কত লোক এসেছিল একাত্তরের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স নামে পরিচিত সুবিশাল ময়দানে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই পড়ন্ত বিকেলে দেশের অন্য সব নেতার তুলনায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। বাঙালির পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ছিল তার প্রতি। তিলে তিলে তা অর্জিত হয়। তবে এমন মহাকাব্যিক উপস্থাপনা যে তিনি করবেন, সেটা ক’জন ভাবতে পেরেছিল?
তিনি লিখিত ভাষণ দেননি। ভাষণে যেসব শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন তার বিশ্লেষণ চলছে দশকের পর দশক; আরও বহুকাল চলতে থাকবে। তিনি “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বললেন।
কোন পথে দেশ অগ্রসর হবে, সেটাও বললেন। “আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি”, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকে- এমন পরিস্থিতিতেও জনতার কী করণীয় সেটা বলে দিলেন। কিন্তু সরাসরি বললেন না- ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’। বললেন না যে ‘আজ থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকার শাসনভার গ্রহণ করেছে।’
কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে দায়িত্ব দিলেন না প্রধান সেনাপতির। নির্দেশ দিলেন না ঢাকা এবং অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে হামলা পরিচালনা করার। এসব ঘোষণা দিলে কি হঠকারিতা হতো? এ ধরনের ঘোষণা এলে কি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাঙ্ক ও বিমান নিয়ে তাৎক্ষণিক গণহত্যা শুরু করে দিত? ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট কি তাহলে এগিয়ে আসত? তার একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণাকে কি আন্তর্জাতিক সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, বরং নিছকই বিদ্রোহ হিসেবে ধরে নিত?
সময় বহমান। যেমন বহমান নদী বা সমুদ্রের ঢেউ। একবার যা ঘটে তা বদলানো যায় না। এটা না হয়ে ওটা হলে কী হতো, এ নিয়ে কেবল মূল্যায়ন- বিশ্লেষণ করা চলে। ৭ মার্চের ক্ষেত্রেও সেটাই সত্য। কেউ কেউ মনে করেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সমবেত জনতাকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে হামলা চালালে সহজেই তা দখলে আসত।
এ সময়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গোলাগুলি চালালে হয়তো কয়েক হাজার লোকের মৃত্যু হতো, কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন পাকিস্তানি সৈন্যরা হয় মরত না হয় আত্মসমর্পণ করত। এর ফলে ৯ মাসের যুদ্ধে যে জানমালের বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে রেহাই মিলত। তবে এ ধারণা যারা পোষণ করেন তারা বাস্তবতা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তাদের মনোভাব চরম হঠকারিতাপূর্ণ।
নিরস্ত্র জনতাকে এভাবে ক্যান্টনমেন্টে হামলার জন্য নির্দেশ দেয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর মতো কোনো দায়িত্বশীল নেতা এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন না।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিল। আমিও ছিলাম তাদের দলে। বাঁশের লাঠি ছিল অনেকের হাতে। আমার একটি বিশেষ দায়িত্ব ছিল- ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিষয়বস্তু যত দ্রুত সম্ভব আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে জানানো। তিনি তখন থাকতেন গুলিস্তানের কাছে সিদ্দিক বাজারে রাজা ফজলুল হকের বাসায়। আমি ভাষণ শেষ হতেই প্রায় দৌড়ে তার বাসায় যাই। সন্ধ্যা নাগাদ তার বাসায় দ্বিতীয়বার যাওয়ার আগে ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের অভিমত জেনে যাই। তারা বলেছিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা কেন সরাসরি দেওয়া হলো না, ছাত্র ইউনিয়ন-কর্মীরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এ জন্য কেউ কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করছে।
আমি মোহাম্মদ ফরহাদের জন্য ৭ মার্চের ভাষণের প্রায় সবটাই নোট করে নিয়েছিলাম। সভামঞ্চের যতটা সম্ভব কাছে যাওয়ার চেষ্টা ছিল আমার। তবে লোকের ভিড়ের কারণে মঞ্চের অনেক দূরেই কেবল আমি বসতে পারি। তরুণ বয়স থেকেই সাংবাদিকতার প্রতি ঝোঁক থাকার কারণে নোট নেয়া সহজ হয়েছিল।
ফরহাদ ভাই আমার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিলেন। কত লোক হয়েছিল, মানুষের মনোভাব কেমন ছিল, আর কে কে বক্তৃতা দিয়েছেন- এসব প্রশ্ন করেন। তারপর হেসে বললেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে শেখ সাহেব সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিলেন।’ তিনি ভাষণের দুটি বিষয়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন : এক, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই।”
দুই, “তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।”
তার মতে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়তে বলেছেন। জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও পাকিস্তানের শাসনদণ্ড হাতে নিতে কোনো ইচ্ছা না থাকার কথাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ চাইলে বাঙালিদের ন্যায্য দাবির সঙ্গে আপস করতে হতো, যার জন্য তিনি কোনাভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না। তার মতো নেতা জাতির ক্রান্তিলগ্নে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে যা বলেছেন, পরিণতি সম্পূর্ণ জেনেই সেটা বলেছেন। তিনি যা বলেছেন সেটা কার্যত স্বাধীনতারই ঘোষণা, সেটা জনতা ঠিকই বুঝে নেয়। তিনি দুইবার উচ্চারণ করেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের এবং বাঙালিরা তাতে অভূতপূর্ব সাড়া দিল। একটি স্বাধীন দেশের যাবতীয় কর্তৃত্ব জনতা তার হাতে তুলে দিল পরম নির্ভরতায়। পরের দিনগুলো বাংলাদেশ চলল তার নির্দেশনায়। শাসকদের সঙ্গে জনগণের পূর্ণ অসহযোগের গৌরবের অধ্যায়ের সূচনা হলো, যা বিশ্বে নজিরবিহীন।
মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনে এবং বিশাল ভারতবর্ষের সব শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষকে ঐক্যবদ্ধ করেন। কিন্তু তিনি সরকার পরিচালনা করেননি কিংবা তার চেষ্টাও করেননি।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ১ মার্চের পর এবং বিশেষভাবে ৭ মার্চের রেসকোর্সের মহাসমাবেশের পর বাংলাদেশের প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও পরামর্শে। তিনি খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দিতে বলেন। জনগণ সেটাই করে। প্রতিদিন তাজউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন ও রেহমান সোবহানসহ কয়েকজনের একটি দল সংবাদপত্র ও বেতার-টিভির মাধ্যমে যে নির্দেশাবলি পাঠাতেন, সবাই সেটা মেনে চলত। সামরিক কর্তৃপক্ষও নির্দেশ পাঠাত, সেটা কেউ মানত না। এমনকি বাঙালি গোয়েন্দারাও তাদের হয়ে কাজ করত না।
সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলা হতো ‘রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সংহতির বিরুদ্ধে’ কিছু প্রকাশ বা প্রচার করা হলে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। কিন্তু কেউ সেটা মানতেন না। তারা অপেক্ষা করতেন, বঙ্গবন্ধু ‘৩২ নম্বর’ থেকে কী বলেন সেটার জন্য। ঢাকায় তখন প্রধান হোটেল ছিল ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল। বঙ্গবন্ধু খাজনা-ট্যাক্স আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলে রাজস্ব বিভাগ তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এর ফলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মতো আন্তর্জাতিক মানের হোটেলেও খাদ্যদ্রব্যের ওপর শুল্ক-কর আদায় বন্ধ হয়ে যায়। পরিণতিতে সেখানে খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক কমে আসে এবং এটা জেনে অনেক ‘সাধারণ লোক’ সেখানে খাবারের জন্য ভিড় জমায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৩২ নম্বর থেকে নতুন নির্দেশনা আসে- এ ধরনের ক্ষেত্রে শুল্ক-কর আদায় করা যাবে, তবে তা জমা রাখতে হবে বাঙালিদের মালিকানাধীন কোনো ব্যাংকে। ইন্টারকন্টিনেন্টালে খাবারের দাম আবার আগের অবস্থায় চলে যায়।
এ ধরনের আরও কিছু ছাড় মার্চ মাসে ৩২ নম্বর থেকে প্রদান করা হয়েছিল। প্রকৃত পরিস্থিতি ছিল- বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে যেটা করতে বলা হতো, সেটা করা হতো এবং যেটা করতে নিষেধ করা হতো, সেটা করা হতো না।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের পঞ্চাশ বছর পূর্তির এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। আমার প্রত্যাশা, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে একটি দিন নির্ধারিত হবে যে দিনে প্রতিটি বিদ্যালয়, প্রতিটি কারখানা এবং আরও অনেক স্থানে ওই ভাষণ ও তার তাৎপর্য আলোচনা হবে। ছাত্রছাত্রী, সংস্কৃতি কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত নারী-পুরুষ- সবার প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত হবে এক একটি দল এবং তারা উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তুলে ধরবে সেই অনন্য দিনের কথা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলাম লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।