বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধটি করতে হয়েছিল পাকিস্তান নামক একটি সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসক ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল পূর্ব বাংলার পাকিস্তানপন্থি জামায়াত ইসলামী, মুসলিম লীগসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ছাড়াও কিছু রাষ্ট্র।
পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে মুক্তিলাভের জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে হবে- এমনটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় কেউ ভাবতে পারেনি। তবে পাকিস্তান যে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে যাচ্ছিল সেটি দেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই রাষ্ট্রটি সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যে আন্দোলন পূর্ব বাংলায় শুরু করতে হয়েছিল তা কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তিকে একেবারেই নড়বড় করে দিতে থাকে। এরপর পূর্ব বাংলার প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ যত বৃদ্ধি পেয়েছে তত পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংকুচিত হতে থাকে। সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেকেই ছোটখাটো আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ উদীয়মান নেতা। অচিরেই তিনি হয়ে উঠলেন আপসহীন সংগ্রামী, ত্যাগী এবং পূর্ব বাংলার জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে মুক্ত করার এক বিরল প্রতিভার অধিকারী নেতা হিসেবে।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদান করে তিনি পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিলেন হয় ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পাকিস্তানকে রূপান্তরিত করো, নতুবা পূর্ব বাংলা বাংলাদেশ রাষ্ট্ররূপে স্বাধীন হওয়ার মরণযুদ্ধে আত্মনিয়োগ করবে। শেখ মুজিব স্বাধীনতার নেতা- এই স্বত্বটি পাকিস্তানের শাসকরা বুঝতে ভুল করেছিল। তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তান সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। এটি কোনোদিনই ভাঙবে না। কিন্তু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থে লড়াই সংগ্রাম করে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন পূর্ব বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতারূপে। এটি পাকিস্তানের সামরিক শাসক, ভুট্টো, জামায়াত ও মুসলিম লীগের নেতারা বুঝতে চায়নি। তাই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানকে ততদিনে তাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় রাষ্ট্র হিসেবে চিনে ফেলেছিল। একইসঙ্গে মুজিবকে স্বাধীনতার মহান নেতা হিসেবে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেছিল। সেই অবস্থায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ তারিখ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব এবং পাকিস্তানের সামরিক গোষ্ঠী এতে আপত্তি জানায়।
অবশেষে ০১ মার্চ তারিখে আকস্মিকভাবে ইয়াহিয়া খান অধিবেশন স্থগিত করলেন। এই ঘোষণা গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব বাংলা চরম বিক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে। তারা প্রিয় নেতার মুখ থেকে পরবর্তী ঘোষণা শোনার জন্য হোটেল পূর্বাণীতে ছুটে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবেই তার রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে খুব সতর্কতার সঙ্গে কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। ঢাকায় ২ মার্চ হরতাল, ৩ তারিখ দেশব্যাপী হরতাল, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দিলেন। ১ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে প্রস্তুত করার এক ধরনের সময় নিলেন। এই সময়ে স্বাধীনতার পতাকা তোলা হলো। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জনগণের মধ্য থেকে উত্থাপিত হতে থাকল- ‘পিন্ডি নয়, ঢাকা ঢাকা’- এই স্লোগানে গোটা পূর্ব বাংলা মুখরিত হতে থাকল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল জনগণ আর পাকিস্তান চায় না, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঠিকানা মনে মনে সকলেই অঙ্কন করতে থাকে।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু এই অসাধ্য সাধনের পর স্বাধীনতার লক্ষ্যেই তো অগ্রসর হবেন। কিন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র থেকে স্বাধীনতা নিয়ে বের হয়ে আসা কোনো অবস্থাতেই সহজ কাজ ছিল না। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের। কিন্তু পাকিস্তান ভোটের ফলাফলকেই যেখানে মানতে পারছিল না, সেখানে স্বাধীনতার আন্দোলন কিছুতেই মানবে না- সেটি আগেই নেতা মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাকে দমানোর শক্তি পাকিস্তানের তখন কেবলমাত্র গণহত্যার মাধ্যমেই চেষ্টা করা যেতে পারে। বাস্তবে সেটি সফল কতখানি হবে তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বুঝতে চায়নি। তারা গোপনে অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা সংগঠিত করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। তাদের ধারণা ছিল, শেখ মুজিব ৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে গণহত্যা শুরু করার সুযোগ করে দেবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে পাকিস্তান তাকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে উপস্থাপন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে ৭ তারিখ নেতা শেখ মুজিবসহ উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ও জনতাকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্পৃহাকে অঙ্কুরেই নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু শেখ মুজিব রাজনীতির পোড় খাওয়া নেতা। তিনি পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা যেমন জানতেন, একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে সেই শিক্ষাও তার যথেষ্ট ছিল।
এসব অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে রেসকোর্স ময়দানে তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ১৯ মিনিটের যে ভাষণটি রাখলেন তা শোনার জন্য শুধু উপস্থিত লাখ লাখ জনতাই নয়, গোটা দেশের কোটি কোটি মানুষ প্রতীক্ষায় ছিল। বঙ্গবন্ধু সবই ধারণ করে যে ভাষণটি শুরু করলেন তার প্রতি কখনো কখনো মুহুর্মুহু উল্লাসধ্বনিতে সমর্থন জানানো হচ্ছিল, আবার কখনওবা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই শুনে সমর্থন জানাচ্ছিল। সবাই প্রতীক্ষায় ছিলেন নেতা কখন স্বাধীনতার ডাক দিবেন, করণীয় সবকিছু বলে দিবেন। বঙ্গবন্ধু সেই মুহূর্তে যা বললেন, তাতে সম্মুখের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে দিলেন-
“আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি তবে তোমরা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবে।”
এরপরই তিনি বক্তৃতার ভাঁজে বলে দিলেন-
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের বুঝিয়ে দিলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সামরিক শাসন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া এবং নিরীহ বাঙালির ওপর গুলি চালিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের বিচার করার দাবি তিনি ছাড়লেন না। সুতরাং তাকে আর বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে কেউ আখ্যায়িত করার সুযোগ পেল না।
তিনি জনগণের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান। সুতরাং তার চার দফা দাবি ছিল যৌক্তিক। কিন্তু যৌক্তিক দাবি মানার মতো যুক্তিবাদী অবস্থানে ছিল না পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো। সুতরাং তিনি সম্মুখের দিকেই চলবেন- এটিই স্বাভাবিক।
১০ তারিখের গোলটেবিল বৈঠক বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করলেন। পাকিস্তান সরকার সংসদ অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণা করলো। কিন্তু এটি ছিল তাদের লোক দেখানো চিত্র। ভেতরে ভেতরে তারা অপারেশন সার্চলাইটের প্রস্তুতি নিয়ে ১৬ মার্চ ঢাকায় ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। এই বৈঠক ২৪ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ৭ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে যে বার্তাটি পেয়েছিল তা হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া এবং যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হওয়া। কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার মতো হঠকারিতার মাধ্যমে স্বাধীনতার অগ্রযাত্রাকে শাসকগোষ্ঠীর হাতে গুলি করে হত্যা করার জন্য তুলে দিতে তিনি সামান্যতম সুযোগ দেননি।
পাকিস্তানি নেতারা ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু তারাও ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই দ্বিধাবিভক্তির ভেতরেই দেখতে পাচ্ছিলেন পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার স্পৃহা কেবলই দৃঢ়তর হচ্ছিল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেটি দেখতে পায়নি। সে কারণে তারা পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইট নামিয়ে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা শুরু করেছিল ২৫ মার্চ দিনগত রাতে। তাদের ধারণা ছিল, তাতেই গোটা দেশ তাদের দখলে চলে আসবে। জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে।
শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নেয়ার পর গোটা জাতি হয়তো রণেভঙ্গ দিয়ে বসবে। কিন্তু ৭ মার্চ তারিখে ১৯ মিনিটের ভাষণে যে উদ্দীপনা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে তিনি স্বাধীনতাকামী মানুষকে দিয়ে গেলেন সেটি এই কদিনে এতটাই ইস্পাত কঠিন হয়ে উঠেছিল যে, অপারেশন সার্চলাইটকে প্রতিরোধ করতে ইপিআর পুলিশ, সাধারণ জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ বুক চিতিয়ে দেয় পাকিস্তানিদের কামান-বন্দুকের সম্মুখে। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক বাংলার ঘরে ঘরে দেশি-বিদেশি ইথারে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিরোধের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। যা এই জনপদের জনগণ বুকে লালন করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে যেখানে যে নির্দেশ আসছিল তাই করা হচ্ছিল। নয় মাসের এই মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উচ্চারিত “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” শুনে শুনে। সুতরাং একাত্তরের ৭ মার্চ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রবর্তী মহিমান্বিত বার্তা- যা গোটা জাতিকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রলাভে উজ্জীবিত করেছিল।
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, কলাম লেখক।