স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। এর স্বীকৃতিও পাওয়া গেছে বিভিন্ন মহল থেকে। করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতি কিছুটা শ্লথ হলেও থমকে যায়নি। এ মুহূর্তে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জন। এটাও ঠিক যে, আমাদের সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করা যায়নি। অর্থনীতিতে প্রায় সব অর্জন এসেছে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের হাত ধরে।
এলডিসি উত্তরণের ফলে ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারকে মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমিকদের কাজের পরিধি বাড়াতে হবে। পরিধি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন প্রাপ্য মজুরি পায়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ, শ্রমিকদের কাছ থেকে মালিকদের কাজ আদায় করতে হলে তাদের সুযোগসুবিধা দিতে হবে।
দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকটিভিটি বিশেষ করে শিল্প-বাণিজ্য প্রতিযোগিতামূলক (কমপেটেটিভ) করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে হলে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তারা সরকারি সুবিধা নেবে, ভর্তুকি নেবে। কিন্তু এর পাশাপাশি তাদের উৎপাদনও বাড়াতে হবে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন জরুরি। আমাদের কারিগরি জ্ঞান বা দক্ষতা খুব কম। কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। প্রযুক্তি বলতে শুধু ডিজিটাল ইন্টারনেট, ফোন, ফ্যাক্স, সোশ্যাল মিডিয়াই নয়। এর বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পে কারিগরি দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
যেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে তাদের কর্মদক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি বাড়াতে হবে। এসব সংস্থাগুলোকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে এবং তদারকি আরও সুদৃঢ় করতে হবে। তবে অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ অথবা শিথিল নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই কাম্য নয়। এ দুটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নীতিমালা ও প্রবিধান প্রস্তুত করে তা পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
এলডিসি উত্তরণে তৈরি পোশাক শিল্প কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ জন্য রপ্তানির ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। শুধু তৈরি পোশাক পণ্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। রপ্তানির পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। নতুন নতুন বাজার ধরতে হবে। এ জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্ষমতা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউটিও) যেসব ফোরাম আছে সেখানে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে হবে। এসব ফোরামের কাছে বাংলাদেশে যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ আছে, সেটা তুলে ধরে তা নিশ্চিত করতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার পর ক্রেডিট রেটিং ভালো হবে। নিজেদের ভাবমূর্তি আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহ (এফডিআই) আগের চেয়ে বাড়বে। কিন্তু তার আগে বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এর উন্নতি করতে না পারলে কোনো লাভ হবে না।
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি করতে হবে। পরিহার করতে হবে বাণিজ্যে দীর্ঘসূত্রতা। ২০২৬ সালের মধ্যে সার্বিকভাবে পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তখন বাণিজ্যিক ঋণ কমে যাবে। এ জন্য নিজেদের সামর্থ্য আগে বাড়াতে হবে।
এলডিসির চূড়ান্ত ধাপে এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) টার্গেট পূরণ সম্ভব হবে। এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য টেকসই হতে হবে। আজ ব্যবসা খাত একটু ভালো করবে, কাল আবার খারাপ হবে, এমন যাতে না হয়।
পাশাপাশি ব্যবসা যেন গুটি কয়েক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত না হয়, সে বিষয়ে জোর দিতে হবে। কারণ, বিশেষ এক শ্রেণির ধনীর তুলনায় উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এ জন্য ব্যবসার পরিবেশ স্বাভাবিক করাসহ সর্বজনীন মানুষ যেন ব্যবসা করতে পারে, তেমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যবসার সব সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত হতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাবগুলো পর্যালোচনা করে উন্নয়নের সুফলগুলো তৃণমূল পর্যায়ে যথাযথভাবে পৌঁছাতে হবে। কারণ, যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ সুফল পাচ্ছে ঢাকা শহরসহ বিভাগীয় শহর ও কয়েকটি নগর। এ জন্য অর্থ-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উন্নয়নের সুফল, দেশের সম্পদ, এমনকি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ যেন কেন্দ্রীভূত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ, যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারলে পণ্যের গুণগত মান বাড়ে। দেশীয় বাজারে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। প্রত্যেকে যে যার মতো কারসাজি (ম্যানিপুলেট) করে ব্যবসা করছে। ফলে এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এসব প্রস্তুতি যদি না নেয়া হয়, তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গিয়েও কোনো লাভ হবে না। আর উন্নয়নশীলে উত্তরণ করলেও বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। পাশাপাশি এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন না করলে উন্নয়নশীল দেশের সুফল ভোগ করা যাবে না।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মৌসুমী ইসলাম