বিএনপি সাতই মার্চকে অস্বীকার করে কি না— রাজনীতিতে এমন প্রশ্ন বহুদিনের। কেননা, দেশের অন্যতম প্রধান এই রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা তথা অনানুষ্ঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার এই দিনে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করত না। তবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে, এবার ৭ মার্চ তারা একটি কর্মসূচি পালন করেছে। যদিও সেখানে এই বিশেষ দিবস এবং এই দিনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে দলটির নেতারা কিছু ‘তবে’ উচ্চারণ করেছেন।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বিএনপি যে মাসব্যাপী আয়োজন ঘোষণা করে, সেখানে ৭ ও ২৫ মার্চে কর্মসূচি রাখা হয়। ঘোষণার পরে তাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যদিও তিনি পরে আবার বিএনপির এই কর্মসূচিকে ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয় বলেও মন্তব্য করেন।
এত বছর পরে বিএনপি কেন সাতই মার্চ পালনের সিদ্ধান্ত নিল? দলটির নেতারা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক গণ্ডি থেকে বের হয়ে সর্বজনীন করার জন্যই মাসব্যাপী নানা আয়োজন রাখা হয়েছে, যাতে দেশের সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমরা স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহাসিক দিনগুলো স্মরণ করব, পর্যালোচনা করব কাউকে ছোট বা বড় করার জন্য নয়। স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ইশতেহার ঘোষণা নিয়েও আলোচনা করব।’
এরপর সাতই মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করে বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটি। সেখানে বিএনপির শীর্ষ নেতারা তাদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকার করলেও এর উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ‘দরকষাকষির জন্যই’ ভাষণ দিয়েছিলেন। দলটির নেতারা আরও বলেন, ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না। তখনকার ছাত্রসমাজ ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য যে প্রত্যাশা করেছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি সে ভাষণে।
৭ মার্চের ভাষণের কারণে দেশ স্বাধীন হয়নি উল্লেখ করে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস বলেন, ‘৭ মার্চ আমরা আশা করেছিলাম, বাঁশ নিয়ে গেছি- একটা ঘোষণা তো এসেই যাবে। কিন্তু দেখলাম, স্বাধীনতার ঘোষণা আসল না। বরং ওই পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরে থেকেই মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন সে প্রচেষ্টা চলেছে।’
দলটির আরও বেশ কজন নেতা সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন এবং বলার চেষ্টা করেন যে, ১৯৭১ সালের এদিনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি এবং কোনো একজন ব্যক্তির (শেখ মুজিবুর রহমান ) কথায় যে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বরং জিয়াউর রহমানের ঘোষণার পরেই মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
প্রশ্ন হলো, সাতই মার্চ বা বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে বিএনপির এতদিনকার যে রাজনীতি, যে অবস্থান, সেটি আরও একবার স্পষ্ট করার জন্যই কি সাতই মার্চের এই কর্মসূচি? বিএনপি নামক দলটি প্রতিষ্ঠার পরে এই প্রথম সাতই মার্চের কর্মসূচি পালনের উদ্দেশ্য কি তাহলে এই বিশেষ দিনটি নিয়ে তাদের ‘তবে’প্রতিষ্ঠিত করা?
অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ জাতির পিতাকে হত্যার পরে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করা খুব সহজ ছিল না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষণ প্রচার নিষিদ্ধ না হলেও রাষ্ট্রের আনুকূল্যও ছিল না। বরং এই ভাষণ প্রচার করে আওয়ামী লীগের অনেককে রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়তে হয়েছে।
এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগ যেহেতু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত বলে অভিযোগ করে থাকে, সেই রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ৭ মার্চ পালন করাটাকে তারা হয়তো বিব্রতকর মনে করত। তাছাড়া বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ও জোটের ভোটের হিসাব- নিকাশেও বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে, সে কারণেও হয়তো সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে বিএনপি তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে বা করেনি।
সুতরাং এত বছর পরে, বিশেষ করে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বিএনপি যদি সত্যিই সাতই মার্চের মতো একটি ঐতিহাসিক দিনকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করত এবং আলোচনা সভাটিকে এই ‘তবে’র বৃত্তে বন্দি না করত, তাহলে সেটি বোধ হয় অনেক বেশি প্রশংসিত হতো। কারণ, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি বরং জিয়াউর রহমানের ঘোষণার পরেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে— এগুলো ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়। জিয়াউর রহমান একজন নিতান্তই সামরিক কর্মকর্তা। পক্ষান্তরে শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু এবং যিনি পরবর্তীকালে জাতির পিতা। এই দুজনের সঙ্গে তুলনা করাটাই অন্যায়, অযৌক্তিক।
জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ নিঃসন্দেহে তখন জনমনে আশার সঞ্চার করেছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে ‘গ্রেট লিডার’ মেনে নিয়েই জিয়াউর রহমান ঘোষণাটি পাঠ করেছেন। ঘোষণা পাঠ করা আর ঘোষণা দেয়া এক কথা নয়। জিয়াউর রহমান নিজেও কোনোদিন নিজেকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করেননি। অথচ বিএনপি জিয়াকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের সাতই মার্চের কর্মসূচিতেও এই ‘তবে’ থেকে বের হতে পারেনি। অথচ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে তাদের সুযোগ ছিল একটা নতুন ধরনের রাজনীতির শুভ সূচনা করার। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই শুভ সূচনাটি আওয়ামী লীগ করেছে কি না বা করতে পারছে কি না? একজন শুরু করেননি বলে আরেকজন করবেন না, এটি কোনো যুক্তির কথা নয়। বরং বিএনপি যদি সাতই মার্চের আলোচনা সভাকে এই ‘তবে’ মুক্ত রাখতে পারতো এবং যদি সাতই মার্চকে তারা ভোটের রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পারতো, তাতে রাজনৈতিকভাবে তাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হতো না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের রাজনীতিতে হানাহানি ও রক্তপাত যে যথেষ্ট কমেছে সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। বড় ধরনের আন্দোলনের ক্ষমতা বিএনপির নেই নাকি তারা জনবিরোধী কর্মসূচি ঘোষণা করলে তাতে জনসমর্থন পাবে না ভেবে কৌশল পরিবর্তন করছে, সেই তর্কে না গিয়ে গ্লাসের অর্ধেকটা পূর্ণ ভেবে দেশের রাজনীতিতে এই আপাত শান্তিপূর্ণ ভাব তথা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি না থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা পেয়েছে অর্থনৈতিক খাত। কেননা, টেকসই উন্নয়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপির সাতই মার্চের কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সেই স্থিতিশীলতা আরও প্রলম্বিত হবে এবং ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের যতই বিরোধ থাকুক, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা ইস্যুতে কোনো মতদ্বৈততা থাকবে না—এটি প্রমাণের সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই প্রত্যাশা বোধ হয় পূরণ হলো না।
বিএনপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যার পেছনে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা রয়েছে। যদিও বিএনপি এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এই অভিযোগ উঠতো না যদি তারা ১৫ আগস্ট জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারতো। এটা তো অতীতে করেইনি বরং ওই দিন তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রমাণহীন জন্মদিন পালন করে গর্হিত কাজ করেছে। ১৫ আগস্টে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করলে দল হিসেবে তাদের উদারতাই প্রকাশ পেত। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিএনপি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হতো।
পরিশেষে, অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে এবারের সাতই মার্চ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০২১ সাল স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। ৫০ বছর আগের এইদিনে বঙ্গবন্ধুর স্পর্ধিত আঙুলের ইশারায় সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র জাতিতে পরিণত হয় এবং যার যা কিছু্ আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেয়। ২৫ মার্চের কালরাত্রির পরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ। একটি ভাষণ কীভাবে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, কীভাবে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে নেমে পড়ার প্রেরণা জোগায়, কীভাবে একটি ভাষণ লক্ষ লক্ষ মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে, বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
সুতরাং সাতই মার্চের যে ভাষণ বাংলাদেশের মানুষের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের যাত্রায় বড় ভূমিকা রেখেছে, সেই ভাষণের স্মরণে, সেই ভাষণের স্রষ্টার স্মরণে বিএনপি যদি সত্যিই তাদের দলীয় নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারতো, সেটি আর যা-ই হোক নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের সম্পর্কে একটা শুভবার্তা দিতে পারতো।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।