বাঙালির গৌরব জগৎসভার সেরা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাস একটি অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি দিয়ে শেষকথা বর্ণিত হয়েছে কবিতার মাধ্যমে “মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে/ পার হয়ে আসিলাম/ আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়”। আজ কবির এই বচন আমাদের জীবনে সত্য হিসেবে প্রতিভাত হলো। কত দুঃখে এবং কত অপমানে নিষ্পেষিত ছিল আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জাঁতাকলে আমাদের এই বঙ্গের জনগণ নিষ্পেষিত ও অপমানিত হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। তারপর ভারত বিভক্ত হয়ে গেল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। আমরা পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা আমাদের সভ্যতা ও কৃষ্টিকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানিদের দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলাম। সেই অপমানিত জীবন থেকে আমরা মুক্ত হলাম আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে, পঞ্চাশ বছর আগে। আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা ভাষার অধিকার আদায়ের জন্যে ১৯৫২ সালে রক্তপাত করে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিলাম। সেখানেও আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজ ‘বাঙ্গাল’ ভাষা আন্তর্জাতিক একটি ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ভাষায় রচিত হয়েছে পৃথিবীর অমর গ্রন্থ, সংগীত, উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধাবলি।
বাঙালির সমৃদ্ধ শিল্প সৃজন আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। আজ আমরা উপলব্ধি করছি, বাঙালি জাতি হিসেবে পৃথিবীর কোনো জাতির তুলনায় আমরা ছোট নই। অনেক লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও রক্তদানের প্রতিদানে আমরা আজ নব প্রভাতের শিখরচূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে রেখে যাচ্ছি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, যার কৃতিত্বের দাবিদার হলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা, যিনি জনকের হাতের আলোকবর্তিকাটি নিজহাতে তুলে নিয়ে আজকের বৈশ্বিক মহামারির দীর্ঘ সময়েও আমাদের সঠিক পথ দেখিয়ে চলেছেন।
১৯৭১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময়ে তার বিদেশ সচিব চতুর হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়ে বক্রোক্তি করেছিলেন। আজ বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বকে অবাক করে দিচ্ছে এই জন্যে যে, এই ঘন বসতিপূর্ণ ছোট্ট আয়তনের একটি দেশ বিশ্ব সংসারে একটি সম্ভ্রমপূর্ণ আলোচিত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশ আজ গৌরবের স্থানে অধিষ্ঠিত।
বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় পথ পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পরে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করার তালিকায় সকল শর্ত পূর্ণ করে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠনিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে। বাংলাদেশ এই স্বীকৃতি পেল যখন আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী পালন করছি এবং পালন করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই অতিমারির সময়েও দেশবাসীর মনটা ভালো হয়ে গেল এই আকাঙ্ক্ষিত অর্জনে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা যথার্থভাবেই এই অর্জনকে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে উৎসর্গ করেছেন। ২০৩১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করবে এবং ২০৪১ সালে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ জিডিপি হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তৃতীয় স্থান অধিকারের মর্যাদা পেয়েছে। উচ্চহারের জিডিপি অর্জনে বাংলাদেশ এশিয়ায় এবং বিশ্বের অনেক দেশকেই ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে।
আজ আমাদের আনন্দ এই জন্যে আমাদের অনেক কষ্টে অর্জিত বাংলাদেশ, আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ একদিন বিশ্ব মানচিত্রে উন্নত দেশের মর্যাদায় নিজ দেশের পতাকা উড্ডীন করে গৌরবান্বিত হবে। দেশ মাতৃকার পরাজয় নেই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!
লেখক : মঞ্চসারথি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব