বিশ্বজুড়ে চলছে করোনা সুনামি। সর্বত্রই জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দুটিকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে এই সংকটের মোকাবিলা করছেন। আমাদের জাতির পিতা ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, নানা দুর্ভোগেও তার দেশবাসী কাবু হবে না। বরং ‘বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের ইচ্ছাশক্তির জোরেই জয়ী হবে শেষ পর্যন্ত।’ সেই একই রকম আস্থার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা চলমান বিশ্ব সংকট মোকাবিলায় জনগণের অজেয় প্রাণশক্তির ওপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। আর এই ভরসার কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষ করে কৃষির অভূতপূর্ব শক্তিমত্তা।
সারা বিশ্ব যখন করোনাকালে মহামন্দায় ভীতসন্ত্রস্ত, তখন আমাদের চাঙা কৃষি তার আশার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে চলেছে। তবে খাদ্যশস্যেও উৎপাদন তথা সরবরাহই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষের হাতে ওই খাদ্য কেনার মতো সক্ষমতাও থাকতে হবে। সে কারণেই বাজেটে মানুষের কাছে খাবার ও অর্থ পৌঁছানোর জন্য সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দ যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রতিটি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকারপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলে বিপন্ন মানুষের কাছে সরকারি সহযোগিতা ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে কি না তার খোঁজখবর নিয়েছেন। গার্মেন্টশ্রমিকদের বেতন নিশ্চিত করেছেন। অনানুষ্ঠানিক খাতের হঠাৎ আয়-রোজগার হারানো মানুষের কাছে নগদ সহায়তা ও খাদ্য সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন। একই সঙ্গে কৃষক, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাসহ হঠাৎ বেকার হয়ে যাওয়া মানুষের জন্য বিশেষ প্রণোদনা কর্মসূচি চালু করেছেন। উদ্দেশ্য, গ্রামীণ অর্থনীতিতে যেন ভোগ বাড়ে। ভোগ বাড়লেই স্থানীয় চাহিদাও বাড়বে। আর চাহিদা বাড়লে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াবে। অর্থনীতি ফের স্থিতিশীল হবে। আর এভাবেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। তবে এই বিরাট কর্মযজ্ঞ সামাল দেওয়া শুধু একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যক্তি খাত, অসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন তথা কমিউনিটিকে এগিয়ে আসতে হবে। আর এই সংকটকালে ভালো উদ্যোক্তা, সমাজের সচ্ছল মানুষ এবং নানা মাত্রিক সংগঠন এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে তরুণসমাজের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। এত কিছু সত্ত্বেও শহরের কম আয়ের মানুষের আয়-রোজগার বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কর্মরত অনেকেরই কাজের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ছোটখাটো উদ্যোক্তা ও অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়ীরা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। অনেকে বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। কম আয়ের বাড়ির মালিকদেরও তাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর শক্তিশালী নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এ বছর আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ নানা সূচকে অভাবনীয় অগ্রগতির আশা করেছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাস আমাদের সেই চলার গতি হঠাৎ থমকে দিয়েছে। আমাদের সব পরিকল্পনা ও কৌশল উলটে দিয়েছে। তবু আমরা আশা করছি, আমাদের দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী আপৎকালীন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে জীবন ও জীবিকা উভয় খাতকেই সংরক্ষণ করবেন।
নিঃসন্দেহে তার সরকারের প্রথম লক্ষ্য এখন অদৃশ্য এই ভাইরাসকে পরাজিত করা। সেজন্য স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে মানুষের করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। টিকাদান কর্মসূচি চলছে।
আমাদের অর্থনীতির এই শক্ত ভিত্তি একদিনে তৈরি হয়নি। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে বিশেষ জোর দিয়েছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষির দিকে তিনি মনোযোগ দেন। শপথগ্রহণের পর পরই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তার কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সারের দাম ব্যাপক হারে কমিয়ে দেন। আর কৃষিতে ভর্তুকি (আসলে বিনিয়োগ) দিতে তার সরকার কখনও কার্পণ্য করেনি। এর পাশাপাশি সরকার অনেক বছর থেকেই জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষির উন্নয়নে গবেষণা ও সম্প্রসারণ খাতে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। গত এক দশকে ১০৯টি জলবায়ু-সহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা।
এসবই সম্ভব হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে তৎপর প্রধানমন্ত্রীর নীতি সমর্থনের কারণে। সারা বিশ্বই প্রধানমন্ত্রীকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব আর্থ’ বলে জানে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করেই তিনি বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে যে বিপ্লব এনেছেন তা বিশ্ববাসী জানে। বাংলাদেশ সারা বিশ্বে দশম বৃহত্তম ফসল উৎপাদক- ধানে তৃতীয়, সবজিতে তৃতীয়, মাছে দ্বিতীয় এবং আমে সপ্তম। বছরে ৭২ ধরনের ফল ফলে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ গড়ে ৮৫ গ্রাম ফল খেতে পারে।
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্রুত সফলতা অর্জন করছে। সরকারের ইতিবাচক প্রণোদনামূলক নীতির কারণেই সম্ভব হচ্ছে। কৃষকদের জন্য এক কোটিরও বেশি ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব, দুই কোটিরও বেশি কৃষি উপকরণ কার্ড, সাত কোটিরও বেশি মোবাইল ব্যাংক হিসাব, প্রত্যেক কৃষকের ঘরে বিদ্যুৎ, ১৫ হাজারেরও বেশি সৌর সেচ প্লান্টসহ নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে শেখ হাসিনার সরকার। ৩ হাজার ৮ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার অর্থনৈতিক ডিজিটাল হাব তৈরির কাজ করছে সরকার। এসব ইউনিয়নে এখন হাইস্পিড ইন্টারনেট কানেকশন আছে। গ্রামীণ ডাকঘরগুলো এখন মোবাইল ব্যাংকের এজেন্ট, ই-কমার্স কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। দেশের তথ্য বাতায়নকে তথ্যসেবায় রূপান্তরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে এসডিজি পূরণের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী কাউকে গৃহহীন রাখবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়নও করছেন। সুন্দরবন সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার তৎপর বলেই সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পান ততটা ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি। জলবায়ু-সহিষ্ণু বায়োডাইভারসিটি প্লাস কৃষি উৎপাদনে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন রয়েছে বলেই কৃষিবিজ্ঞানীরা খুব তৎপর। আর সেজন্যই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। তবে হঠাৎ করে কোভিড-১৯ এসে আমাদের অর্জন অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে এ সংকট কেটে গেলে আমরা দ্রুতই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে পারব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণের চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিদ্যমান। বড় পাইকারি বাজারের সঙ্গে সারা দেশের ছোট ও খুচরা বাজারের পুনঃসংযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল ই-বাণিজ্যের প্রসার এখন সময়ের দাবি। পরিবহন চালু হলেও কৃষির সরবরাহ চেইন এখনও পুরো সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। তাই দূরের কৃষক সবজি, মাছ, মুরগি, গরু ও দুধের উপযুক্ত দাম পাচ্ছেন না।
ভাগ্যিস, প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিযান শুরু করেছিলেন। তাই এই সংকটকালে ‘ফুড ফর নেশনস’, ‘পাইকার ডট সেল’সহ অসংখ্য ই-কমার্স সাইট গড়ে উঠেছে। উদ্ভাবনীমূলক তরুণদের স্টার্টআপগুলো কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে দারুণ ভূমিকা রাখছে। মাঠপর্যায়ে আমাদের প্রশাসনের তরুণ কর্মকর্তাদের অনেকেই সহনীয় পর্যায়ে এমন স্টার্টআপ গড়ে তুলতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
অপরদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় ফারমার্স মার্কেট সচল রেখেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগও বেশ তৎপর। বীজ ও চারা, ফসলের নানা সমস্যার বিষয়ে তারা সর্বক্ষণ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আর তথ্য বাতায়নকে রূপান্তর করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ‘ইকোনমিক হাবে’ পরিণত করতে পারলে তো কথা-ই নেই।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
“আমাদের বাঁচিবার উপায় আমাদের নিজেদের শক্তিকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করা।”
সময় এসেছে তেমন সামাজিক জাগরণের। সরকার তার সাধ্যমতো করছে। সমাজকেও সচেষ্ট হতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।