সর্বকালের সেরা স্বাধীনতা ও মুক্তির ভাষণ নিয়ে লিখতে বসছি কেবল জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের গৌরবময় অর্জনের কথা মনে করে।
কয়েকজন মহাপুরুষের ভাষণ বা কথামালা আমাদের পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য এবং সুন্দর করেছে। আমাদের গ্রহের অগণিত মানুষের মধ্যে এমন ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম কদাচিৎ হয়ে থাকে। এরাই দুঃখ, কষ্ট, উৎপীড়নের মধ্যে আগামী দিনের স্বপ্ন দেখায় এবং দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেয় মানবসমাজকে।
খ্রিষ্টপূর্ব যুগে মানুষকে অমৃত কথা শোনাতেন দার্শনিক সক্রেটিস। সৎ ও সত্য কথা বলার জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ৩৯৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে নিজ হাতে হেমলক পান করতে বাধ্য করে তাকে তদানীন্তন গ্রিসের নিষ্ঠুর শাসকচক্র। এভাবে অনেক ক্ষণজন্মা পুরুষ, যারা যুগে যুগে মানুষকে আলোকবর্তিকা হাতে পথ দেখিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তৃতা বা ভাষণ মানবসমাজকে আন্দোলিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। সত্য কথা বলার জন্য, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্যে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের উপস্থিতিতে ইংল্যান্ডের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার জনগণের সামনে বিশ্ব মানবতার উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিরোধী বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অনেক আগে ৩৩৫ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে মেসিডোনিয়ার (প্রাচীন গ্রিস) মহাবীর রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট জনগণের উদ্দেশে এক সাহস সঞ্চারকারী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এভাবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াসিংটন এবং আইজেন হাওয়ার জনগণের উদ্দেশে মানবতা-সম্পর্কিত বক্তৃতা দিয়ে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।
মহাত্মা গান্ধীর ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বক্তৃতা আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে। আমেরিকার জনপ্রিয় ও প্রতিভাবান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ঘাতকদের হাতে অকালে মৃতুবরণ করেন। তার ২০ জানুয়ারি, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘এ স্ট্যাটেজি অব পিস’ শিরোনামে বক্তৃতা বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র জগদ্বিখ্যাত একটি ভাষণ দিয়েছিলেন আগস্ট ২৮, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এই বক্তৃতার খণ্ডাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মুখে মুখে আজও উচ্চারিত হয়।
আমেরিকার কিংবদন্তিসম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের নাম বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এবং তার জনপ্রিয় ভাষণ ‘গেটেসবার্গ অ্যাড্রেস’-এর কিছু অংশ আজও অনেক মানুষের কণ্ঠে শোনা যায়। যেমন, আমরা আজও এই বক্তৃতার শেষ অংশটি উচ্চারণ করি-‘Government of the people by the people, for the people, shall not perish from the earth.’
ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকল থেকে তখন স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্মরণীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন ভারতীয় সংসদে যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাইস্ট উইথ ডেসটিনি’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়–‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’।
যেসব বিশ্বখ্যাত বক্তৃতার কথা উল্লেখ করলাম, এগুলোর সবই ছিল প্রস্তুত বা অর্ধ প্রস্তুতকৃত বক্তৃতা। বাঙালির জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ ছিল সম্পূর্ণ তাৎক্ষণিক, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই সর্বকালের সেরা এক কাব্যকথা। সেদিনের ঢাকার রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক দৃপ্ত দেবদূত যেন বাঁধভাঙা সমুদ্রসম জনতার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং উচ্চারণ করেছিলেন যেন স্বর্গ থেকে প্রেরিত সর্বকালের সেরা শৃঙ্খল ভাঙার গান। কবিতা লেখার সময় কবি প্রবন্ধ রচনার মতো যেমন পূর্বপ্রস্তুতি নেন না, তার কলমই নিয়ে চলে তাকে সূর্যালোকিত দিগন্তের দিকে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা বাঙালিকে নিয়ে গিয়েছিল; উইলিয়াম শেকস্পিয়রের ভাষায় ‘এক সাহসী নতুন বিশ্বের ঠিকানায়’।
শেখ মুজিবুর রহমান এসে দাঁড়ালেন বাঁধভাঙা জনতার সামনে; যেন এসে দাঁড়ালেন এক মহাবীর, দীর্ঘদেহী ও সুদর্শন, যেন মহাকাব্যের কোনো নায়ক। তারপর শুরু করলেন তার বজ্রকণ্ঠের শৃঙ্খল ভাঙার অপূর্ব ও অনন্য কথকতা। বক্তৃতা মঞ্চে এসে যখন দাঁড়ালেন সর্বকালের সেরা বাঙালি, আমাদের মহানায়ক, তখন মনে হচ্ছিল, মনে মনে তিনি উচ্চারণ করছেন শেকস্পিয়রের জুলিয়াস সিজার, নাটকের সেই বিখ্যাত সংলাপ-
‘Cowards die many times before their death; The valiant never taste of death but once.’
যার বাংলা অনুবাদ করেছেন আমাদের দেশের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক- ‘কাপুরুষ মৃত্যুর আগে বারবার মরে, বীর শুধু একবার’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন হয়তো জগদ্বিখ্যাত কবি-নাট্যকার শেকসপিয়রের ভাষাতেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। শেকসপিয়রের নাট্য সংলাপের মতোই আমাদের অবিসংবাদিত নেতার কণ্ঠে জনতার উদ্দেশে জগৎ সেরা বাণী উচ্চারিত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
মহাকবি শেকস্পিয়র যেমন সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে জানতেন এবং চিনতেন, আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষদের জীবনাচরণ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। সে জন্যই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকার অর্থে গণনায়ক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা অনন্য হয়ে উদ্ভাসিত হলো কয়েকটি কারণে। তিনি প্রায় কাব্যভাষায় কথা বলে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, লক্ষ-কোটি বাংলার মানুষকে উদ্বেলিত ও অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন। একদিকে অপূর্ব মোহনীয় ও হৃদয়গ্রাহী, অন্যদিকে সূর্যরশ্মির মতো দীপ্র হওয়ার কারণে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে জীবনপণ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই ভাষণে যুগপৎ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যঝঙ্কার এবং বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহপকাট’ ভেঙে ফেলার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছিল।
ইউনেস্কোর লিখিত ‘হ্যারিটেজ’ (প্রাপ্ত সম্পদ)-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা। সেটা বড় অর্জন হলেও, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিঃসন্দেহে বিশ্বের সেরা ভাষণ, কোনো মণিহার ছাড়াই। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার না পেলেও তিনি রবীন্দ্রনাথই থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতাকে কোনো মণিহারে পুরস্কৃত করার প্রয়োজন ছিল না, কারণ এই বক্তৃতা শ্রবণ করে বাংলার ৩০ লাখ মানুষ, যারা আধুনিক যুদ্ধ ও মারণাস্ত্র সম্পর্কে কিছুই জানত না তারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে অকাতরে প্রাণ বলি দিয়েছিল। সম্ভ্রম হারিয়েছিল দুই লাখেরও বেশি মা ও বোন।
মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে সেদিন সারা পৃথিবীর মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বিশ্বে সর্বাধিক শ্রুত ভাষণ। কেবল একটি ভাষণ মানুষের রক্তস্রোতে যে এমন আগুন ধরিয়ে দিতে পারে তার নজির পৃথিবীতে আর নেই। এই ভাষণ ছিল যথার্থ এবং সময়পোযোগী, যার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এমন দৃপ্ত ও সাহসী ভাষণের তুলনা বিশ্বে আর নেই। একটি অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি উপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এমন সাহসী উচ্চারণ এই উপমহাদেশের অন্য কোনো গণনায়ক এর আগে কখনও করেননি। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন-
‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই আজ থেকে এই বাংলায় কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে ... রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জর্জ কোর্ট সেমিগভর্নমেন্ট, দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন।’...
বঙ্গবন্ধু ভাষণের উপরে উল্লেখিত অংশগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে উপলব্ধি করা যাবে যে, বঙ্গবন্ধু দেশের আপামর জনসাধারণের ভাষায় কথা বলতে জানতেন, যেভাবে শেকস্পিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের প্রধান চরিত্র মার্ক এন্টনির বিখ্যাত দীর্ঘ সংলাপে পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেছেন- ‘বলে দিবার চাই যে; এবং পরিবর্তে যদি তিনি বলতেন ‘বলে দিতে চাই যে’, তাহলে জনগণের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে যেত। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শেষদিকে বলেছেন-
...‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’... পরিবর্তে তিনি যদি অতি পরিশুদ্ধ ভাষায় বলতেন, ‘সাত কোটি মানুষকে অবদমিত করতে পারবে না’, তাহলে এই উচ্চারণটি বিদ্যুৎ-প্রবাহের মতো কাজ করত না। জাতির পিতা একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে ভাষণটি দিয়েছিলেন এবং আঞ্চলিক ভাষা তিনি ব্যবহার না করে বাংলা ভাষাতেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন কিন্তু তাতে মুখোশঢাকা অতিপোশাকি শব্দ ছিল না।
তিনি ছিলেন অগণিত মানুষের প্রাণের মানুষ, বাঙালি জাতিকে তার আগমনের জন্যে যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপর তিনি এলেন, রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নকে সার্থক করে আমাদের দেশের মাটিতে পদযুগল রাখলেন। রবীন্দ্রনাথের গান বেজে উঠল দিগবিদিকে- ‘ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।’...
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে তার প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রবলভাবে প্রতিভাত হয় যে; তিনি সকল অর্থে ছিলেন দেশের মাটি থেকে উৎসারিত একজন ঋত্বিক পুরুষ এবং মহান নেতা যার হৃদয় বাংলার মাটিতে প্রোথিত ছিল। এই বরাভয় মানুষটির অন্তর ও মস্তিস্ক সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত ছিল। এই মহামানব অন্তরে-বাইরে ছিলেন অবিকৃত ও খোলসমুক্ত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অমিত সাহস হয়তোবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ নাটকের রাজপুত্রের গানের সঙ্গে কিছুটা হলেও তুলনীয়- ‘যদি কোথাও কূল নাহি পাই/ তল পাবতো তবু/ ভিটার কোণে হতাশ মনে রইব না আর কভু।’ এই অকুতোভয় গণনায়কের পরিচয় অনেকটাই পাওয়া যায় তার ৭ মার্চের বক্তৃতায়। রাজনৈতিক কপটতার খোলস থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। তার হৃদয়ের সত্য আর মুখের সত্য একই ছিল।
বাঙালি জাতির মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই শুরু করেছিলেন, সর্বকালের সেরা শেকসপীয়রের ট্র্যাজিক হিরোদের মতো, বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন-‘আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ যখন মহানায়ক দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেশের মানুষের সামনে এসে দাঁড়ান, তখন প্রতিটি মানুষ আবেগে আপ্লুত না হয়ে পারে না। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ ও বাক্যে উপস্থিত জনতা উদ্বেলিত এবং অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। এমন যথার্থ শব্দের ব্যবহার ও বাক্যবিন্যাস বিশ্বের অন্য কোনো বিখ্যাত ভাষণে পাওয়া যায় না। অথচ, এই ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক, যেন স্বর্গ থেকে প্রেরিত ছিল বিষয়বস্তু ও শব্দমালা। ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন-
‘তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি রক্ত বিসর্জন দেয়ার কথা বলেছিলেন এবং ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতা না পাওয়ার দুঃখ ব্যক্ত করেছিলেন তার এই যুগান্তকারী বক্তৃতায়। এই ভাষণে যারা বাংলার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন-
‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ এই জগদ্বিখ্যাত ভাষণে হরতাল ডেকে বঙ্গবন্ধু সমগ্র দেশকে অচল করে দিয়েছিলেন। ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্বয়ং বিশ্বনিয়ন্তা তাকে শক্তি জুগিয়েছিলনে এবং তার কণ্ঠে সময়োপযোগী কথামালার জোগান দিয়েছিলেন।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ও যোদ্ধা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন-
‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদেরকে স্বাধীনতা দেব।’
ভারত স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে। দুৰ্ভাগ্যবশত, কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকচক্র আমাদের যুক্ত করে দিল হাজার মাইল দূরের একটি জনগোষ্ঠীর যাদের সঙ্গে আমাদের খাদ্যভ্যাস, ভাষা, জীবনাচরণসহ স্বপ্ন দেখার কোনো মিল ছিল না। আমরা, পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ফুটন্ত পাত্র থেকে অগ্নিময় চুল্লিতে পড়ে গিয়েছিলাম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের হাতে নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম। আমাদের বঞ্চিত জীবনের প্রান্তে আমাদের মাঝেই এক মহামানবের আবির্ভাব হলো। হিমালয়সম এই মানুষটি বললেন,
‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব’, তিনি নেতাজির মতো রক্ত চাননি; রক্ত দিতে বলেছেন। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি তার ৭ মার্চের বক্তৃতায় মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের বিভাজন করেননি। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’; তিনি বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের এই উচ্চারণকে সর্বাংশে জীবনের ধ্রুব সত্যরূপে প্রকাশ করেছিলেন এবং বাস্তবায়িতও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের বক্তৃতার সমাপ্তি টেনেছেন এই উচ্চারণে-
‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা!’ তার ৭ মার্চের বিশ্ববিখ্যাত বক্তৃতা, তথা বিশ্বের সর্বকালের সেরা ভাষণকে বিশ্বের সকল নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছিলেন। তার এই তাৎক্ষণিক বক্তৃতা ছিল হৃদয়াবেগের সঙ্গে মানবমুক্তির সর্বকালের সেরা উচ্চারণ। তার এই বক্তৃতাই বুকের রক্ত ঢেলে ও সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে বাঙালিকে একটি জাতি ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি হিসেবে তড়িৎ-প্রবাহের মতো কাজ করেছিল। শুধু তাই নয়, এই অদম্যসাহসী ভাষণ বিশ্বের সমগ্র নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের হৃদয়ের কথা হিসেবে অনাগতকাল ধরে বিবেচিত হবে। সার্বিক বিবেচনায় বাঙালি জাতির পিতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের বক্তৃতা পৃথিবীর ইতিহাসে গণমানুষের বিশ্বের সেরা বক্তৃতা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই বক্তৃতা যেমন ছিল বস্তুনিষ্ঠ তেমনি ছিল হৃদয়গ্রাহী এবং এই কারণেই বিশ্বের সবচেয়ে অধিক শ্রুত এই ভাষণের তুল্য অন্য কোনো ভাষণ নেই, এই বক্তৃতার প্রতিটি শব্দচয়ন ছিল কাচ কাটা হীরের মতো ক্ষুরধার এবং সূর্যশিখার মতো দীপ্ত-অনির্বাণ।
লেখক: মঞ্চসারথি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।