আজকের এই লেখাটির প্রেরণা আবদুল জব্বার। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী। খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি জব্বার সাহেব। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সংসারের চাপে পড়া বন্ধ করে চাকরিতে ঢুকতে হয়। তার ভাষায় ‘ছোট চাকরি’ করে কোনোক্রমে সংসারধর্ম পালন করে যাচ্ছেন। আবদুল জব্বার ঘোরতর বিএনপি-সমর্থক। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
১৯৭৪ সালে সন্ত্রাসীরা ওদের জমি দখল করে। স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে সুবিচার পাননি। সেই থেকে ওদের পরিবার ক্ষমতাসীন দলের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। তরুণ জব্বারকে জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচি আকৃষ্ট করেছিল। তার বাবা একসময় যেমন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন, তিনি তেমনি জিয়াউর রহমানের ভক্ত। কথা বললে বোঝা যায় দারুণ রাজনীতিসচেতন মানুষ তিনি।
বিএনপি-অন্তঃপ্রাণ জব্বার সাহেব পরিচয়সূত্রে সেদিন একটি আবদার নিয়ে এলেন। বললেন, স্যার, আমি সব সময় পত্রিকার রাজনৈতিক কলাম পড়ার চেষ্টা করি। আপনার লেখাও পড়ি।
আমি হেসে বললাম, আমি তো সুযোগ পেলে আপনার দলের সমালোচনা করি। বিষয়টি নিশ্চয় আপনার ভালো লাগে না। একগাল হাসলেন জব্বার সাহেব। হাসলে তার পান খাওয়া দাঁত বেরিয়ে আসে। বললেন, আপনি তো স্যার আওয়ামী লীগকেও ছাড়েন না। আপনারা তো স্যার দলগুলোর ভালোর জন্যই লেখেন। দলগুলোর বরং আপনাদের ধন্যবাদ দেয়া উচিত। শুনে বেশ ভালো লাগল। আমাদের ‘ধন্যবাদ’ দেয়ার জন্যে তাহলে জব্বার সাহেবদের মতো লোকও আছেন।
এবার জব্বার সাহেব সোজাসুজি বললেন, স্যার, আপনার কাছ থেকে একটা উপকার পাওয়ার জন্য এসেছি। আপনারা দয়া করে আমাদের দলটাকে বাঁচান। জব্বার সাহেবের আবেগ আমাকে স্পর্শ করল। তবে বিষয়টি বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি সাধারণ একজন শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা ছাড়া কোনো দলের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। এমন একজন ঢোড়াসাপ-মার্কা কলাম লেখক কেমন করে বিএনপিকে বাঁচাবে!
আসলে জব্বার সাহেবের চাওয়া আমরা যেন বিএনপি নেতৃত্বকে সঠিক পথের দিশা দেখাই। তা না হলে তার প্রিয় দলটি নিঃশেষিত হয়ে যাবে। আমি খুব বিস্মিত হলাম। নেতা-কর্মীরা না ভাবলেও সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে যে মুক্তচিন্তার দলভক্ত মানুষ রয়েছেন জব্বার সাহেবকে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যেত না। এরপর একজন স্বল্পশিক্ষিত দল-অন্তঃপ্রাণ জব্বার সাহেব যেভাবে নিজ দলের অন্তক্ষরণের বিচার করলেন তাতে আমার মাথা নুয়ে এলো।
বারবার একটি দুঃখ আমরা করে থাকি প্রত্যেক দলেই শিক্ষিত মেধাবী মানুষদের অবস্থান আছে। যেমন বিএনপির কথাই যদি বলি, এখানে আছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিকসহ নানা পেশাজীবী গোষ্ঠী।
স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা করা হয়, এরা হবেন দলের গাইড ফিলোসোফার। দল ভুলপথে হাঁটলে তারা সতর্ক করে দেবেন। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে তারা বিনা প্রতিবাদে দলের সব কর্ম-অপকর্ম মেনে নেন। দলের সুবিধাবাদী নেতা যেমন দলনেত্রীর সব সিদ্ধান্তকে বেদবাক্য মনে করে বলে বিশ্বাস করাতে চান, স্লোগান তোলেন ভবিষৎ পদপদবি পাওয়ার লোভে, তেমনি দলের বুদ্ধিজীবীরাও অভিন্ন উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানের বন্দনাই গান।
অনেক বছর আগের কথা। জোট সরকারের আমলে বেগম জিয়ার ইচ্ছায় যখন সব সিনিয়র নেতার ঘাড় টপকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হলো তারেক রহমানকে তখন রাজনৈতিক নেতারা না হয় মেরুদণ্ড সংকটের কারণে নীরবতা বজায় রেখেছিলেন; কিন্তু দলের গাইড, ফিলোসোফার বুদ্ধিজীবীরা কথা বলার মতো সাহসী হতে পারেননি কেন? ক্ষমতাবান হওয়ার পর পারিবারিক রাজনীতি পাকাপোক্ত করার জন্য কর্মীদের মুখে যখন তুলে দেয়া হলো নতুন স্লোগান ‘আগামীর রাষ্ট্রনায়ক তারেক জিয়া’ তখনও তারা কেন মুখ খুললেন না? এই তরুণের মাথা খারাপ করে দেয়া হচ্ছে। ঘাট ছেড়ে আঘাটায় হাঁটা শুরু করে দেবে। যখন হাওয়া ভবন হলো আর একে দুর্নীতির তীর্থভূমি তৈরি করা হলো, তখন দলের বিবেকবানরা কেন নিশ্চুপ বনে গেলেন? বরং তখন জাতীয়তাবাদী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা, আইনজীবী নেতা থেকে শুরু করে অন্য জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী নেতারা কি নানা ধরনের পদ প্রাপ্তির জন্য তারেক জিয়ার দরবারে ধরনা দিতেন না?
২০০৮-এর নর্বাচনে ভূমিধস পরাজয়ের পর তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যখন নিজদলের সন্ত্রাস দুর্নীতি আর জামায়াতসংশ্লিষ্টতাকে দায়ী করলেন তখনও নীরব থাকলেন বিএনপির বিবেক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। নেতারা যখন আত্মশুদ্ধির পথে না গিয়ে গৎবাঁধা বুলিতে নির্বাচনে কারচুপি করে বা দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বিএনপিকে হারিয়ে দিয়েছে ধরনের রেকর্ড বাজাচ্ছিলেন তখনও সত্যকে মেনে নেয়ার কথা দলীয় বিবেকরা একবারও বললেন না।
সে সময় একদিন শিক্ষক লাউঞ্জে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে একজন জাতীয়তাবাদী শিক্ষক যখন দমদেয়া পুতুল রাজনৈতিক নেতাদের মতো করে বলছিলেন নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন আমি চলমান বাস্তবতা মেনে নিয়ে খুব বিস্মিত হইনি। সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সহকর্মীকে যখন চেপে ধরলাম এবং বললাম সেই নির্বাচনে আপনি তো আমার সঙ্গেই অনেকগুলো ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন। ব্যাপকভাবে নারী পুরুষ ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে আমরা আপ্লুত হয়েছিলাম। সর্বত্র নৌকার পক্ষে একটি জোয়ার বুঝতে পেরে আমি যখন মহাজোটের অভূতপূর্ব বিজয়ের সম্ভাবনার কথা বলছিলাম, আপনি প্রতিবাদ করেননি। বাস্তবতা মেনে কষ্টমাখা মুখ নিয়ে নীরব থেকেছেন।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবান শিক্ষক হয়ে কলের গান বাজানেওয়ালা দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের মতো কথা বলতে আপনার বিবেক কি সায় দেয়? আমার সহকর্মীটি এদিনও প্রতিবাদ না করে নীরব থাকলেন।
তবু মন্দের ভালো এই যে, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনও খালেদা জিয়া-তারেক জিয়া মাতম করে মিছিল করেন না এবং অন্যপক্ষ শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু স্লোগান ধরে ক্যাম্পাসে মিছিল নামান না বা ছাত্র মিছিলের আদলে ভাঙচুর করেন না।
আইনজীবী রাজনীতিকরা তো এদিক থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে আছেন। কিছুকাল আগেও দেখেছি তারা আদালত অঙ্গনে ছাত্রকর্মীদের স্টাইলে ও ভাষায় মিছিল করেন, কালো গাউন পরে বিপক্ষ দলের আইনজীবীদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ান, ভাঙচুর করেন। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াতে অংশ নেন। তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার’ করার জন্য স্লোগান দেন। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে একবারও মনে হয় না মামলা মিথ্যা কি মিথ্যা না তা সাব্যস্ত করার এখতিয়ার রাখেন মহামান্য আদালত। আদালতে লড়াই করে না হয় মামলা মিথ্যা তা প্রমাণ করবেন।
আমার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক আছে এমন একজন উদারমনা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী নেতার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম বিএনপি ক্ষমতায় এলে ওপরের সারির এক-দুজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হতে পারেন। তাই এই সম্ভাবনাময় নেতারা বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের দৃষ্টিতে ও আস্থায় থাকার জন্য যা খুশি করতে পারেন আপনারা কেন বিবেকবর্জিত হয়ে গড্ডলিকায় গা ভাসান? উত্তরে বললেন ছোটখাটো চাওয়া-পাওয়ার চিন্তাও কমবেশি সবার আছে। তা ছাড়া রাজনীতির একটি মোহ আছে, যা সবাইকে অন্ধ করে দেয়। প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার একটি আনন্দ পেতে চায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিএনপিকে সমর্থন করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু জামায়াত ও মুক্তিযোদ্ধাদের তো একপাতে ভাত খাওয়ার কথা নয়। আমরা কি কখনও শুনেছি বা পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, বিএনপির মুক্তিযোদ্ধারা দলীয় নেতাদের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, জামায়াত-বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে হবে? তবে বিএনপির সাধারণ সমর্থকরা অনেক বেশি যুক্তিবাদী। কোনো কিছু পাওয়ার লোভে নয়, প্রকৃত অর্থে দলকে ভালোবাসেন তারা। তাই সবকিছু সাদাচোখে দেখেন। ভালোমন্দ বুঝতে পারেন তীক্ষ্ন বিশ্লেষণে।
আমি মনে করি, এদেরই প্রতিনিধি কলেজের গণ্ডি না পেরোনো, ‘ছোট চাকরি করা’ আবদুল জব্বার সাহেব। অন্ধত্বের অঞ্জন যার চোখে নেই। দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি দলের কল্যাণে সমালোচনা করতে চান। এ সময়ে বিএনপি যে পথে হাঁটছে তাতে পা পিছলে অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে বিএনপি নেতারা দলকে সুগঠিত করতে পারেননি। বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদের গৎবাঁধা কাগজ পাঠ করা আর নেতাদের নিষ্ফল বক্তব্য প্রদানেই আটকে আছে বিএনপির আন্দোলন।
সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের পদবি বাতিলের অহেতুক তর্ক তুলে বিএনপিকে সংগঠিত করার পথ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিএনপির আয়েসি নেতারা একে যে খুব কাজে লাগাতে পারছেন তেমন মনে হয় না।
এই সত্য জব্বার সাহেবদের চোখে স্পষ্ট বলেই দলের প্রতি ভালোবাসা থেকে তারা আতঙ্কিত। আর তাই যেন অনন্যোপায় হয়ে স্রোতের শেওলার বিবেচনায় আমার মতো অজ্ঞাতকুলশীল কলাম লেখকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এই সরল মানুষগুলো শুধু এই সত্যটি বুঝতে চান না আমাদের এসব ছাইপাঁশ লেখা তাদের নেতাদের কাছে পাঠের অযোগ্য। তারপরও জব্বার সাহেবের অনুরোধ, আমি যেন লিখি-
১. বিএনপি এখন জামায়াতসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অতটা সরব নয়। তবু জামায়াতের সংস্পর্শ থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে হবে,
২. তারেক রহমানের ইমেজ এখন আর বিএনপির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। বেগম জিয়া তারেক রহমানকে দিয়ে পারিবারিক রাজনীতি এগিয়ে নিতে চাইলে তা বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই বিএনপিকে রক্ষা করতে হলে দলের ভেতর প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশপ্রেমিক সৎ নেতৃত্ব ছাড়া বিএনপির পুনর্গঠন সম্ভব নয়
৩. রাজনৈতিক শক্তি শানিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে হেঁটে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে যথার্থ নির্বাচন আদায় করে নিতে হবে।
আমি অবাক বিস্ময়ে আর শ্রদ্ধায় ঘোর বিএনপি-সমর্থক জব্বার সাহেবের কথা শুনছিলাম। পাশাপাশি একটি নতুন উপলব্ধির কাছে পৌঁছতে পারলাম। বিএনপির রাজনৈতিক নেতা ও পেশাজীবী জাতীয়তাবাদী নেতাদের আচরণ দেখে দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন শঙ্কিত ছিলাম, তখন নতুন আশার আলো এনে দিলেন জব্বার সাহেব। যে দলে অমন মুক্তবুদ্ধির সমর্থক রয়েছেন, সে দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ শতভাগই থাকে। শুধু প্রয়োজন জব্বার সাহেবের মতো নির্লোভ, সাহসী দল ও দেশপ্রেমিক মুক্তবুদ্ধির কর্মী-সমর্থকদের ঐকতান।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়