সম্প্রতি ‘জান’ ‘জবান’ শব্দ দুটি নিয়ে ফেসবুক সরগরম। কেউ এর মধ্যে ভাষার ইসলামিকরণ দেখছেন, কেউ মনে করছেন, শব্দগুলো বহু আগে থেকেই তো বাংলায় আছে, নতুন করে শব্দ দুটিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে কেন?
ভাষায় শব্দের ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে হলে অনেক পিছন থেকে আসতে হয়। ব্রিটিশ আমলে যে বাংলা ব্যাকরণ তৈরি করা হয়েছিল উপনিবেশিক শাসকদের মনের মতো করে, তাতে সংস্কৃত পণ্ডিতেরা ইচ্ছেমতো সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছিল, বাংলা ভাষার স্বাভাবিক চলন–বলন পালটে ফেলেছিল, ফলে মুখের ভাষা থেকে লেখার ভাষা হয়ে পড়েছিল একেবারে ভিন্ন।
বহুদিন পর বাঙালি মুসলমান যখন বুঝতে শুরু করল যে, আসলে বাংলাটাই তার মাতৃভাষা, তখন তারা বাংলা ভাষায় কীভাবে লিখবে এবং কী লিখবে, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলমানেরা উলটো পথ ধরে বাংলা ভাষায় লিখতে গিয়ে আরবি–ফারসি শব্দ এমনভাবে ব্যবহার করতে শুরু করল, যাকে যথেচ্ছাচার না বলে উপায় নেই।
বহতা নদীর মতো যে কোনো জীবন্ত, সচল ভাষা অন্য ভাষার শব্দকে গ্রহণ করে নেয়। তার সঙ্গেই নিয়ে এগিয়ে যায়। তাতে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু সে ভাষা যদি আরোপিত হয়, তাহলেই বিপদ। তখনই ভাষা নিয়ে রাজনীতি পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ে।
আমরা মধ্যযুগে বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর স্বতন্ত্র বাংলা ভাষার কথা এখানে বলব না। আহমদ ছফাসহ অনেকের লেখাতেই সে সময়টি খুব যত্নের সঙ্গে উঠে এসেছে। এখানে বলব, পাকিস্তান আন্দোলনের পথ ধরে ইসলামি জোশ বুকে নিয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে যে নীরিক্ষা শুরু হলো, তার কথা। বলে রাখি, কাজী নজরুল ইসলাম যে দৃঢ়তার সঙ্গে তার কবিতায় আরবি–ফারসি শব্দের প্রয়োগ করেছেন, তা নিয়ে কোনো কথা উঠছে না। কারণ বাংলা ভাষায় আরবি–ফারসির এ রকম সুনিপুণ প্রয়োগ ভাষাকে সমৃদ্ধ ও কারুকার্যমণ্ডিত করে।
কিন্তু ভাষার বারোটা বাজিয়ে দেয়ার উদাহরণ দেখতে আমরা যাব তালিম হোসেনের কাছে। তিনি লিখছেন-
“মোবারক হো জিন্দেগী
মোবারক হো জিন্দেগী
চল সিপাহী জিন্দাদিল
কর আজাদ জিন্দেগী।
কর আজাদ পাকিস্তান
ইসলামের পাক ওয়াতান
কোরআনের কর আবাদ—
পুণ্য রাহে আন্ জাহান।”
(তালি, হোসেন, মোবারক হো জিন্দেগী, মাহে নও, ১৩৫৮, ৩.২)
সৈয়দ আলী আহসান লিখছেন-
“জরির জোব্বা, শেরোয়ানী আর আমামার সজ্জায়
আতরের পানি, মেশকের রেনু খোসবু বিলায়ে যায়
নেকাব খুলেছে নতুন কুমার—রাত্রি হয়েছে ভোর
ইয়াকুতি আর জুমর রাতের লেবাস পরিয়া সুলতানা আছে তখতের পরে বসি
জোহরা সেতারা নেমেছে মাটিতে আসমান হতে খসি
( সৈয়দ আলী আহসান, বেদনাবিহীন স্বপ্নের দিন, মাহে নও, ১৩৫৬, ১:২)
কাজী নজরুল ইসলামের শাণিত কবিতার পাশাপাশি এই অক্ষম কবিতাগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়, ভাষার ইসলামিকরণ কোন ধরনের বিপদ ডেকে আনছিল।
পরিষ্কারভাবে বলতে হবে, ভাষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে শব্দ আসবে, তাকে নিজের করে নেবে ভাষা স্বয়ং। নতুন কোনো শব্দ যদি বাংলা ভাষায় সুপ্রযুক্ত হয়, তাহলে সে শব্দ কোন ভাষা থেকে এল, তা দেখার দরকার নেই, ভাষাকে সমৃদ্ধ করছে কি না, সেটাই মুখ্য। কিন্তু যদি ভাষার রাজনীতি থেকে কোনো শব্দকে আমদানি করা হয়, তবে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হতেই হয়, এমনকি যে শব্দ ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে, সে শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রেও সেটা মনে রাখতে হয়।
ভাষা–রাজনীতি এতোটাই সূক্ষ্ম, যে তা নিয়ে কথা বলতে হলে অনেক বিষয় যেমন উঠে আসবে, তেমনি যেতে হবে ইতিহাসের গভীরে, এই ক্ষুদ্র লেখায় সে সুযোগ নেই। তবে সেই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে অন্য কিছু কথা বলা যায়।
এই মার্চ মাসেই এসেছিল স্বাধীনতার ডাক। এ মাসে দেশের সঙ্গে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিল বাংলার মানুষ। যে পথের দিশা দিয়েছিল বায়ান্ন সাল, তারই দেখানো পথ ধরে এই জায়গায় এসে পৌঁছেছিল বাঙালি। কিন্তু তাতেই কি ইতিহাসের কাছে অমর হয়ে থাকল বাংলা? গৌরবের অর্জনকে কি সুসংহত করতে পারল বাংলাদেশ? পরবর্তীকালে তার এগিয়ে চলার পদ্ধতির মধ্যে কি গলদগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না?
দেশপ্রেম খুবই জরুরি একটা ব্যাপার। নিজের দেশকে ভালোবাসলেই অন্য দেশকে ভালোবাসা যায়। অন্যের প্রতি আগ্রহ আসে মনে। নাড়ির টান ছাড়া কোনো কিছু গভীরতা পায় না। যা ভাবছে মানুষ, সে ভাবনা আন্তরিক না হলে, অর্থাৎ অন্তর থেকে উঠে না এলে তা অর্থহীন হয়ে যায়। এ কারণেই যারা আরবি–ফারসির ওপর ভর করে এগোতে চেয়েছে, তারা বাংলার চাষাভুষার কাছে পাত্তা পায়নি, আবার যারা ইংরেজির ওপর দাঁড়াতে চেয়েছে, তারাও একসময় ফিরে এসেছে নিজ ভাষা বাংলায়। ভিনদেশের ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করার বিরুদ্ধে আমি কিছু বলছি না। আমি বরং প্রবলভাবে চাইব, অন্য ভাষায় নিজের ভাবনা ছড়িয়ে দিতে পারলে নিজেকে, নিজের দেশকে সমৃদ্ধ করা যায়। আর সে জন্য নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি ভালোভাবে আত্মস্থ করে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির সাগরে সাঁতার কাটা জরুরি। নিজেকে বিশ্ব নাগরিক বানাতে গিয়ে নিজের সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেললে তা দেউলিয়াপনাই, অন্য কিছু নয়।
অন্যদিকে উগ্র দেশপ্রেম বিপদ ডেকে আনে। ‘আমিই শ্রেষ্ঠ’ বলার মধ্যে জাতীয়তাবাদের যে সূক্ষ্ম কারিকুরি আছে, তা মানবতার জন্য খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। কেউ যদি কেবলমাত্র নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করে, তবে বুঝতে হবে তার ভাবনায় গলদ রয়েছে। অন্যকে ছোট করে নিজে বড় হওয়ার ভাবনার মধ্যে মানবতা থাকে না। জাতীয়তাবাদী ধারণা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খুবই ক্রিয়াশীল। বিশেষ করে লাঞ্ছিত–বঞ্চিত জাতির জন্য তা বিরাট আশ্রয়। এর মাধ্যমেই তারা সুহংহত হয়। এর মাধ্যমেই তারা নতুন স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নগুলো যদি বাস্তব অতিক্রম করে অলীক জায়গায় পৌঁছে যায়, যার নাগাল মানুষ পায় না, তাহলে একসময় সেই জাতির মধ্যে হতাশা আসে। ভুল স্বপ্ন দেখা হয়েছিল বলে মনে হয়। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ না পেয়ে সে হতাশার পথ ধরে অনুন্নত কিংবা পশ্চাৎপদ ভাবনা এসে হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে দেশপ্রেমী জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে। তখন জাতীয়তাবাদ নিয়ে ঠাট্টা–মশকরা করাও শুরু হয়। আর এই পশ্চাৎপদ ভাবনার মিছিলে শুধু ভাবনার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষই শরিক হয় না, বিরোধী শিবিরে অবস্থান করা পাকামাথা বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশও তাতে যোগ দেয়।
অথচ পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নিজেকে সেরা প্রমাণ করার এক অমানবিক আয়োজনের ক্রীড়নক হচ্ছে মানুষ। ইতিহাসের নানা পথ গলে বেরিয়ে আসছে তারকারা, তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য মানুষ হত্যা করছে, গুড়িয়ে দিচ্ছে মূল্যবোধ। যাকে আমরা সভ্যতা বলি, তার পরতে পরতে এখন নিষ্ঠুরতার ভয়ংকর চিহ্ন দেখতে শুরু করেছে মানুষ।
ইতিহাস লেখার ছলে কলম্বাস বা তার মতো মানুষদের ‘আবিষ্কারক’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল একদা, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তাদের হাতে আমেরিকার অগুনতি মূল অধিবাসী (যাদের নাম দেওয়া হয়েছে রেড ইন্ডিয়ান) নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খুনিকে আমরা নায়ক বলে মেনে নিয়েছিলাম।
এ রকম উদাহরণ তো একটা নয়। সভ্যতার ইতিহাসে এ ধরনের অসভ্য (আসলে যাদের অসভ্য বলা হয়, তাদের মধ্যে যে সরলতা আছে, সেটাই সভ্য হওয়ার সোপান কি না, তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে) ঘটনা পাওয়া যাবে ভুরিভুরি। তবে এ লেখার উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই অন্য কোথাও সভ্য–অসভ্য বিবাদের কেঁচো খোঁড়া যাবে—আমি নিশ্চিত, তাতে সাপের দেখা মিলবে।
দেশপ্রেম কি এমনি এমনি জন্ম হয়? তার জন্য কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই? জন্ম হলো, বেড়ে উঠল মানুষ এবং তার মনে এমনি এমনি জন্ম নিল দেশপ্রেম! আবেগে গদগদ হয়ে দেশমাতৃকা নিয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিল কেউ একজন। ব্যাস! তালির পর তালি! তিনি দেশপ্রেমিক হয়ে গেলেন মুহূর্তে! এ–ও কি সম্ভব?
পরিহাসচ্ছলে কথাগুলো বলা হলেও তা একেবারে অসত্য নয়। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এ ধরনের ‘দেশ–ভাবনাহীন দেশপ্রেমী’র দেখা মিলবে বিস্তর। কিন্তু কেন এই ভয়াবহতার পথে আমরা এগোলাম, তা নিয়ে কিঞ্চিত কথাবার্তা হতে পারে। কয়েকটি বিষয়ে কথা বলা যাবে ঠিকই, কিন্তু বাকি থাকবে আরও অনেক বিষয়। যা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে নতুনদিনের মানুষদের।
সাদা চোখে যে বিষয়গুলো চোখে পড়ে, তা বলা যাক:
১.
বাঙালি জাতীয়তাবাদে পোক্ত হয়ে স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলার মানুষ। পাকিস্তানিদের শোষণ–বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের হাতেই নিজের নির্ভরতার চাবি নিতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানাভাবে এদেশেই সৃষ্টি হলো একশ্রেণির কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। দেশের চালিকাশক্তি হয়ে উঠল পুঁজিপতিরা (যাদের একটা বড় অংশই ঋণখেলাপি), রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হলো মাঠপর্যায়ের রাজনীতিবিদেরা, তাদের জায়গায় ব্যবসায়ী, পুঁজিপতিদের আধিক্য দেখা দিল রাজনীতিতে। ফলে দেশ ও দশের সেবার স্লোগানটি স্লোগান হিসেবে টিকে থাকলেও মূলত অল্প কিছু মানুষের পেশি শক্তির কাছে দেশসেবা পরাজিত হলো। দরপত্র ডাকাতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির দাপট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যক্তিস্বার্থে কাজে লাগানো, প্রশাসনিক দুর্নীতির লাগামহীনতা, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে রাজনীতির ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছে সাধারণ মানুষ। ভালো মানুষ রাজনীতিতে যেতে ভয় পায়। কিংবা এখন উপজেলা পর্যায়ে রাজনীতি করতে হলে যে পরিমাণ টাকা–পয়সার প্রয়োজন হয়, কোনো সৎ রাজনীতিবিদের পক্ষে তা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব, তা ছাড়া টাকার দাপটে তিনি খড়কুটোর মতোই ভেসে যাবেন।
এ কথা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হয়ে গেছে এমন।
২.
পরিবার ও শিক্ষালয় থেকে দেশকে ভালোবাসার যে শিক্ষা দেয়ার কথা, সেটা নেই বললেই চলে। সবাই ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছে। যে কোনো মূল্যে ওপরে উঠতে পারলেই কেল্লাফতে। পথটা বিবেচ্য নয়, সাফল্যটাই শেষ কথা। আগে দীনহীন শিক্ষককে দেখলে কালো টাকার মালিক মাথা নিচু করে পথ ছেড়ে দিত, এখন দরিদ্র শিক্ষকই কাঁচুমাচু হয়ে সেই কালো টাকার মালিককে সালাম দিতে বাধ্য হন। নৈতিক জায়গায় এই পরিবর্তনটা ঘটে যাওয়ায় অনেক কিছুই পালটে গেছে।
৩.
দেশের সংস্কৃতি বেঁচে থাকে দেশের শিরায় শিরায়। কিন্তু সুকৌশলে দেশ থেকে লোকজ সংস্কৃতি বিদায় করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। কখনও তাতে সাফল্যও এসেছে। গ্রামগঞ্জে যাত্রা, আলকাপ, মেলা, জারি গান, বাউল গান, কবি গান আজ বিলুপ্তপ্রায়, অথচ সেখানে মিথ্যাচারে ভরা ওয়াজ মাহফিলের রমরমা। ওয়াজের মধ্যে যে মিথ্যাচার করা হয়, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না বলে, যা ইচ্ছে তা বলে যাচ্ছে কিছু ওয়াজকারী। মাঝে মাঝেই তাদের ‘জ্ঞানের বহর’ দেখার দুর্ভাগ্য হয় দেশবাসীর। একটি দেশপ্রেমী রাষ্ট্রে এই অরাজকতা চলতে পারে না। কিন্তু চলছে।
৪.
সংস্কৃতি নিয়ে যারা আছেন, তাদের নেতাদের একটা বড় অংশই মূলত রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধাভোগী। সংস্কৃতিকে জনমনে প্রোথিত করার জন্য যে নিষ্ঠা ও নান্দনিক ভাবনা থাকা দরকার, সেটার চর্চা নেই বললেই চলে। কিছু রাগী যুবক–যুবতী হয়তো মাঝে মাঝে এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন, কিন্তু মূলত সংস্কৃতিও এক ধরনের সুবিধাবাদী ব্যবসাতে পরিণত হয়েছে। বেশি দূর যেতে হবে না, টেলিভিশনে প্যাকেজ নাটকের আদি–অন্ত নিয়ে খোঁজ নিলেই সেখানে সংস্কৃতির চেয়ে ব্যবসাকে প্রকটভাবে দেখতে পাবেন।
৫.
‘রাজাকার’ অথবা ‘আলবদর’ শব্দের অর্থ যা-ই হোক না কেন, বাংলা ভাষায় তার অর্থ বদলে গেছে। যেমন, ‘দুঃসাহস’ শব্দটির মানে একসময় ছিল ‘বদ সাহস’ বা ‘খারাপ সাহস’। পুরোপুরি নেতিবাচক ছিল শব্দটি। কিন্তু এখন সে তার অর্থ বদলে ‘অসীম সাহসী’র প্রতিশব্দ হয়ে গেছে। তেমনি ‘রাজাকার’ ও ‘আল বদর’ শব্দ দুটি বাংলা ভাষায় খুবই ঘৃণ্য দুটি শব্দে পরিণত হয়েছে একাত্তরের পর।
আমি আমার একটা শঙ্কার কথা বলেই আজকের লেখাটি শেষ করব।
যেহেতু আমরা স্বাধীনতার পর স্বাধীনতার মর্ম লালন করিনি মনে, তাই আমাদের ব্যর্থতাগুলো পুঁজের মতো উঠে আসছে রাষ্ট্রের সর্বশরীরে। এই পথেই ধর্ম ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, অসৎ ব্যবসায়ীরা শরীরে মলম লাগানোর ব্যবসা করছে। যদি প্রতিবাদ না হয়, তাহলে একসময় এরাই বদলে ফেলবে দেশের ইতিহাস, দেশের সংগ্রামের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে অশ্লীল কটূক্তি করার পরও কিছু মোল্লা–মওলানার কোনো শাস্তি হতে দেখিনি আমরা। সেই বক্তব্যগুলো ইউটিউবে এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে। ফলে, এই ধরনের মিথ্যে অপবাদ দিয়েও যদি পার পেয়ে যেতে থাকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা, তবে এই দেশের সামনে ঘণায়মান বিপদকে এড়ানো যাবে না। ঋণখেলাপি কিংবা বিদেশে অর্থ পাচারকারী একটা বড় দলকেও আমরা দেখতে পাচ্ছি বিনা বাধায় কাজ চালিয়ে যেতে।
এই তালিকায় আরও অনেককিছু যুক্ত হতে পারে। আপনি নিজেও নিজের মতো করে বানিয়ে নিতে পারেন তালিকা। দেখবেন, এই ব্যর্থতার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।
উপেক্ষা কখনও কখনও আরও বড় বিপদ ডেকে আনে। আমরা সে রকম একটি সন্ধিক্ষণের মধ্যেই আছি।
লেখক: গবেষক, সাংবাদিক-কলাম লেখক