‘একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নারী দিবস পালন হতো। দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি –বেসরকারি সংগঠন নানা সভা সেমিনারের আয়োজন করত। এসব সভা সেমিনারে বক্তারা নারীর মৌলিক, মানবিক ও আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোর গলায় দাবি জানাতেন। নারীর ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন অনেকেই। ভাবলে অবাক লাগে, নারীদের অবস্থা তখন কতটা শোচনীয় হলে এমন একটি দিবস পালনের প্রয়োজন হত।’...
না, এটি একটি কাল্পনিক লেখা। সত্যি সত্যি এরকম লেখা কেউ লেখেননি। তবে মনে আশা, এরকম একটি লেখা একদিন লিখবে কেউ না কেউ।
মনে মনে এমন আশাও পোষণ করি যে, পৃথিবীতে এমন একটি সময় আসবে যখন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য আর কোনো দিবসের প্রয়োজন পড়বে না। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে,নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আর কাউকে সোচ্চার হতে হবে না। কারণ তখন পৃথিবীর সব নারী তাদের প্রাপ্য অধিকার ভোগ করবে। কোনো নারী আর কোনো ধরনের বৈষম্য বা নির্যাতনের শিকার হবে না।
কিন্তু আদৌ কি পূরণ হবে আমাদের মনের এসব আশা?
প্রতি বছর ৮ মার্চ সারা বিশ্বে ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। প্রতি বছরই দিবসটির একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। সেই প্রতিপাদ্য দেখে সত্যিই আশান্বিত হই যে, এই বুঝি নারীদের দুর্দিনের অবসান হতে চলেছে। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। নারীর দুরবস্থার অবসান কিছুতেই হয় না। এ যেন হওয়ার নয়।
বিশ্বের নানা প্রান্তের বহু নারী আজ নানা বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার। এখনও তাদেরকে প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে যেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের নারীদের পরিস্থিতির কথা আর কী বলব। এখনও তারা ঘরে-বাইরে সর্বত্র নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
২০২১ সালের প্রথম দিনে দেশের এক জাতীয় দৈনিকে একটি খবর প্রকাশিত হয়। ওই খবরে বলা হয়, ২০২০ সালে দেশে ৩ হাজার ৪৪০ জন নারী ও কন্যাশিশু নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, ২৩৬ জন নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ও ৩৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০০ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ৪৩ জন। অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছে ২৫ জন। গায়ে আগুন দেয়া হয়েছে ২৯ জনকে, এর মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৫৯ জন। অপহরণ করা হয়েছে ১২৫ জনকে। পাচারের শিকার হয়েছে ১০১ জন। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছে ১১৭ জন। সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে ৪৩ জন।
১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে নারী নির্যাতনের এই চিত্র তুলে ধরে।
এটা তো শুধু ১৩টি দৈনিক পত্রিকার হিসাব। এর বাইরে যে কত নারী কতভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তার হিসাব কে রাখছেন? মানসিক নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনার তথ্য ঘরের বাইরেই আসে না।
অথচ নারীরা যে পুরুষদের তুলনায় যে কোনো অংশে কম কিছু নয়, এর প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে। তারা কী না করছে। চিকিৎসা পেশায় তাদের পদচারণ অনেক দিনের। শিক্ষক ও ব্যাংকার হিসেবে কর্মরত নারীর সংখ্যা অগণিত। গতানুগিতক পেশার বাইরেও সাহসী দায়িত্ব পালনে তারা যে পারদর্শী, তার প্রমাণ দিয়েছেন নারী নাবিক, সৈনিক, খেলোয়াড়, সাংবাদিক ও নিরাপত্তাকর্মীরা। তারা প্রকৌশলী হচ্ছে, চালাচ্ছে বিমান ।
নারী একদিকে ঘরসংসার সামলাচ্ছে, অন্যদিকে বাইরে গিয়ে উপার্জন করে। সমাজ ও সংসারে তাদের ভূমিকা অনেক। নারীর কমতি কোথায় তা বুঝতে পারি না। তারপরও তাদের পুরুষদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নেমে আসে আরও নির্যাতন। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে?
নারীর সুরক্ষায় দেশে অনেক আইন হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন করেছে। কিন্তু এসব আইন যে খুব একটা কাজে আসছে না তা বলাই বাহুল্য।
একুশ শতকের বিশ্বে নারীর এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতেই হবে। এ জন্য রাষ্ট্রসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। গুটিকয়েক আইন প্রণয়ন করেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আইনের প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্বও রাষ্ট্রের।
এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য “করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব”। সত্যিকার অর্থে একটি নতুন সমতার বিশ্ব দেখার অপেক্ষা করছি আমরা; যে বিশ্বে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে। যে বিশ্বে মাথা উঁচু করে বাঁচবে নারী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।