মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর এবার উদযাপিত হতে যাচ্ছে। এমন একটি ঐতিহাসিক সময় জাতির জীবনে আর কখনও আসবে না। ৫০ বছরে আমাদের অর্জনসমূহ যেমন দেখার সুযোগ ঘটছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারিনি; সেগুলো আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
মার্চ থেকে সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা হয়তো দেখতে পাব। মোটাদাগে বাংলাদেশ ৫০ বছরে আর্থ-সামাজিকভাবে ভালো একটি অর্জনের জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে। একসময় পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশকে হতদরিদ্র বলে আখ্যায়িত করত। এখন এই দেশটিই মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করার কৃতিত্ব অর্জন করেছে।
সর্বশেষ সংবাদ হচ্ছে, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা দিয়েছে। তবে যেটি দেখা ও বোঝার বিষয়, তা হচ্ছে ভিশনারি-মিশনারি রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে, উন্নয়ন ও মানবকল্যাণের ধারণা বাস্তবায়নে কাজ করেছে, তখনই বাংলাদেশ অগ্রগতির চাকা দ্রুত ঘোরাতে পেরেছে। তবে দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, একটি বড় সময় ধরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনার নেতৃত্ব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের হাতে ছিল না। সে কারণে রাজনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। আদর্শহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সুবিধাবাদ, উগ্র মতাদর্শিক হঠকারিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জলাঞ্জলির মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্র-রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, এবং ব্যাপক মানুষের মনোজগতে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে আমরা সেই রাজনৈতিক আদর্শবান, মেধাবী ও নিষ্ঠাবানদের আর খুঁজে পাই না।
বাংলাদেশ ৫০ বছরে অর্থনৈতিক জিডিপিতে প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু সেই তুলনায় রাজনীতির গুণগত প্রবৃদ্ধি আমাদেরকে আশাহত করে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ৫০ বছর পূর্তির আনুষ্ঠানিকতায় কতখানি ভেবে দেখবে কিংবা প্রস্তুতি নেবে সেটি দেখার বিষয়। তবে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের একটি বড় ধরনের বিস্তারের সময় পৃথিবীব্যাপী পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরাও এর ভয়ানক প্রভাব থেকে মুক্ত নই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের ভাবাদর্শ যদি চর্চায় স্থান না পায়, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আগামীর দিনগুলোতে কতটা প্রতিষ্ঠিত থাকবে তা বলা কঠিন। সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন গভীর সংকটে পড়তে পারে। এর নজির পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, নাইজার, সুদান, নাইজেরিয়াসহ বেশ কিছু দেশ এখন ভয়ানক সংকটে রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওইসব শক্তির আদর্শগত মিল অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়।
সুতরাং স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে পেছনের এই অপশক্তির উৎসমূলকে যেমন চিহ্নিত করতে হবে, একইভাবে সামনের বছরগুলোতে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারার রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে নিষ্ঠাবান, দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির এই সময়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণের সংকট আমাদেরকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছিল। তারপরও দেশে খাদ্যঘাটতি না থাকায় তখন সংকটটা মোকাবিলা করা গেছে , দেশে করোনা চিকিৎসায় শূন্য থেকে অন্তত আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়ার মতো হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক কিছু অনুকূল আবহাওয়াগত পরিবেশ থাকায় মহামারিটি ইউরোপ, আমেরিকার মতো এখানে ব্যাপকভাবে ছড়ায়নি। করোনায় আমাদের মৃত্যু সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও অনেক মুল্যবান মানুষকে আমাদের হারাতে হয়েছে।
এছাড়াও করোনার ধাক্কা আমাদেরও জিডিপিতে নেতিবাচকভাবে কিছুটা হলেও পড়েছে। সবচাইতে বড় ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। এমনিতেই শিক্ষার মান নিয়ে আমাদের যথেষ্ট রকম অতৃপ্তি রয়েছে, তার ওপর এক বছর হতে চলল করোনার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ফিরতে পারছে না।
অনলাইন মাধ্যম হিসেবে আমাদের দেশে খুব একটা বিস্তার লাভ করতে পারেনি। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকগণ এই অবস্থায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। এর কিছু বহিঃপ্রকাশ সম্প্রতি রাস্তায় আন্দোলনে দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশে টিকাগ্রহণের উদ্যোগটি বিশ্বের অনেক দেশের চাইতেও আগে শুরু করতে পারার কারণে আশা করা যাচ্ছে দু-তিন মাসের মধ্যেই করোনার সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতে পারে। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার একটি প্রটোকল ঘোষণা করেছে। ফলে দু-তিন মাস পরে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে লেখাপড়ার পরিবেশ আবার ফিরে আনার চেষ্টা হবে- সেটি যেন কোনো অবস্থাতেই ব্যাহত না হয়, তা সকল মহলকে মনে রাখতে হবে। এমনিতেই গত এক বছরে করোনার কারণে যে সংকটের ঢেউ লেগেছে তাতে অনেকেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। এই সংকট অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক এই সংকট আমাদের এখানে নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে কর্মহারাদের অনেককেই যুক্ত হতে দেখা গেছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, জোর-জবরদস্তি এবং প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। ফলে সমাজজীবনে অস্থিরতার লক্ষণ বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। এটিকে মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তই নতুন অঘটন ঘটছে।
অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও চলছে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। ক্ষমতাশীন সরকারের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে ২০১৯ সালে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছিল সেটি এখন খুব একটা শোনা ও দেখা যাচ্ছে না। দলের অভ্যন্তরে নানা ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অপতৎপরতাও মাঝেমধ্যে প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি নোয়াখালি অঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে দেশব্যাপী যে তোলপাড় লক্ষ্ করা গেছে তা দলকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সেটি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কেন আগে থেকে রাশ টেনে ধরতে পারেননি সেই প্রশ্ন সকল মহলেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি দেশের অন্যত্র দৃশ্যমান না হলেও জেলা-উপজেলাগুলোতে গ্রুপিং, বিভাজন, এবং স্থানীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা ধরনের বিরোধ প্রকাশ্য হয়েছে। বেশ কজন নিহতও হয়েছেন। সুতরাং, ক্ষমতাশীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এখন যা চলছে তা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকে সাধারণ পর্যায়ে ক্ষুণ্ন করছে।
অপরদিকে, সরকার উৎখাতের নানা ধরনের হুংকার ও আলামত দেশে-বিদেশে বসে অনেকেই দিচ্ছেন। সেসব প্রচার-প্রচারণা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কতখানি প্রচার পাচ্ছে তা দেখার বিষয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরের এই সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি মহল উৎখাত ও ষড়যন্ত্রের যে প্রস্তুতি ও আহ্বানের কথা বলছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না, কিন্তু তাদের আত্মাহুতিকে আমরা সবাই মুখে শ্রদ্ধা করি, তাদের জীবন উৎসর্গের পেছনে যেসব মহৎ উদ্দেশ্য ছিল সেগুলোকে কতটা স্মরণ ও শ্রদ্ধা করছি সেটি ভেবে দেখার বিষয়।
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক, সমাজচিন্তক