বাঙালির মুক্তির সোপানে আগুন ঝরা মাস মার্চ প্রতিবারই আমাদের আন্দোলিত করে, স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় চেতনার ঘরে। মার্চ আসে নানা মাত্রা নিয়ে। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করে। আর দুদিন পরেই এ ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তী। এ ভাষণের নানা মাত্রিকতা নিয়ে একটু আলোকপাত করার চেষ্টা বক্ষ্যমাণ রচনায়। প্রথমে অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু যাক। ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-
“৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালির মহাকাব্য। এ মহাকাব্য বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এ মহাকাব্য রচনা সম্ভব ছিল।”
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ১৮ মিনিটের অনলবর্ষী ভাষণে ১১০৫টি শব্দের সমন্বয়ে এই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। যে মহাকাব্যের মধ্যে নিহিত হয়েছে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ভাষণের শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে তা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণের চতুর্দিকে অনুরণিত। যে কারণে মার্কিন ম্যাগাজিন Newsweek বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দিয়েছে ÔPoet of Politics’ হিসেবে। এদেশের কোটি জনতার বহু যুগের লালিত স্বপ্ন-ত্যাগ, তিতিক্ষা-আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল আমাদের এই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষাভিত্তিক একমাত্র জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। হাজার বছরের সংগ্রাম শেষে যে রাষ্ট্রের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে।
১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি বিত্ত-বৈভবের বিভাজন নির্বিশেষে এক মহাঐক্যে জাগ্রত করেছিলেন মহাভাষণের মাধ্যমে। এই মহাভাষণের পটভূমি তিনিই তৈরি করেছিলেন তার দীর্ঘ ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ দীর্ঘ দুই দশকে তিনি যে অসংখ্যবার বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য জেলে গিয়েছেন, তা বাঙালি-মননে অগ্নিশিখার মতো কাজ করেছিল। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল তার দীর্ঘ সংগ্রামের একটি পরিণত ফুল ও ফল। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রের প্রত্যাশা ছিল, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন বঙ্গবন্ধু। জনসভায় রওনা দেবার আগে ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা দীর্ঘক্ষণ তার পথ আগলে রেখে তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার জন্য কাকুতি-মিনতি জানিয়েছিল। কিন্তু তিনিতো জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি ভালো করেই জানতেন কসাই ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খান ওঁত পেতে ছিল ওই একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপের জন্য। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে সে সুযোগ দেননি। উলটো ২৫ মার্চ অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে চারটি দাবি উত্থাপন করলেন- (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার (২) সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া (৩) সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং (৪) জনপ্রতিনিধিদের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর। যে দাবিগুলো মানার সাধ্য ছিল না পাক সামরিক জান্তার।
৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান যে কূটচাল দিয়েছিলেন, তার পাল্টা ও সমুচিত জবাব ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।
৭ মার্চের ভাষণ পর্যালোচনা করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লিখেছেন-
“বর্তমান যুগের ইতিহাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জন্ম একটি বিরাট ঘটনা। ... সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মহানেতা। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে, এ আশা আমাদের আছে ও থাকবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিবের বিশাল মহিমার একটি প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই, তাঁর মহামানবতার আর একটা পরিচয় আমরা পাই তার চিন্তাধারার অসাধারণতায়।”...
৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন লিখেছেন-
‘৭ মার্চ অপরাহ্ণে তিনি যখন জনসভার মঞ্চে উঠেছেন তখন তো জনসমুদ্র প্রবঞ্চক পাকিস্তানিদের প্রত্যাখ্যান করে নায়কের নির্দেশের অপেক্ষায় মাত্র- তারা তো জানে যুদ্ধ অনিবার্য, আসন্ন। নেতা লড়াইয়ের অগ্নিমন্ত্রে শানিয়ে দিলেন জনতার অন্তর। যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পথে এভাবেই রওয়ানা করিয়ে দিলেন জাতিকে ৭ মার্চ অপরাহ্ণে।” তিনি আরও লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাগ্মিতার জাদুতে- বক্তব্যে সমালোচনা, অভিযোগ, ক্ষোভের প্রকাশ তো ছিলই, কিন্তু তাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও চূড়ান্ত ঘোষণার গুরুত্ব চাপা পড়েনি, মূল অভীষ্ট সাধনে ভুল হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে এ ভাষণটি দিলেও শব্দ হাতড়ানো, লাগসই শব্দের অভাবে যতি কিংবা যথার্থ বয়ানের ব্যর্থতায় বক্তব্য অস্পষ্ট বা জটিল হওয়ার মতো কোনো অঘটন ছাড়াই টানা বলে গেছেন তিনি। ঠিক যেন চয়িত শব্দফুলের মালা গাঁথলেন এক মহাকবি। মাঝে মাঝে বাঙাল শব্দের ব্যবহার- যেমন দাবায়ে রাখতে পারবা না- বক্তৃতাটিকে দিয়েছে দেশজ সৌরভ এবং মুজিব ব্যক্তিত্বের সপ্রাণ ওজস্বিতা। ভাষণটি কেবল বুদ্ধির নির্মাণ নয়, ভালোবাসার আবেগ জীবন্ত। এটির আবেদন যুগপৎ বৃদ্ধি ও হৃদয়বৃত্তির কাছে। তাই অনুপ্রাণিত এক বক্তা সেদিন তার মুখাপেক্ষী জনতাকেই সবচেয়ে বড় ব্রত সাধনের আবাহন করেছিলেন। তার ডাক মানুষের অন্তরে পৌঁছেছিল। এমন মর্মভেদী, অন্তরস্পর্শী, দূরদর্শী বক্তৃতার দৃষ্টান্ত মেলে না ইতিহাসে।
প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন উদ্ধৃত করেন-
“বঙ্গবন্ধু হয়ে যেমন কেউ জন্মান না তেমনি সাতই মার্চের ভাষণও কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ইতিহাসের উজান বেয়ে একজন রাজনৈতিক কর্মীর উত্তরণ ঘটে। আর বাঁকবদলের কালে নেতার পরীক্ষা নেয় ইতিহাস- সাহসে, ত্যাগে, প্রেম ও প্রজ্ঞায়, পারবেন কি সময়োচিত কাজটি করতে? সাতই মার্চে তেমন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।” .... একদিকে স্বাধীনতার আশায় বুক বেঁধে দাঁড়ানো বাঙালি আর অন্যদিকে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগের অপেক্ষায় পাকবাহিনী। নেতার জন্যে যথার্থই অগ্নিপরীক্ষা। নেতা অগ্নিপরীক্ষার উত্তর দিলেন অগ্নিগর্ভ ভাষণে- যা আমাদের ইতিহাসে আর বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে লিখিত থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। ... সাতই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির জন্ম হয়েছে, আর সেই জাতি একজন অবিসংবাদিত নেতাকে পেয়েছে।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। যে ঘোষণার সূত্র ধরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে নিজস্ব অবস্থানের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায় ‘বাংলাদেশ’ নামে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে যাতে চিহ্নিত না হন, সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সব সময় সতর্ক ছিলেন। নিজেকে এবং বাঙালিকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যে নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। এ বিষয়ে Newsweek ম্যাগাজিনের বর্ণনা নিম্নরূপ:
“A month ago, at a time when he was still publicly refraining from proclaiming independence, Mujib privately told Newsweek’s Loren Jenkins that “there is no hope of salvaging the situation. The country as we know it is finished.” But he waited for President Yahya Khan to make the break. “We are the majority so we cannoy secede. They, the westerners, are the minority, and it is up to them to secede.”
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে কৌশলী পথ বেছে নিয়েছিলেন, তাতে বিশ্বের সেরা সমর-কৌশলীরাও অবাক হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের ইতিহাসের দায় মোচন করেছিলেন অবিস্মরণীয় এক ভাষণের মধ্য দিয়ে। তিনি অবিশ্বাস্যভাবে মুক্তিপথে সংহত করে দাঁড় করিয়ে দিলেন বাংলার মানুষকে, যার ফলে সামনের দিনগুলোতে যা-ই ঘটুক না কেন, অনন্য দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ জাতি তা মোকাবিলায় হয়ে উঠেছিল ক্ষমতাবান। ৭ মার্চের ভাষণের ছত্রে ছত্রে কর্তব্যের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই ভাষণের কোনো আন্তর্জাতিক মাত্রা ছিল না। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে বিবেচনাকালে আমরা বুঝে নিতে পারি এই ভাষণ ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতিসত্তার আশু মুক্তির দিগদর্শন। ফলে ২৫ মার্চের কালোরাত্রিতে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলেও জাতি দিশেহারা হয়ে যায়নি এবং পরবর্তীকালে যুদ্ধরত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিণ্ডলে বন্ধুহীন হয়ে পড়েনি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। গ্রিক নগররাষ্ট্র এথন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোনাল্ড রিগ্যান পর্যন্ত ২৫০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F field, ‘We shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। যে বইটি ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। সে বইয়ে আলেজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অলিভার ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, যোসেফ গ্যারিবোল্ডি, আব্রাহাম লিংকন, ভ্লাদিমির লেনিন, উইড্রো উইলসন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, উইনস্টন চার্চিল, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, চার্লস দ্য গল, মাও সেতুং, হো চি মিন প্রমুখের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বিশ্ব ইতিহাসে যে কয়টি অসাধারণ বক্তৃতা আছে, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ প্রায় দশ লক্ষ মানুষের সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা তার অন্যতম, সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম। আর কোনো স্মরণীয় ভাষণের বক্তা এরকম একটি বিশাল জনসমুদ্রে তাৎক্ষণিক শব্দচয়নের মাধ্যমে এমন একটি মহাকাব্যিক ভাষণ দেননি।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের পিতা ফিলিপের হাতে যখন একে একে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটছিল, তখন ডেমোস্থেনিস নগর-রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের স্বাধীনতা হারানোর অশনিসংকেত নির্দেশ করে যে ভাষণগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলো বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় ভাষণ। সেসব ভাষণের বিভিন্ন অংশ কালের সীমানা পেরিয়ে আজও আমাদের উদ্দীপ্ত করে। খ্রিস্টের জন্মের চার শ’ বছর আগে অ্যাথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে ত্রিশ বছর ধরে যে যুদ্ধ চলেছিল, তা ‘পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সে যুদ্ধের একপর্যায়ে অ্যাথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস যে অবিস্মরণীয় ও মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা আজও গণতন্ত্রের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার চিরন্তন বাণী হিসেবে ইতিহাসকে আলোকিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬৩ সালের আগস্টে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে (I have a dream)’ শিরোনামে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা-ও বিশ্ব ইতিহাসের একটি অমর বক্তৃতা। পেরিক্লিস, আব্রাহাম লিংকন এবং অন্যান্য মহান জাতীয় নেতা ও রাষ্ট্রনায়কগণ যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন, তা কোনো জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে নয়। সেসব ভাষণে কোনো একটা জাতিকে হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং মুক্তি সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণে বাঙালি যেন হাজার বছরের জড়তা, দৈন্য ও গ্লানি অতিক্রম করে এক মহাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজন্ম সাধন-ধন, আজন্ম-অধরা স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দীক্ষা পেল।
৭ মার্চের বক্তৃতার আগে বঙ্গবন্ধু দুটি বিপরীত স্রোতের মাঝখানে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন। একদিকে ছাত্র-জনতার দাবি- এখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হোক, অপরদিকে চতুর সামরিক শাসক ও তাদের দোসরদের পক্ষ থেকে সমঝোতায় আসার জন্য বৈঠকের আহ্বান। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু যে উভয় সংকটে পড়েছিলেন, সে রকম সংকটে মনে হয় কোনো স্বাধীনতাকামী নেতাকে পড়তে হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনে ৭ মার্চই ছিল সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুহূর্ত। তার দল আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচন করেছে এবং নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছে। টালবাহানা করার পর যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সরকার ঢাকায় এসে ৬ দফা নিয়ে আলোচনা করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের নিষ্পত্তি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে তখন সেই উদ্যোগকেও প্রত্যাখ্যান করা যায় না। অপরদিকে যে উত্তাল জনসমুদ্র প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং সংগ্রামী স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের আশ্বাস না দিলে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হবেন। ছাত্রদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের পর থেকে জনতার পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণার দাবি দুর্বার হয়ে উঠেছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সের ময়দানে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তিনি ভয়াবহ সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে কখনো ভাষণ দিতে হয়নি; পৃথিবীর কোনো নেতার সামনেও কখনও এমন পরিস্থিতি আসেনি। বক্তৃতায় কী বলবেন? কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবেন? একই সঙ্গে কীভাবে প্রতিপক্ষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবেন? এমন বহু বিষয় তাঁকে প্রচণ্ড চাপের মুখে ফেলেছিল। এ বিষয়ে প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ভাষায়-
“আমি আব্বার মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। এটা ছিল আমার রুটিন ওয়ার্ক। আমি সবসময় করতাম। ভাবতাম এটা না করতে পারলে আমার জীবন বৃথা। আব্বা যখন খাটে শুতেন, বালিশটা নামিয়ে আমার বসার জন্য একটা জায়গা করে দিতেন। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছিলাম। মা পাশে এসে বসলেন। বললেন, আজ সারা দেশের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে তোমার বাঁশের লাঠি, জনগণ আর পেছনে বন্দুক। এই মানুষদের তোমাকে বাঁচাতেও হবে- এই মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে। অনেকে অনেক কথা বলবে- তোমার মনে যে ঠিক চিন্তাটা থাকবে- তুমি ঠিক সেই কথাটা বলবে- আর কারো কথায় কান দেবা না। তোমার নিজের চিন্তা থেকে যেটা আসবে যেভাবে আসবে- তুমি ঠিক সেইভাবে কথাটা বলবা। এই ছোট্ট কথাটুকু মা আমার আব্বাকে ঐ সভায় যাবার আগে বলে দিয়েছিলেন।”
অধ্যাপক অজয় রায় ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে লিখেছেন-
“মন বলছিল আজ বাংলার-বাঙালির এক নতুন ইতিহাসের অধ্যায় রচিত হবে। ইতিহাস রচনার এই মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত থাকা হাজার বছরে একবারই আসে। কাজেই সেদিন এই ময়দানে উপস্থিত ছিলেন যাঁরা, তাঁরা অনেকের চাইতে ভাগ্যবান, তাঁরা জননন্দিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে ইতিহাস রচনায় অংশ নিয়েছিলেন, আর ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক অমর কাব্যখানি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং, যে কাব্যের নাম ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
অধ্যাপক অজয় রায় আরও লিখেছেন-
“আমি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক মহাপুরুষের, মহান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুভাষণ শুনেছি, কিন্তু এমন কবিত্বময় অথচ প্রাণস্পর্শী, উদ্দীপনাময় অথচ সংযত বক্তৃতা আমাকে এত গভীরভাবে স্পর্শ করেনি। সত্যিই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এক অনুপম অমর কবিতা। ... এটি ছিল একটি অনন্য কবিতা, একটি মন্ত্র যা সেদিন সেই মুহূর্তে কেবল শেখই রচনা করতে পারতেন, আবৃত্তি করতে পাররতেন এবং শ্রোতাদের উদ্বেলিত করতে পারতেন- অন্য কেউ নয়। ... ৭ মার্চে আমরা যদি ক্যান্টনমেন্ট দখলের চেষ্টা করতাম তাহলে বিশ্ববিবেক ও জনমত আমাদের পক্ষে থাকত না, আমরা চিহ্নিত হতাম বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে, আর বঙ্গবন্ধু কলঙ্কিত হতেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইতিহাসবিদ ড. এ আর মল্লিক লিখেছেন-
“আমার মনে হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ... ৭ মার্চের ভাষণ বেতার (পরদিন) মারফত চট্টগ্রামে থেকেই আমাদের শোনার সুযোগ হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংগ্রামে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেই ঐ দিনই।”
এই ভাষণের জন্যই হয়তো বাঙালি সহস্র বছর অপেক্ষা করেছে। ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্য শহীদুল্লা কায়সার ও পান্না কায়সারের প্রস্তুতি তাই বলে। ‘মুক্তিযুদ্ধ : আগে ও পরে’ গ্রন্থে পান্না কায়সার লিখেছেন-
“শহীদুল্লা কায়সার তাকে বলেন, তোমার জীবদ্দশায় এমন ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হবে না। চল, কিছুক্ষণ থেকে চলে এসো। আমার ছেলে তার জন্মের আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা শুনবে। তোমার জীবনে এ দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে শোনালেন জাতির বহু যুগের লালিত স্বপ্নের ও স্বপ্নভঙ্গের কথা, আসন্ন সংগ্রামে পথচলার দিকনির্দেশনার কথা। তার পক্ষেই এমন নির্দেশনা দেয়া সম্ভব ছিল, কারণ তিনি কখনোই ক্ষমতার মোহে অন্ধ ছিলেন না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যত আসন তিনি পেয়েছিলেন, তাতে আপস করলে, শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হয়তো হতে পারতেন। কিন্তু তাতে দেশ ও জাতির মুক্তি আসত না। এই পথে পা বাড়াননি তিনি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক