বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাঙালির মুক্তির দিশা যে ভাষণে

  • মোহাম্মদ শাহজাহান   
  • ৮ মার্চ, ২০২১ ১১:২৫

প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর ১ মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের শাসন কায়েম হয়। যে জন্য তিনি বলতে পেরেছেন, ২৮ তারিখ কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। তিনি পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হতে পারে।

বিশ্ব ইতিহাসে এ পর্যন্ত যে কটি স্মরণীয় বরণীয় অসাধারণ ভাষণ রয়েছে, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ১০ লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কামান, বন্দুক, মেশিনগানের সামনে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুধু অন্যতমই নয়, শ্রেষ্ঠতম বটে।

১৯৭১-এর ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার আগে শেখ মুজিবকে জানানো হয়। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস্ টু সারেন্ডার’ গ্রান্থে লিখেছেন- ১ মার্চের আগের দিন সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গবন্ধুকে গভর্নর হাউসে ডেকে নিয়ে স্থগিত করা বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

সালিক লিখেছেন, গভর্নর আহসানের কাছে এ কথা শোনার পর মুজিব চলে গেলেন না। শেখ মুজিব জানান, ‘এটাকে আমি ইস্যু করব না, যদি মার্চের অধিবেশন বসার নতুন তারিখ দেয়া হয়। আরেকটি ঘটনা হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি জানানোর জন্য পিন্ডি থেকে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে তলব করা হয়। ৪ মার্চ (১৯৭১) রাতে যাওয়ার আগে তিনি ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফরমান আলী পরবর্তীকালে তার গ্রন্থে লিখেছেন ‘কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি শেখকে প্রশ্ন করলাম, প্লিজ বলুন, পাকিস্তানকে কি রক্ষা করা সম্ভব? আমার প্রশ্নের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা এবং পূর্ব পাকিস্তানে আমরা যে যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম, এর প্রকাশ ঘটেছিল। মুজিব বললেন, হ্যাঁ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়- যদি কেউ আমাদের কথা শোনে। আর্মি বহু মানুষকে হত্যা করেছে। তারা শোনে ভুট্টোর কথা। তারা আমার কথা শোনে না। এমনকি এখানো, এত সবের পরও আমরা আলোচনা করতে আগ্রহী আছি। জেনারেল ফরমানের এই একটিমাত্র জিজ্ঞাসা (পাকিস্তানকে কি রক্ষা করা সম্ভব?) থেকেই বোঝা যায় ওই সময় শেখ মুজিব কত বড় শক্তিমান নেতা ছিলেন।

ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান রাও ফরমান আলী তার ‘How Pakistan Got Divided’ (ইউপিএল প্রকাশিত বাংলাদেশের জন্ম) গ্রন্থে লিখেছেন-

‘১ মার্চ দুপুরে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর তখন প্রতিটি বাঙালির প্রতিক্রিয়া ছিল সহিংস এবং সকলের ভেতরেই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। সমগ্র বাঙালি জাতিই এবার যুদ্ধের পথে নেমে গিয়েছিল। আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ১ মার্চেই পাকিস্তানের ভাঙন ঘটেছিল। পরবর্তীকালের ঘটনাবলি ছিল প্রধান ঘটনার অনুসরণ মাত্র। জনতার জঙ্গি মেজাজ থেকে এ কথা তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, তারা আর শুধু ভাষণে সন্তুষ্ট নয়, তারা চায় অ্যাকশন।’

৩ মার্চের ছাত্রলীগের সভার পর ফরমান তার গ্রন্থে লিখেছেন- ‘সবকিছু অচল হয়ে যায়। ঐটা ছিল এক আইনহীনতার রাজত্ব। মানুষের মেজাজ ছিল সহিংস। বিকেল ৩টার মধ্যে জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে পল্টন ময়দান জনতার সাগরে পরিণত হয়ে যায়।’

সিদ্দিক সালিকের লেখা থেকে ১ মার্চ (’৭১) রাতের আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। সালিক লিখেছেন- ঐ সময় মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসহযোগ আন্দোলনে শামিল করেন। ২ মার্চ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে শফিউল আজম সেনাবাহিনী নিয়োগের জন্য জেনারেল ফরমান আলীকে অনুরোধ করেন। একই অনুরোধ করেন স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশের আইজি। সামরিক প্রশাসন সেনা নিয়োগে প্রথম রাজি ছিল না। জেনারেল ফরমান জিজ্ঞাসা করলেন, সেনা নিয়োগের জন্য শেখ সাহেবেরে সঙ্গে কথা বলেছেন কি না। শফিউল আজম জানান, হ্যাঁ কথা বলেছি। তার অনুমোদন নিয়েই বলছি। সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হলো। কারফিউ জারি হলো। জনতা কারফিউ ভাঙল। সেনাসদস্যের গুলিতে ৬ জন নিহত হলো। নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে প্রধান প্রধান সড়কে মিছিল হয়।

সালিক লিখেছেন, ‘মৃতদেহগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একজন বাগ্মী হিসেবে মুজিব নিজের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভার পরিচয় দিলেন। তার আগুনঝরা বক্তৃতা মিছিলে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল যে, তারা তাদের জীবনবাজি রেখে যেকোনো ধরনের ভয়াবহ কাজে তাৎক্ষণিকভাবে নেমে যেতে পারে।’

২রা মার্চ রাতে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের একমাত্র বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বেআইনি সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য সরকারি কর্মচারীসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। জেনারেল ইয়াকুব ২ মার্চ মধ্যরাতের কিছু আগে সাড়ে ১১টা থেকে ৪০ মিনিট অনুনয় বিনয় করেন বঙ্গবন্ধুকে বিবৃতি প্রত্যাহারের জন্য। বঙ্গবন্ধু পালটা যুক্তি দিয়ে বসেন, আমি খুব চাপের মধ্যে আছি। এই বিবৃতি তেমন কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি করবে না। শেষ পর্যন্ত বিবৃতি প্রত্যাহারে রাজি করাতে ব্যর্থ জেনারেল ইয়াকুব বলেন, ‘শেখ সাহেব আপ খুউব সেয়ানে হ্যায়।’ এমনিভাবে প্রতিদিন একটার পর একটা ঘটনার মাধ্যমে পরিস্থিতি চরম উত্তেজনার দিকে ধাবিত হতে থাকে। ঘনিয়ে এলো ৭ মার্চ।

’৭০-এর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ জন ভোটার শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।

৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতের পুতুলে পরিণত হলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ’৭১-এর ১ মার্চ ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)।

বেতারের ঘোষণা শুনে রাস্তায় নেমে আসেন মানুষ। সে সময় ঢাকায় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠক চলছিল। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ নেতার নির্দেশের জন্য মিছিল সহকারে হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত হন। জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন।

২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ওই সভায় প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখা যায়। লাল-সবুজের এই পতাকায় হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল। স্বাধীনতার পর জাতীয় পতাকায় দেশের মানচিত্র না রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

৩ মার্চ বুধবার পল্টনে ছাত্রলীগের সভায় অনির্ধারিতভাবে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন। ওই সভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ছিল দৃশ্যমান। বঙ্গবন্ধুকে তার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা ঘোষণা করে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন পদাধিকারবলে ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। পল্টনে ছাত্রলীগের এই সভায় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করা হয়। সভায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ও গ্রহণ করা হয়।

পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন-

‘আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে- আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬ থেকে ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চলল। সারা দেশে তখন একজন মাত্র নেতা। তিনি হচ্ছেন দেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষের ভোটে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সামরিক শাসন চালু থাকলেও সামরিক সরকারের কথা তখন কেউ শুনছে না। শেখ মুজিবের কথাই তখন আইন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সমগ্র বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে।

সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এলো ৭ মার্চ। সবার দৃষ্টি ৭ মার্চের দিকে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কী বলবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাবিয়ে তুলল পাকিস্তান সামরিক চক্রকেও। কারণ, তারা বুঝে গেছে, বাংলাদেশের মানুষের ওপর তাদের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা শেখ মুজিবের কথায়।

এই অবস্থায় ৭ মার্চ শেখ মুজিব যদি রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। চিন্তিত পাকিস্তান সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নেয়। ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া কী বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে? ৭ মার্চের আগের রাতে জেনারেল ইয়াহিয়া টেলিপ্রিন্টারে শেখ মুজিবের কাছে একটি বার্তাও প্রেরণ করেন। সালিকের গ্রন্থে রয়েছে- একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়ার সেই বার্তা ৭ মার্চের আগের রাতে শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেরিত ইয়াহিয়ার বক্তব্যটি ছিল নিম্নরূপ। মেজর সালিক ওই বার্তাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। বার্তায় জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেন, ‘অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি সহসাই ঢাকা আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি আপনার আকাঙ্ক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেবো। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে- যা আপনাকে আপনার ছয় দফা থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।’ (সূত্র : Witness to Surrender)

৬ মার্চ টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা, টেলিপ্রিন্টারে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা প্রেরণ করেও পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না জেনারেল ইয়াহিয়া। ৬ মার্চ এও ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।

৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভার বক্তব্য কী হবে- এই নিয়ে ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দীর্ঘ বৈঠক হয়। জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী বলবেন- এ নিয়ে বিভিন্নজন বক্তব্য রাখেন। একপক্ষের মত, বঙ্গবন্ধু যেন জনসভায় সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। অন্যপক্ষ স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা পরিহার করে আলোচনার পথ খোলা রাখার পক্ষে মত প্রদান করে। সভা ৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত মুলতবি রইল। ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের চরমপন্থিরা বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ৭ মার্চের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে।

পরিস্থিতির চাপে ভীত-সন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দফতর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেওয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে লক্ষ্য করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন,‘পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্যে কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।’

এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন-

“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষভাবে প্রদান করেন- আবার যুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু বলেন-

‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর ১ মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের শাসন কায়েম হয়। যেজন্য তিনি বলতে পেরেছেন, ২৮ তারিখ কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। তিনি পাকিস্তানি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলারও আহবান জানান। অনেকেরই আশঙ্কা ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হতে পারে। যে জন্য তিনি ঘোষণা করেন- আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দিও। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলেও শত্রু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকে- ৭ মার্চের ভাষণে তাই তিনি বলেছেন। তাছাড়া ভাতে মারবো, পানিতে মারবো- এই কথার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পর্যুদস্ত করার কথাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে সময় এমন ছিলো যে, কোনো কোনো বিদেশি পত্রিকাও তখন জানিয়েছিল- ৭ মার্চ শেখ মুজিব হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ’৭১-এর ৫ মার্চ লন্ডনের গার্ডিয়ান, সানডে টাইমস, দি অবজারভার এবং ৬ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ৬ মার্চ ’৭১ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়-

‘East Pakistan UDI (Unilateral Declaration of Independence) Expected. Sheikh Mujibur Rahman expected to declare independence tomorrow.’ অর্থাৎ ‘শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৭১-এর ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২-এর ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির জন্য দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ওই কাহিনি বর্ণনা করেন। ফ্রস্ট শেখ মুজিবের কাছে জানতে চান, ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিলো যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন?’

জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটতো?’ শেখ মুজিব উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা, বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’

কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, বঙ্গবন্ধু যেমন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে মানুষের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন- কালের পরিক্রমায় তার ৭ মার্চের ভাষণও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

লেখক: একাত্তরে দাউদকান্দি (কুমিল্লা) থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, সিনিয়র সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর