যবহার করা হতো, যেখানে মাঝের লাল বৃত্তে হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিলো। যে ভূখণ্ডের জন্য আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তা প্রদর্শনের জন্য পতাকায় এই মানচিত্র অঙ্কিত হয়েছিল।
জাতীয় পতাকা সাধারণত এবং আইনি বিধিমতে সুনির্দিষ্ট ও নির্ধারিত স্থানে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। জাতীয় পতাকা সর্বত্র প্রদর্শন করা যায় না। জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের একটা নিয়ম রয়েছে। ইচ্ছে করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারেন না। কেননা আইনে বলা হয়েছে, কোনো অবস্থায়ই গাড়ি কিংবা কোনো যান, রেল কিংবা নৌকার খোলে, উপরিভাগে বা পেছনে পতাকা ওড়ানো যাবে না। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন ও দফতর, যেমন- রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর ভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময় এবং কিছু নির্ধারিত ভবনসমূহে সব কর্মদিবসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এসব ক্ষেত্রে শুধু সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত পর্যন্ত পতাকা উত্তোলিত রাখতে হবে। এটাই নিয়ম। তবে বিশেষ কারণে রাতে ভবনসমূহে পতাকা উত্তোলিত রাখা যেতে পারে। যেমন- সংসদের রাতের অধিবেশন, রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান চলাকালীন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে, নৌযান ও বিমানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী সমমর্যাদার ব্যক্তি, সংসদ সদস্যের গাড়ি, বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হয়। বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের প্রধানের গাড়ি ও তাদের নৌযানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, উপমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাজধানীর বাইরে ভ্রমণকালে গাড়ি ও নৌযানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন।
জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননামূলক আচরণ হচ্ছে- পতাকা পোড়ানো, পদদলিত করা, ছিঁড়ে ফেলা, কেটে ফেলা ইত্যাদি। আর এ চিত্রটাই এখন ভাসছে জাতির সম্মুখে-জাতীয় পতাকার অর্ধেক ছেঁড়া অংশে। এর নেপথ্যে বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি কাজ করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে জনতার কানে বার বার- “জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন”।
জাতির পতাকাকে যারা হেয় করেছে প্রকাশ্য দিবালোকে, তারা একই সঙ্গে রাষ্ট্রবিরোধিতার অশনিসংকেত দিয়ে গেছে। সাধারণ জনগণ সংকেত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল, রাষ্ট্রকেও উপলব্ধি করতে হবে সাধারণ জনগণকে। জাতীয় পতাকার অবমাননাকারী এই অপরাধীদের রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করতে হবে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে, ১৯৭২ সালে পতাকা আইন করা হয়েছিল। ২০১০-এর জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়, যার পেছনে মূল পর্যবেক্ষণ ছিল বিশেষত নাগরিকদের অজ্ঞতার কারণে জাতীয় পতাকার অবমাননা। এই সংশোধনিতে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্তির বিধান যথাযথ হতে পারে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাণিজ্যিক কোন প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধিবহির্ভূতভাবে করে থাকে, এর জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ন্যায়সংগত নয়। অপরাধের মাত্রাভেদে অর্থ জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করার আইনি বিষয়টি রাষ্ট্রকে বিবেচনায় আনতে হবে।
পতাকা উত্তোলন বিষয়ে সঠিক ধারণা থাকতে হবে, বাংলাদেশের পতাকার ওপরে অন্য কোনো পতাকা বা রঙিন পতাকা ওড়ানো যাবে না। অন্য দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হলে প্রথমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হবে। নামানোর সময়ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সর্বশেষ নামাতে হবে।
মিছিলে পতাকা বহনের বিধান হচ্ছে, পতাকা মিছিলের কেন্দ্রে অথবা মিছিলের অগ্রগমন পথের ডানদিকে বহন করতে হবে। জাতীয় পতাকার ওপর কোনো কিছু লেখা বা মুদ্রিত করা যাবে না অথবা কোনো অনুষ্ঠান কিংবা উপলক্ষে কোনো চিহ্ন অঙ্কন করা যাবে না। এমনকি জাতীয় পতাকাকে পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না এবং গায়ে জড়িয়ে রাখা যাবে না। পতাকা উত্তোলন ও নামানোর সময় প্যারেড ও পরিদর্শনের সময় উপস্থিত সবাই পতাকার দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের সময় একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাইতে হবে অথবা বাজাতে হবে।
পতাকাকে যেনতেনভাবে ব্যবহার করা যাবে না। কবরস্থানে জাতীয় পতাকা নিচু করা যাবে না বা ভূমি স্পর্শ করানো যাবে না। পতাকা কোনো ব্যক্তি বা জড়বস্তুর দিকে নিম্নমুখী করা যাবে না। পতাকা কখনোই আনুভূমিকভাবে বা সমতলে বহন করা যাবে না। সব সময় ঊর্ধ্ব এবং মুক্তভাবে থাকবে। বাংলাদেশের পতাকা কোনো কিছুর আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি পূর্ণ সামরিক মর্যাদা বা আনুষ্ঠানিকতাসহ সমাধিস্থ করা হলে তার শবযানে পতাকা আচ্ছাদনের অনুমোদন করা যেতে পারে। কোনো কিছু গ্রহণ, ধারণ বহন বা বিলি করার নিমিত্তে পতাকা ব্যবহার করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে ওই ব্যক্তিকে ২০১০ সালের ২০ জুলাই প্রণীত আইন অনুযায়ী ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
জাতীয় পতাকার অবমাননা করার অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা। স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। আবেগের বসে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক কষ্টে অর্জিত এ পতাকার প্রতি যদি অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা কষ্ট পাবে। অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। তাই জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব এবং নাগরিক কর্তব্যও বটে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা রাষ্ট্র ও জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তার প্রতীক, আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রের অখণ্ডতার এক নির্ভরযোগ্য চিহ্ন। আনন্দ আর উদ্দীপনার এক শিহরণ সৃষ্টি হয় আমাদের হৃদয়ে, যখন জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। জাতীয় পতাকার প্রতি অবিচল আস্থা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা শেখানো হয় অতি শৈশবকাল থেকে- যখন একজন শিশু স্কুলে ভর্তি হয় ঠিক সে সময় থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে জাগ্রত হয় স্বাজাত্যবোধ। মা মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে যেমন মনুষ্যত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি মাতৃভূমির সঙ্গে জাতীয় পতাকাও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই লাল-সবুজের পতাকার প্রতি অবিচল আনুগত্য ও শ্রদ্ধা আমাদের চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের সার্বভৌমত্বের নিদর্শন লাল সবুজের পতাকা। এই পতাকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শহিদের বুকের তাজা রক্তে সিক্ত সবুজ জমিনের কথা। স্মরণ করিয়ে দেয় সেসব মানুষের কথা যারা নির্দ্বিধায়, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে এই ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডের মুক্তির জন্য। লাল সবুজের এই পতাকা তাই আমাদের হৃদয়ে জাগায় দেশপ্রেম, আর দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার প্রেরণা।
জাতীয় পতাকাকে অবমাননা বা অসম্মানকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। তার অপব্যবহার রোধে আমাদের সরকারি তৎপরতার পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও দায়িত্বশীল হতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক, সাবেক উপ-মহাপরিচালক বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি