দুটি ইঁদুর নরণ-চরণ আর লালঝুঁটি মুরগি বাস করত গ্রামের এক প্রান্তে। মুরগি সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির উঠান ঝাড় দেয়, রান্নাবানা করে। একদিন উঠান ঝাড় দিতে গিয়ে সে কুড়িয়ে পেল একটি গমের শীষ। সঙ্গে সঙ্গে নরণ-চরণকে ডাক দিয়ে বলল, নরণ-চরণ এদিকে আয়। দেখ কী কুড়িয়ে পেলাম! নরণ-চরণ দেখে খুশি হয়ে বলল, খুব ভালো, তাহলে পিঠা তৈরি কর।
মুরগি বলল, পিঠাতো বানাতেই পারি। কিন্তু আটা কুটবে কে?
নরণ-চরণ বলল, আমরা পারব না বাপু।
তাহলে আটার কলে গম ভাঙাতে নিয়ে যাবে কে?
নরণ-চরণ বলল, আমরা পারব না বাপু।
আচ্ছা, তাহলে পিঠাটা বানাবে কে?
এবারেও নরণ-চরণ বলল, আমরা পারব না বাপু।
লালঝুঁটি মুরগিটি তখন বলল, ঠিক আছে। তাহলে আমিই সব করছি। এবার নরণ-চরণ খুশি হয়ে নাচ-গান-খেলাধুলা শুরু করল।
পিঠা বানানোর পর নরণ-চরণ ছুটে এলো পিঠা খাওয়ার জন্য। এবার মুরগি বলল, গমের শীষ কুড়িয়ে পেলো কে?
উত্তর এলো, তুমি।
শীষটা ঝাড়াই বাছাই করল কে?
উত্তর এলো, কেন তুমি।
বাজার থেকে তেল, গুড় এনে পিঠা বানাল কে?
উত্তরে নরণ-চরণ চিঁচিঁ করে বলল, তুমিই তো সব করলে।
মুরগি বলল, তাহলে বল এবার পিঠাটা খাবে কে?
নরণ-চরণ কোনো উত্তর না দিয়ে মন খারাপ করে চলে গেল।
আমাদের পরিবারে মা বা গৃহিণীর ভূমিকাটা ঠিক এই গল্পের মতোই। শুধু পার্থক্য হলো মা সব কাজ করার পর পিঠাটা পরিবারের সদস্যদের মুখেই তুলে দেন। প্রায়শই নিজের ভাগটাও পান না। দেখা গেছে আমাদের পরিবারগুলোতে অধিকাংশ সদস্যের ভূমিকা এই নরণ-চরণের মতো। এরপরও এই নরণ-চরণরা বলে, আমার মা তো বা আমার স্ত্রীতো কিছুই করে না।
এই প্রসঙ্গটা উঠে আসার কারণ হলো, সম্প্রতি চীনের বেইজিংয়ের একটি আদালত বৈবাহিক জীবনে স্ত্রী ঘরের যেসব কাজ করেছেন, এর জন্য তাকে অর্থ দিতে স্বামীকে নির্দেশ দিয়েছেন। বেইজিংয়ের আদালতের এই রায়কে ঐতিহাসিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আদালতের এই রায়ের ফলে ওই নারী তার পাঁচ বছরের বৈবাহিক জীবনে গৃহকর্মের জন্য ৫০ হাজার ইউয়ান পাবেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা সাড়ে ছয় লাখ টাকার বেশি। মামলা ও আদালতের রায় নিয়ে চীনের সাইবার জগতে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।
নতুন আইন অনুযায়ী, বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন, যদি তিনি বৈবাহিক জীবনে তার জীবনসঙ্গীর তুলনায় ঘরের কাজ ও দায়িত্ব বেশি পালন করেন। আদালত বলেছেন, বিবাহবিচ্ছেদের পর সাধারণত দুজনের (দম্পতি) যৌথ পরিমাপযোগ্য সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়। কিন্তু গৃহস্থালি কাজ অপরিমাপ্য সম্পত্তি, আর তার মূল্যও রয়েছে।
এই রায় নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। খবরটির নিচেও মন্তব্যের ঘরে যথেষ্ট মতামত পাওয়া যাচ্ছে। অধিকাংশ পুরুষই এই রায়কে মেনে নিতে পারছেন না। তারা তাদের কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন। যেসব পুরুষ সংসারে আয় করার পাশাপাশি ঘরের কাজেও দায়িত্ব পালন করেন, তারাতো অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। অবশ্য তাদের একথাও মনে রাখতে হবে যে অসংখ্য নারীও ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করে চলেছেন। সেক্ষেত্রে তাদের মূল্যমান কিন্তু পুরুষের চেয়েও বেশি। এখন কথা হচ্ছে নারীর সেসব গৃহস্থালি, সেবামূলক ও কৃষিকাজ নিয়ে, যা উৎপাদনশীল অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও, বিভিন্ন কারণে অস্বীকৃতই থেকে যাচ্ছে। এমনকি সংসারে সিংহভাগ কাজ নারী করলেও তাকে এসব কাজের জন্য স্বামী-সন্তান- পরিবারের পক্ষ থেকে ন্যূনতম ধন্যবাদও দেয়া হয় না। এর মানে হচ্ছে তারা মনে করেন নারীর এসব কাজ মূল্যহীন।
প্রসঙ্গটি পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য একটি ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করছি। আম্মা একবার সপ্তাহখানেকের জন্য রংপুর যাওয়ার পর পরই বাসায় চূড়ান্ত অব্যবস্থা দেখা দিল। একজন সহযোগী থাকার পরও বাসার অবস্থা দুঃসহ। শেষমেষ ফোন করে আম্মাকে ৪ দিনের মাথায় ফিরিয়ে আনা হলো। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম আম্মার সার্ভিস এবং ব্যবস্থাপনা ছাড়া আমরা অসহায় এবং আম্মা ছাড়া আমাদের সংসার শূন্য। সেবার থেকেই মেনে নিলাম আম্মাই হলো বাসার প্রকৃত বস।
একথা এখনও মানি যে, আম্মার তত্ত্বাবধান ছাড়া আমাদের কারো পড়াশোনা হতো না। অসুস্থতার সময় আম্মার সেবা না পেলে আমাদের সেবা করার আর কেউ ছিল না। আব্বা থাকলেও আম্মাই ছিলেন আসল। সেদিন আব্বা এবং আমরা কেউ বুঝিনি আম্মার এই গৃহস্থালি এবং সেবামূলক কাজের পরিমাপ কতটা বা এ কাজ জিডিপিতে কতটা প্রভাব রাখতে পারে। স্কুল থেকে বাসায় ঢুকে নরণ-চরণের মতো চিৎকার করে বলতাম, আম্মা খিদা লেগেছে, খাবার দাও। তারপর খেয়েদেয়ে আম্মার আঁচলে মুখ মুছে চলে যেতাম। এ শুধু আমার একার পরিবারের চিত্র নয়, সবাই ভেবে দেখলে একই ছবি দেখতে পাবেন।
আজ বুঝতে পারি সংসারে মায়ের কাজের যে ভার, তা আর কারো কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং বেশি। গৃহস্থালি কাজকে আমরা এতটাই অবজ্ঞা করি ও নগণ্য মনে করি যে, একজন গৃহিণীকে দেখবেন নিজের পরিচয় দিতে খুব অস্বস্তিবোধ করেন। মৃদুস্বরে বলেন, আমি কিছু করি না, অথবা বলেন, আমি শুধু ঘরের কাজ করি।
লক্ষ করে দেখবেন এত কাজ করা সত্ত্বেও নিজেদের পরিচয় দেয়ার সময় গৃহিণীদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে আসে। যে সন্তান বা যে স্বামীর জন্য তারা পুরো জীবন উৎসর্গ করেন, তারাও তাদের গৃহিণী মায়ের বা স্ত্রীর পরিচয় দিতে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারণ সমাজ আমাদের মাথায় গেঁথে দিয়েছে যে গৃহকাজ আসলে কোনো কাজ নয়। অথচ সকাল থেকে সন্ধ্যা-অব্দি একজন নারী যা করেন, কখনও কি সেই কাজের হিসাব করে দেখেছেন? সেই কাজটা গৃহিণী না করে, অন্য কাউকে দিয়ে করালে এই খাতে পরিবারের কী পরিমাণ খরচ হতো একবার চিন্তা করুন। শুধু কি খরচ? কত ধরনের ঝামেলা পোহাতে হতো পরিবারকে। মা বা স্ত্রী গৃহে আছেন বলেই তার পরিবারের সব সদস্য যথাসময়ে যথাযথ সুবিধাটি পাচ্ছে।
রোগে-শোকে মা বা স্ত্রী-ই পাশে থাকেন, সংসারের সব কাজ করেন, বয়স্ক মানুষ থাকলে তাদের দেখাশোনা করেন, বাচ্চাকে পড়ান, টিফিন তৈরি করে দেন মা, স্কুলে আনা-নেয়ার কাজটিসহ আরও অন্য সব সাংসারিক দায়িত্বও পালন করেন। কৃষিকাজের ২৩টি কাজের মধ্যে ১৭টিই করেন নারী। গৃহিণীরা কাজ করেন না, এরপরেও কি একথা ধোপে টেকে?
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে গত ২/৩ দশক ধরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৬-১৭ সালে এসে তা হয়েছে ৩৬.৩ শতাংশ। দেশের পিতৃতান্ত্রিক ও রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার পরও এই সংখ্যাগত হার তেমন বাড়েনি, বরং পুরুষের চেয়ে তা অনেক কম।
অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখনও যথার্থ দৃষ্টি পাচ্ছে না। নারী তার সময়ের একটা বড় অংশ বাজার-কেন্দ্রিক কাজের চেয়ে বাজার বহির্ভূত কাজে ব্যস্ত থাকেন। এই বিনামূল্যের গৃহস্থালি কাজগুলোকেই অ-অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অস্বীকৃত এবং অদৃশ্য কাজগুলো শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুযত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে আছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ।
অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন দেশে ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। পুরুষের সংখ্যা সেখানে ১ শতাংশেরও কম। অথচ দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) তে নারীর অবদান মাত্র ২০ শতাংশ।
যেহেতু আর্থিক মূল্য ছাড়া কোনো কাজই বাজার অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয় না, তাই বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিবিদরা সাধারণত স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করেন। স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নারীর অমূল্যায়িত কাজকে চিহ্নিত করে তা নিরূপণ করা যাবে।
স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেম হচ্ছে এমন একটি হিসাব পদ্ধতি, যা দিয়ে ঘরের অ-অর্থনৈতিক সেবামূলক বা গৃহস্থালি কাজ মাপা হয়। এই কাজগুলো কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশা ছাড়াই গৃহিণীরা করে থাকেন। কিন্তু এই কাজগুলো জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে ।
এখন বৈশ্বিক এজেন্ডা হচ্ছে এমন সমাধান খুঁজে বের করা, যার মাধ্যমে নীতি বা পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীর অর্থনৈতিক কাজকে উৎসাহিত করা যায়। সেসঙ্গে এমন সুযোগ সৃষ্টি করা যেন নারী কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজে যোগ দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
জেন্ডার সমতা আনার ক্ষেত্রে এসডিজি ৫ অর্জন করতে চাইলে অবশ্যই নারীর অস্বীকৃত গৃহস্থালির কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে, যা টার্গেট ৫.৪ এবং সূচক ৫.৪.১-এ সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। এই পদ্ধতিতে সেবা কাজ মূল্যায়নের ভালো উদাহরণ নেপাল, মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং কেনিয়াসহ আরও ৮টি দেশ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কোনো দেশ যদি অধিকতর বাস্তবসম্মত শ্রম এবং কর্মসংস্থান নীতি গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই নারীর অ-অর্থনৈতিক কাজকে শ্রমবাজার অর্থনীতির আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এসডিজি লক্ষ্য ৫.৪ এ স্পষ্টতই বলা হয়েছে পরিবারে কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার, পুরুষকে কাজে নিয়োজিত করা এবং প্রজন্মান্তরে কর্ম বিভাজনের ধারার কথা ।
আমরা ঠিক এখনই বেইজিং আদালতের রায়ের মতো রায় চাই না, তবে চাই নারী যেন তার গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজের জন্য সম্মানিত হন। সংসারের সব কাজ করেও তাকে যেন সবার সামনে মাথা নত করে থাকতে না হয়। কোনো সন্তান যেন মনে না করে তার মা কিছু করে না। সর্বোপরি স্বামীসহ সংসারের আর কোনো সদস্য যেন বলতে না পারে- সারাটা দিন তুমি করটা কী?
লেখক : সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন