এ কথা এখন সবাই জানেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ ৮ মার্চে প্রচারিত হয়েছিল রেডিওতে। এর অডিও ধারণ করে রেকর্ড আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল এবং ভিডিওতেও তা ধারণ করা হয়েছিল।
এই তিনটি প্রক্রিয়ারই ছিল প্রস্তুতি। প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইত্তেফাকের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আমির হোসেন, দ্বিতীয়টির সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন এমএনএ আবুল খায়ের ও ঢাকা রেকর্ডের চেয়ারম্যান এ. সালাউদ্দীন, তৃতীয়টির সঙ্গে ছিলেন এম এ মবিন।
বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, রেসকোর্স ময়দানে এসে কত মানুষ আর তা শুনতে পাবেন? এ ভাবনাকে মাথায় রেখে সিরাজুদ্দীন হোসেন ভাবলেন, যদি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভাষণটি রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারের দাবি ওঠে, তাহলেই কেবল দেশের সকল এলাকার মানুষ তা শুনতে পাবে।
তাছাড়া সে সময় দেশের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করা না হলে যে কেউ সেই ভাষণকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। একটি ভুল পদক্ষেপ পুরো আন্দোলনকে ভিন্নপথে প্রবাহিত করতে পারে। তাই সিরাজুদ্দীন হোসেন ভাবলেন, এই ভাষণটি রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করা হলে কেউ তা ভুলভাবে উপস্থাপিত করতে পারবে না।
২ মার্চ রাত। সিরাজুদ্দীন হোসেন বললেন আমির হোসেনকে, ‘চা খেয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের ধর। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা রেডিওতে প্রচারের দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি ছেপে দিই। দেখা যাক কিছু হয় কি না। বিবৃতিটা তুই-ই লিখে ফেল, শুধু কনসেন্ট নিয়ে নে।’
তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। চা খেতে খেতেই টেলিফোন করা শুরু করলেন আমির হোসেন। উত্তাল সে সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। তখন সিরাজুদ্দীন হোসেন বললেন, ‘সময় চলে যাচ্ছে। দেরি করা ঠিক হবে না। কী করা যায় বল তো!’
আমির হোসেন বললেন, ‘বিবৃতিটা তোফায়েল আহমেদের নামে হলে যদি চলে, ছেপে দিই। কাল তাকে সব খুলে বললেই হবে।’
সেভাবেই ইত্তেফাকে ছাপা হলো তোফায়েলের বিবৃতি।
পরদিন আওয়ামী লীগ অফিসে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, অন্য পত্রিকাগুলো একটু মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে, তাদের পত্রিকায় বিবৃতিটি না দেয়ায়। আসল ঘটনা তো বলা যায় না, তাই তোফায়েল জানিয়েছেন, গভীর রাতে যোগাযোগ হওয়ায় শুধু একটি পত্রিকায়ই বিবৃতিটা গেছে। বঙ্গবন্ধু অফিসেই ছিলেন। আমির হোসেনকে ডেকে তিনি বললেন, ‘আমির, তোর বিরুদ্ধে তোফায়েলের নালিশ আছে। তুই নাকি তার নাম জাল করে বিবৃতি ছেপেছিস ইত্তেফাকে?’
আমির হোসেন বললেন, ‘যা করেছি গুডফেইথেই করেছি এবং সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশেই করেছি।’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘খুব ভালো করেছিস। এটা আরো আগেই করা উচিৎ ছিল। ওরা হয়তো খেয়ালই করেনি। সিরাজ এসব ব্যাপারে খুবই সজাগ। এজন্যই তো ওর ওপর আমি এত ভরসা করি।’
রেডিও কর্তৃপক্ষ প্রথমে দাবি অগ্রাহ্য করলেও প্রবল গণদাবির মুখে রেডিওতে ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এ ভাষণে স্বাধীনতার দাবি তুলতে পারেন ভেবে সরাসরি সম্প্রচার করেনি। পরে প্রবল গণরোষে পড়ে ৮ মার্চ সকালে ভাষণটি তারা প্রচার করতে বাধ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমার নামে যে বিবৃতিটি গিয়েছিল, সেটি আসলে সিরাজ ভাইয়ের। আমি তো আসলে এ বিবৃতি দিতে পারি না। আমি তখন ছাত্রলীগেও না, ডাকসুর ভিপিও না। এমএনএ একজন। তারপরও সিরাজ ভাই মনে করেছেন আমার নামে বিবৃতি গেলে ভালো হয়।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থাকা ৪৫ আরপিএম রেকর্ডটির ইতিহাসও অনেকটা এ রকম। কাকতালীয়ভাবেই নির্মিত হয়েছিল এই রেকর্ড।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তৎকালীন ফরিদপুর-৫ আসনের জাতীয় পরিষদ সদস্য মো. আবুল খায়ের।
তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে ভাষণটি ঢাকা রেকর্ড কোম্পানি থেকে রেকর্ড করার অনুমতি চান। তিনি ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ছিলেন এ সালাউদ্দীন। কারিগরি দিকটি দেখছিলেন এন এইচ খন্দকার।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আবুল খায়েরের নির্বাচনি প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু নিজেই অংশ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার গড়ে উঠেছিল পারিবারিক সম্পর্ক।
ছোট্ট এ রেকর্ডটিতে কোম্পানির লেবেলের জায়গায় ‘জয় বাংলা’ লেখা। অল্প কয়েকটি, হতে পারে শ’ খানেক রেকর্ড তখন হয়তো তৈরি করা হয়েছিল। ঢাকা রেকর্ড থেকে তা তৈরি হয়। খুবই গোপনে করা হয় ধারণের কাজটি।
বঙ্গবন্ধুর কাছে আবুল খায়ের গেলেন ভাষণটি রেকর্ড করা যায় কিনা, সেই অনুমতি নিতে। বঙ্গবন্ধু রেকর্ড করার অনুমতি দিলেন। বললেন, খুব গোপনে করতে হবে কাজ।
নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা রেকর্ডের টেকনিশিয়ান এনএইচ খন্দকারের ঠাঁই হয়েছিল মঞ্চের নিচে। সেখানেই তিনি যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে গিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া বাকিরা টেরই পায়নি সেখানে নির্মিত হচ্ছে একটি ইতিহাস। আমরা সে কথা শুনি আবুল খায়েরের ছেলে নজরুল সংগীতশিল্পী খাইরুল আনাম শাকিলের কাছ থেকে।
রেকর্ডের কাজটি নির্বিঘ্নেই হয়। এরপর চলতে থাকে ৪৫ আরপিএম রেকর্ড তৈরির কাজ। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে রেকর্ডটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া হয়। রেকর্ডটি দেখে তোফায়েল আহমেদ ঠাট্টা করে বলেন, ‘এই রেকর্ডের আয় বাবদ রয়্যালটি তো আওয়ামী লীগের পাওনা।’
বঙ্গবন্ধু কৃত্রিম গাম্ভীর্য কণ্ঠে এনে বলেন, ‘কণ্ঠ আমার, ভাষণ আমার, রয়্যালটি তো পাব আমি!’
যতটা জানা যায়, এই রেকর্ডগুলো বাজারজাত করা হয়নি।
সালাউদ্দীন সাহেব তা বাক্সবন্দি করে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আবুল খায়ের একটি রেকর্ড নিয়ে কলকাতায় চলে যেতে সক্ষম হন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে প্রচারিত হতে থাকে, এই রেকর্ডই ছিল তার উৎস।
রেকর্ডটির কপি করার প্রয়োজন পড়ল। এইচএমভি ৩০০০ কপি করে দিল। সে রেকর্ডগুলোই পৌঁছে দেয়া হলো মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে। ‘আমার সোনার বাংলা’ আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো হতো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোয়। ভারতে বিদেশি দূতাবাসগুলোতেও পৌঁছে দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও কপি।
৭ মার্চের যে ভিডিও ভাষণটি দেখা যায়, সেটি করেছিল চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে ফিল্মস ডিভিশন ছিল, এর ছিল পিআর ডিপার্টমেন্ট। তারাই এটি করেছিল।
ভাষণটি ধারণ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন জেড এম এ মবিন (ক্যামেরাম্যান), এম এ রউফ (ক্যামেরাম্যান) আমজাদ আলী খন্দকার (ক্যামেরা সহকারী), এসএম তৌহিদ (ক্যামেরা সহকারী), সৈয়দ মইনুল আহসান (ক্যামেরা সহকারী), জোনায়েদ আলী (ক্যামেরা সহকারী) খলিলুর রহমান এমএলএসএস। মাইক সরবরাহ করেছিল কল রেডি নামের প্রতিষ্ঠান।
পাকিস্তান সরকার এই ভাষণের ফুটেজ ধ্বংস করে ফেলতে পারে, এই সংশয় মনে জাগলে চলচ্চিত্র বিভাগের তদানীন্তন পরিচালক মহিবুর রহমান খাঁ (অভিনেতা আবুল খায়ের) সে বিভাগেরই সহকারী আমজাদ আলী খন্দকারকে দায়িত্ব দেন সেটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য। সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে মুন্সিগঞ্জের জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে তা লুকিয়ে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর আবার তা ফিরিয়ে আনা হয়।
৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে এখন অনেক ধরনের বিশ্লেষণ হয়। এই ভাষণকে পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ থেকে ভাষণটির গূঢ়ার্থ বোঝার একটা সুযোগও তৈরি হয়।
সত্যিই ৭ মার্চের ভাষণকে একটি উৎকৃষ্টমানের কবিতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধুর সংযত আবেগ, মাপা বাক্য ব্যবহার, উচ্চারণের বলিষ্ঠতা, যুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদির দিকে তাকালে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে ইতিহাস রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু, তা এ জাতির উত্থানপর্বের সুমহান প্রকাশ।
সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে বিচার করতে পারত এবং সে বিচারে মৃত্যুদণ্ডই সর্বনিম্ন শাস্তি হতে পারত। কিন্তু কী কৌশলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘যদি’র ওপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে অবলীলায় স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা বলে দিলেন!
আর এই ভাষণটি রেডিওতে প্রচার, তার অডিও রেকর্ড এবং ভিডিওটি বঙ্গবন্ধুর এই মহাকাব্যটিকে যথার্থভাবে যথাসময়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং স্থায়ী তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে, এ বড় আনন্দ সংবাদ। জাতির জন্য এ এক মূল্যবান সংযোজন।
সহায়তা:
১. আমির হোসেন, সিরাজ ভাইকে যেমন দেখেছি, স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন
২. তোফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার
৩. খাইরুল আনাম শাকিলের সাক্ষাৎকার
৪. চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট
৫. সিফাত বিনতে ওয়াহিদ: ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ ধারণ করেছিলেন আবুল খায়ের, প্রিয় ডটকম, ২৩ নভেম্বর, ২০১৭
৬. দ্য স্পিচ, তথ্যচিত্র পরিচালনা: ফখরুল আরেফিন
লেখক : গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক।