বলতে গেলে শুধু যশোরবাসীর নয়, জাতির জীবনেও একটি অন্যতম ভয়ংকর দিন ৬ মার্চ। ১৯৯৯ সালের এ দিনটিতে যশোর টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন শেষে অনুষ্ঠানপর্ব চলছিল। হাজারও দর্শক-শ্রোতা বিমোহিত হয়ে উপভোগ করছিল সেই অনুষ্ঠান। হঠাৎ রাত ১২টা ৫০ মিনিটে বিকট একশব্দে লন্ডভন্ড হয় অনুষ্ঠান। আকস্মিক এ হামলায় সবাই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এ হামলা কতখানি নৃশংস ছিল তা এখনও যশোরবাসীর হৃদয়ে গাথা আছে। যশোরসহ দেশবাসী সেদিন অনুভব ও ধারণা করতে পেরেছিল, এ কাজ স্বাধীনতা ও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদী তথা জঙ্গিদের কাজ।
পরদিন সকালে যশোরের সব ফুল বিক্রেতা বলেছিল, ‘এ শহরে ফুল বিক্রি করতে আমাদের ঘৃণা হয়।’ অথচ ৬ মার্চ মধ্যরাতে যে বর্বর হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল তার বিচারের বাণী আজও নীরবে কাঁদে। সেদিনের সে বোমা হামলায় সন্ধ্যারাণী ঘোষ, যশোর জেলা উদীচীর কর্মী শেখ নাজমুল হুদা তপন, স্বর্ণশিল্পী বাবুল সূত্রধর, উদীচী কুষ্টিয়া জেলা সংসদের কর্মী রামকৃষ্ণ রায়, পাম্প মিস্ত্রি ইলিয়াস মোল্লা, শ্রমিক নুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া লালন একাডেমির শিল্পী শাহ আলম, কুষ্টিয়া উদীচীর কর্মী রতন কুমার বিশ্বাস, শাহ আলম মিলন, সৈয়দ বুলু- এই দশ শিল্পীকর্মী ও দর্শক-শ্রোতা শহিদ হন, আহত হন আরও দুই শতাধিক। আহতদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা এখনও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন না। প্রতিদিন তারা অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে জীবনযাপন করছেন।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ঢাকায় এসেছিলেন সুকান্ত। তার কৃত্রিম পায়ের কিছু যন্ত্রাংশ মেরামতের জন্য। তখন উদীচী অফিসে কথা হয় তার সঙ্গে। যে ছেলেটি একসময় গিটারের তারে আঙুল চালিয়ে মঞ্চ সুরের মূর্ছনায় ভরে দিত, সেই সুকান্ত ৬ মার্চ রাতে পা হারানোর পাশাপাশি গিটারের তারে সুর যোজনার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে চরম হতাশা আর ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি চরম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছে-
‘দীর্ঘ ২২ বছর পার হয়ে যাবার পরও উদীচী হত্যাকাণ্ডের মতো এমন জঘন্য, বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের যখন কোনো কূলকিনারাই এদেশের প্রশাসন করতে পারেনি তখন আমি আর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে সকলের হাসির পাত্র হতে চাই না। শুধু একটা জিনিস চাই, তীব্রভাবে চাই- বর্তমানে সারা দেশে যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা ন্যায়-অন্যায় ভুলে দলীয় আনুগত্যে যেন বিলীন হয়ে না যান। নিজেদের বিবেককে শানিত করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা অবশ্যই পারবেন। কারণ আমাদের যে অনেক গৌরবের ইতিহাস রয়েছে। আর ইতিহাস কখনও পরাজিত হতে পারে না।’
গোয়েন্দা বিভাগের ধারণা মঞ্চের পেছনে স্থাপিত বোমা দুটি টাইম বোমা, রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও খুনিদের বিচারের দাবিতে যশোরের সর্বস্তরের জনগণ পরদিন বৃহস্পতিবার আধাবেলা হরতাল পালন করে।
আইনজীবী সমিতি ৭ মার্চ আদালত বর্জন করে। বর্বরোচিত এ হত্যা মামলার তদন্তভার সিআইডি গ্রহণ করে। সেনাবাহিনীরও একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং বিস্ফোরিত স্থানের নমুনা সংগ্রহ করেন। খুলনা জোনের সিআইডি’র এসপিকে এই মামলা তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। তারা সেখানে একটি বিশেষ ঘাঁটি স্থাপন করেন। দেশের প্রগতিশীল সর্বস্তরের মানুষ সেদিন এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে। সারা দেশে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
অথচ ২০০৭ সালের প্রথমদিকে আদালতের রায়ে এই মামলার সকল আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। দেশবাসী বিমূঢ় হয়ে যায়। যেন মনে হলো সে রাতে সেখানে কিছুই ঘটেনি। ২০০৮ সালে সে সময়ের ক্ষমতাসীন সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এসে আপিল করার আশ্বাস প্রদান করে। ২০১১ সালে উচ্চ আদালতে আপিলও করে সরকার। উচ্চ আদালত আপিল আবেদন গ্রহণ করে আসামিদের যশোরে নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। আশান্বিত হয় গোটা জাতি। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি। মামলার ২৩ আসামির ১৯ জনই আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। কোনো ধরনের বিচারিক কার্যক্রমের মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই ৪ জনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। থমকে গেছে বিচারিক কার্যক্রম।
প্রতিবছর উদীচী ৬ মার্চ এই হামলার শহিদদের স্মরণ এবং এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে আসছে। উদীচীর ওপর এ বোমাহামলা গোটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপরেই এক চরম আঘাত।
দীর্ঘদিন বিচার না হওয়ায় নিহতদের স্বজন ও আহতদের আক্ষেপ বাড়ছে। সেদিনের সেই নৃশংস বোমা হামলায় দুই পা হারানো নাহিদের বেদনার্ত হাহাকার-
‘দুই পায়ে আবার ঘা হয়েছে ভাই। ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। কাজকর্মও এখন তেমন কিছু করতে পারি না। বউ বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টে আছি ভাই। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, মনে হয় আত্মহত্যা করি। খুনিদের বিচার হলেও মনটা একটু শান্তি পেত। আর একটা কাজের খুব দরকার ভাই, একটু ব্যবস্থা করে দেন।’
নিহত তপনের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি শুধু একটি কথাই বললেন- ‘আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি চাই’। আহত মনু জানালেন-
এখনও পেটের মধ্যে ব্যথা করে। ঠিকমতো খেতে পারি না, কাজ করতে পারি না। সরকার যদি একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিত। আর খুনিদের ফাঁসি চাই। কারণ, এই নরপশুদের যদি বিচার না হয় তাহলে যে মরেও শান্তি পাব না।’
হরেন গোসাঁই, যিনি ’৯৯ সালের এ নৃশংস হামলায় দুটি পা হারিয়ে ফেলেন, কিন্তু একটুও ভেঙে পড়েননি, বরং এরপরে ঢাকায় উদীচীর একটি অনুষ্ঠানে এসে ওই হত্যাকারী নরপিশাচদের দিকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠেছিলেন- ‘যদি পা দু’খান ফিরে পেতাম তাইলে নাইচা দেখাইতাম।’ সেই হরেন গোসাঁইয়ের কণ্ঠেও আজ হতাশার সুর- ‘এখন বয়স হয়ে গেছে, শরীরে আর আগের মতো জোর পাইনে। আয়-রোজগারও তেমন নেই। এরই মধ্যে দুই ছেলেকেই হারিয়েছি। পুত্রবধূ, নাতি ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। সরকার যদি একটা ব্যবস্থা করত।’ এরা সবাই মনে করে, সেই সময় যারা সরকারে ছিল তারাই আবার এখন সরকারে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার- এরা হয়তোবা তাদের জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু এই মামলা নিয়ে ভাববার সময় কোথায় তাদের?
সেদিনের বোমা হামলাটি ছিল পুরো পরিকল্পিত। আমরা কখনও কখনও শত্রুদের চিনতে ভুল করলেও তারা ভুল করে না। তারা ঠিকই তাদের শত্রুদের চিনে নেয়। আর সেভাবেই তারা উদীচীর ওপর হামলা পরিচালনা করে। উদীচী তার দিক থেকে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে, এমনকি ২০১৩ সালে উদীচীকে ‘একুশে পদক’ প্রদান অনুষ্ঠানে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যশোর টাউন হল উদীচী হত্যা মামলার পুনঃ তদন্ত এবং সুষ্ঠু বিচার দাবি করলে তিনি আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। কিন্তু কাগজ এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যেন আর নড়ছে না। উদঘাটিত হয়নি ঘটনা, প্রকৃত আসামিরা পায়নি শাস্তি।
সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষকে জাগিয়ে তোলা, সচেতন করার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। মানুষ যতবেশি সচেতন হবে সে তত বেশি মানুষ হয়ে উঠবে। উদীচী সেই মানুষ গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের গান গেয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলো, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারসমূহ যশোর টাউন হল হত্যা বিচারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বার বার। সারা দেশের হাজার হাজার শিল্পীকর্মী এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। সরকার এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। একদিন না একদিন তাদেরকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
লেখক : উদীচীর কেন্দ্রীয় নেতা।