হুমায়ুন আজাদ শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের মনের কোণে আলো ফেলতে পারতেন, চেতনার অলিন্দে লাল-নীল দীপাবলি জ্বালিয়ে দিতেন- এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা প্রিয় শিক্ষককে স্মরণ করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দিতেন। একইসঙ্গে দিয়েছেন উত্তরের দিকনির্দেশনা।
তিনি ‘ভালো থেকো’ কবিতায় লিখেছেন-
“ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।”
সবার ভালো তিনি চেয়েছেন। দেশের ভালো চেয়েছেন। এ কারণেই তিনি ধর্মান্ধ অপশক্তির টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। তাকে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে কেড়ে নিয়েছে এই গোষ্ঠী।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর তিনি একুশের গ্রন্থমেলা থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন। এ সময়েই তার ওপর ভয়ংকর হামলা হয়। কয়েক মাস পর জার্মানিতে তার মৃত্যু হয়। হামলার ধরন দেখে সহজেই ধারণা করা যায়- জেমএমবি কিংবা এ ধরনের কোনো ধর্মান্ধ ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রয়েছে এর পেছনে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাস লিখেছিলেন। এতে ধর্মের নামে যারা ভণ্ডামি করে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়। তাকে প্রাণে মারার হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে কিংবা পরিচিত-অপরিচিত সব স্থানে যেতেন অসম সাহসে। একুশের বইমেলায় দেখেছি ‘আগামী প্রকাশনীর’ স্টলে ‘নারী’, ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’, ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’, ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’- নিজের এসব বই পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন অটোগ্রাফসহ। তার বই কেনার জন্য বইয়ের স্টলের সামনে লম্বা লাইন পড়ে যেত।
এসব পছন্দ হয়নি সেই অপশক্তির, যারা ধর্মের নামে অধর্মের কাজ করে, ব্যবসা করে, মানুষকে কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয়। তারা তাকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিতে চেয়েছে। উন্মত্ত ঘাতকেরা তাকে অনেকটা প্রকাশ্যেই আক্রমণ করেছে। পিস্তল বা রিভলবারের গুলিতেও তারা আঘাত হানতে পারত, নিভৃত কোনো স্থানে। কিন্তু তাতে লেখককে যথেষ্ট যন্ত্রণা দেওয়া হয় না, মানুষকে সন্ত্রস্ত করা হয় না। এ কারণে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তিনি রক্তাক্ত হয়ে ছটফট করেছেন। বেঁচে থাকার আকুতি করেছেন। ঘাতকেরা বুক ফুলিয়ে চলে গেছে নির্ভয়ে, নিরাপদে আশ্রয়ে। তারা জানত, ক্ষমতাসীন খালেদা জিয়া সরকারের দিক থেকে কোনো ভয় নেই। বাংলাদেশে এ ধরনের অপশক্তির উত্থান ঘটছে- সেটা এ সরকার বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না। রাজশাহীর বাগমারায় শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের জেএমবি প্রকাশ্যে দাপট দেখাচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে, ‘ইসলামি হুকুমত কায়েমের’ কথা বলছে- কিন্তু খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য মতিউর রহমান নিজামী বলছেন- সব বানোয়াট, মিডিয়ার কল্পকাহিনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি হামলার পরদিন ঢাকার বাসাবো এলাকায় বিএনপির জনসভা ছিল, যেখানে বক্তব্য রেখেছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন- ‘বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি তারা দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছে। এই হরতাল সফল করার জন্য তাদের একটা ইস্যু দরকার। এ জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে।’ [যুগান্তর, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪]
হুমায়ুন আজাদের চিকিৎসা চলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে, সিএমইচ-এ। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সরকারি বাধার কারণে তাকে সেখানে দেখতে যেতে পারেননি।
কয়েক মাস পর ২০০৪ সালেরই ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আরও নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটে- শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং রাজধানী ঢাকার কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক সমবেত হয়েছিলেন একটি সমাবেশে। সেখানে চারদিক থেকে একযোগে গ্রেনেড হামলা চলে। শেখ হাসিনা স্প্লিন্টারের আঘাত পেয়েও বেঁচে যান। কিন্তু মহিলা নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে আহত হন। এ হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল তারেক রহমানের উপস্থিতিতে, কুখ্যাত ‘হাওয়া ভবনে’। অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল মুফতি হান্নানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘হুজি’। একটি রাজনৈতিক দলের সব নেতাকে একযোগে হত্যা করার ভয়ংকর এই অপরাধের পরও সে সময়ে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি নেতৃত্বের টনক নড়েনি। তারা এই হামলার দায়ভার চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগের ওপর।
হুমায়ুন আজাদের হত্যাচেষ্টার এক মাস যেতে না যেতেই ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের একটি সরকারি মালিকানাধীন সার কারখানার জেটিতে ১০ ট্রাক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র খালাস করার সময় ধরা পড়ে। এ জেটি ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে, যে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সহযোগী কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী। এসব অস্ত্র ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আসামের এক গোষ্ঠীর জন্য একটি দেশ থেকে চোরাইপথে আনা হয়েছিল। সে সময়ের বাংলাদেশ সরকার ছিল এই ‘ভয়ংকর খেলার’ অংশীদার।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের অপরাধের রেশ কাটতে না কাটতেই ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট শায়খ আবদুর রহমানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জেএমবি দেশের প্রায় ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায়। এ হামলার দায়ও আওয়ামী লীগের ওপর চাপানোর অপচেষ্টা চলে। সারা দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ যায়- আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তার কর। ঢাকায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মিছিল-সমাবেশ করে বলতে থাকে- ‘এ কাজ আওয়ামী লীগের।’ কিন্তু অপরাধ এত প্রকাশ্যে ঘটেছে এবং হামলা পরিচালনাকারী জেএমবি নিজেদের কৃতিত্ব প্রচারে এত ব্যাকুল হয়ে পড়ে যে আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা ছাড়া কোনো উপায় খালেদা জিয়ার ছিল না।
এরপর বিএনপির শাসনামলে ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরও কয়েকটি হামলা চালায়। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অভিলাষ ব্যক্ত করে প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ করতে থাকে। সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার প্রদান করে। দেশের ভেতর থেকে ও বাইরের কয়েকটি দেশ ভয়ংকর চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থানের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর ১৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে ধর্মান্ধ চরমপন্থী গোষ্ঠী তাদের তৎপরতা বন্ধ করেনি। বরং নানা পথ অনুসরণ করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে চলেছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজানে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা ছিল এ অপতৎপরতারই অংশ। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কিছু সফলতা অর্জন করেছে। তবে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। এ গোষ্ঠী বাংলাদেশকে তাদের কাজের উপযুক্ত স্থান মনে করছে এবং সেটা প্রকাশ্যেই বলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর একের পর এক আঘাত করার পরও তারা প্রকাশ্য সমাবেশ করে জন্মশতবর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপের ঔদ্ধত্য দেখাতে পারে। অতএব, কেবল সাবধান ও সতর্ক থাকা নয়, এ অপশক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তিনি আমাদের সবার ভালো থাকার জন্য কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যু নেই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলাম লেখক ও সাংবাদিকতায় একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত