এই কোভিড অতিমারীতেও অনেক বড় আকারে দেখা গেছে পৃথিবী জুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য। যা আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে, প্রযুক্তি ও সভ্যতায় পৃথিবী এগুলেও এখনও সত্যি অর্থে লিঙ্গ বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। কারণ একটি অতিমারীর সময় সব থেকে বেশি দরকার ছিল ও মানবিক হতো যদি কোনোরূপ লিঙ্গ বৈষম্য দেখা না দিয়ে নারী ও পুরুষ একে অপরের হাত ধরে এগুতে পারত। কিন্তু তার বদলে দেখা গেল, এই বৈষম্যে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা তুলনামূলকভাবে পুরুষের থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীরা। সারা পৃথিবী জুড়ে পুরুষের তুলনায় মেয়েরাই বেশি চাকুরি হারিয়েছে। মেয়েদেরকেই বাড়িতে পুরুষের থেকে বেশি কাজ করতে হয়েছে। এমনকি, শারীরিক ও মানসিক আঘাত বেশি পেতে হয়েছে মেয়েদেরকে।
এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জাপানের একটি সেলুনের আয় কমে গেলে প্রথমেই চাকরি থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে সব থেকে কম বয়সী যে মেয়েটি, তাকে। সে কাজে খারাপ নয়। তাছাড়া ওই চাকরি ছাড়া তার অন্য কোনো উপায় নেই। তারপরও তাকে বাদ দেয়া হয়। আকিকো নামের ওই মেয়েটি বার বার অুনরোধ করেও বোঝাতে পারেনি তার বাস্তবতা।
চাকরিতে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে এই বৈষম্য সব সময়ই সব দেশে আছে। সব দেশেরই সরকারের একটি টার্গেট থাকে কীভাবে মেয়েদেরকে এই কাজের ক্ষেত্রের বৈষম্য থেকে বের করে আনা যায়। সে জন্যে জাতিসংঘের পরিকল্পনাও সকলে গ্রহণ করে। কিন্তু ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোও কেউই তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে কখনোই পৌঁছাতে পারছে না। বরং সব সময়ই পিছিয়ে থাকছে। আর এই কোভিডে আরো পিছিয়ে দিয়েছে সব দেশকে। যেমন জাপানের পরিকল্পনায় দেখা যায় তাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আবের আমলেই স্থির করা হয়েছিল মেয়েদেরকে ২০২০ সালের মধ্যে চাকরিতে ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে ৩০ শতাংশে নিয়ে আসার। কিন্তু এই কোভিডের ধাক্কায় দেখা যাচ্ছে তা মাত্র ৭ দশিক ৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
যেমন ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে, তেমনি অতি সাধারণ পর্যায়েও একই অবস্থা। এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব এশিয়াতে দক্ষিণ এশিয়ার থেকে মেয়েদের কাজের সুযোগ অনেক বেশি। এবং নারী স্বাধীনতাও অনেক বেশি। তারপরেও জাপান, চায়না, তাইওয়ান, ফিলিপাইনস কোথাও কিন্তু এই কোভিডে নারীদের অবস্থা জাপানের যে দুটি ক্ষেত্রে অর্থাৎ ম্যানেজমেন্ট লেভেল ও সাধারণ কর্মীর ক্ষেত্রের উদাহরণ দিয়েছি এর বাইরে নয়।
সকলেই জানে ফিলিপিনো মেয়েরা সারা পৃথিবীতে গৃহকর্মীর কাজ করে। তাদের নিজ দেশেও নিম্ম আয়ের ঘরের মেয়েরা গৃহকর্মী হিসেবে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে। এক সময়ে আরব বিশ্বে এরা অনেক বেশি কাজের জন্যে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাদেরকে মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক নিউজে দেখা গিয়েছিলো, এক ফিলিপিনো মেয়ে তার ইজ্জত বাঁচাতে হাই রাইজ বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মারা যায়। তারপরেও দেখা যায়, আরব আমিরাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজে অনেক বেশি ফিলিপাইনের মেয়েরা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে তারা গৃহকর্মী হিসেবে অনেক বেশি কাজ করে। এবারের এই প্যানডেমিকে বিদেশে চাকুরি হারিয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ এই ধরনের গৃহকর্মী। আর শিশু পালন ও গৃহকর্মীর কাজে দেশে ও বিদেশে মিলে যাদের ঢোকার কথা ছিল তাদের ৮০ শতাংশই এই প্যানডেমিকে কাজ পায়নি।
দক্ষিণ এশিয়ায় ওই অর্থে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো নারীরা শতভাগ কাজে বের হতে পারে না। তারপরেও ভারত, বাংলাদেশ, নেপালে ও শ্রীলংকায় দুটি বড় পরিবর্তন এসেছে নারীদের ক্ষেত্রে। এক. বেশ বড় সংখ্যক মেয়ে গার্মেন্ট সেক্টরে কাজ করছে। দুই. কৃষি শ্রমিকের একটি বড় অংশও মেয়েরা। যদিও প্যানডেমিকে কৃষি সেক্টর ওইভাবে ধাক্কা খায়নি। তারপরেও ভারতের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কাররা না যেতে পারায় অর্থাৎ লকডাউনের কারণে আটকে পড়ায় বা নিজ প্রদেশে ফিরতে বাধ্য হবার কারণে বড় একটি অংশ নারী শ্রমিক কৃষি ক্ষেত্রে কাজ হারায়। বাংলাদেশেও এবার হাওরের ধান কাটার সময় লকডাউন ছিল। সরকার লকডাউনের ভেতর উত্তরবঙ্গ থেকে ধানকাটা ও মাড়াইয়ের শ্রমিকদের হাওরে আসার জন্যে ও থাকার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেই ব্যবস্থার ভেতর নারী শ্রমিকদের জন্যে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা ছিল না। তাই এবার অন্যবারের তুলনায় নারী শ্রমিক হাওরের ধান তোলার কাজে অংশ নিতে পেরেছে কম। ঠিক তেমনি শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে গার্মেন্ট সেক্টর থেকে অনেক নারী শ্রমিককে কাজ হারাতে হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতে নারী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ গৃহকর্মী। আগে এরা খুবই কম অর্থের বিনিময়ে বা শুধু খাবারের বিনিময়ে বাসাবাড়িতে কাজ করত। এখন তার পরিবর্তন হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশে এখন ঘণ্টা বা কাজের চুক্তিতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে বিপুল সংখ্যক নারী। এমনকি প্রচুর নেপালি মেয়ে দেখা যায়, যারা গৃহকর্মীর কাজ করতে চলে যায় ভারতের রাজধানী দিল্লি ও বিভিন্ন প্রদেশের শহরে। পাকিস্তানে গৃহকর্মীর সংখ্যা কম নয়। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনায় তারা কম সুযোগ-সুবিধা পায়। এবং আরব বিশ্বের অনেক দেশের মতো পাকিস্তানের গৃহকর্মীদের শারীরিক ও শ্লীলতার ওপর খারাপ হাতের ছাপ পড়ে। তারপরেও অনেক সংখ্যক নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে সেখানে।
এবারের এই প্যানডেমিকে ভারতের রাজধানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রদেশের মেয়েরা এই গৃহকর্মীর কাজ হারিয়েছে। নেপালের মেয়েদেরকে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে। ভারতের অর্থনীতি বিষয়ক একজন সিনিয়র সাংবাদিকের মতে কমপক্ষে ৮০ ভাগ গৃহকর্মী তাদের কাজ হারিয়েছে। এবং তিনি আরো উল্লেখ করেন, রাস্তার পাশের মেকশিফট খাবারের দোকানে ও ছোট ছোট হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজ করত এমন মেয়েদেরও সিংহভাগ তাদের কাজ হারিয়েছে।
বাংলাদেশেও গার্মেন্ট সেক্টরে নারী শ্রমিকেরা যেমন কাজ হারিয়েছে, তার থেকে বেশি সংখ্যক কাজ হারিয়েছে গৃহকর্মীরা। এবং এখানেও খোঁজ নিলে দেখা যাবে, হোটেল রেস্তোরাঁয় যারা কাজ করত, তাদেরও একটি বড় অংশ কাজ হারিয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও মেয়েদের ওপর কোভিডের প্রভাব পড়েছে বেশি। তাছাড়া এই প্যানডেমিকে মেয়েদেরই বাসার কাজ যেমন বেশি করতে হয়েছে, তেমনি মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে বেশি।
মেয়েদের এই মানসিক নিপীড়নের শিকার সব দেশেই হতে হয়। যেমন তাইওয়ানের মতো একটি নারী স্বাধীনতার দেশ, যেখানকার প্রধানমন্ত্রী সব থেকে জনপ্রিয় নেত্রী, সেখানেও একটি শ্রেণি আছে, যারা সব সময়ই তাকে নারী বলে অবহেলা করেন এবং প্রকাশ্যে নারী বলে নানান অবেহলাসূচক কথা বলেন। এমনকি পৃথিবীর সব থেকে কম বয়স্ক নারী প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকেও শুনতে হয় নারী বলে অনেক কথা। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সন্তানের জম্ম দিয়েছেন এ নিয়েও অনেক বাঁকা কথা সেখানে অনেকেই বলেন। এমন বাঁকা কথা শুনতে হয়েছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে। এমনকি উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মিডিয়া তাকে ‘পি. পি.’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। অর্থাৎ ‘প্রেগন্যান্ট প্রধানমন্ত্রী’। সন্তান জম্ম দেবার মতো স্বাভাবিক ও বাস্তব বিষয় নিয়েও পশ্চিমা দায়িত্বশীল মিডিয়া ঠাট্টা করতে ছাড়েনি। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীও রাতদিন তাদের ওয়াজ নসিহতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব দেবার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা নারী নেতৃত্ব সঠিক নয়, জায়েজ নয় বলে কথা তোলে।
অথচ এবারের এই কোভিডে এশিয়ার ভেতর কোভিড ম্যানেজমেন্টে সব থেকে সফল দেশ হচ্ছে তাইওয়ান। যে চীনে কোভিডের উৎপত্তি, তাদের নাকের ডগায় বসেও তাইওয়ানের নেত্রী তার দেশকে কোভিড থেকে এক অর্থে মুক্তই রাখতে সমর্থ হন। সেখানে মাত্র ৯৫৫ জন কোভিডে আক্রান্ত হন আর মারা যান মাত্র ৯ জন। ঠিক একইভাবে ওশেনিয়ান দেশ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কঠোর লকলাউন এবং সঠিক অর্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তার দেশেও কোভিডকে ওইভাবে ছড়িয়ে পড়তে দেননি। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কোভিড ম্যানেজমেন্ট এবং টিকা প্রয়োগ কর্মসূচিতে সব থেকে সফল দেশ বাংলাদেশ। একটু চোখ খুলে দেখলেই কিন্তু দেখা যায়, এই তিন দেশের নেতৃত্ব নারীদের হাতে। কোভিডে এই নারী সরকার প্রধানরাই সব থেকে বেশি সফল। অথচ এর বিপরীতে সেই নারীরাই কোভিডে সব থেকে বেশি বৈষ্যম্যের শিকার হয়েছেন।