এ কথা এখন অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যে দেশে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তি আছে। কথাটা খুবই সত্য ও ভয়ংকর। যে জাতি তার বীরদের শ্রদ্ধা করে না, সরকার পরিবর্তন হলেই বীর পরিবর্তন হয়; সে জাতির মতো অভাগা জাতি আর একটিও নেই। এ ধরনের অভাগা জাতি তার ভাগ্য পরিবর্তন করবে কীসের ওপর ভর করে? এ রকম হিংসা আর শত্রুতা নিয়ে কি দেশ গড়া যায়?
একই সঙ্গে এ কথাও তো বলতে হয় যে, ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধের আপাত সমাপ্তি ঘটেছিল, সে যুদ্ধ আসলে চলমান এবং সেই চলমান বিষয়ই ধীরে ধীরে পরাজিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকেই আবার প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে এই দেশে। আমাদের মাথার সামনের দিকে মনে হয় চোখ নেই, চোখ পিছনে; তাই কোনদিকে কীভাবে চলছি, সে ব্যাপারে আমাদের মনে প্রশ্নেরও উদয় হয় না। ফল হয় একটাই, দ্রুত পশ্চাৎপদ ভাবনার মধ্যে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়ে এক মহা সংকটের জন্য অপেক্ষা করা।
যে মূলমন্ত্র নিয়ে এ দেশে একদা মুক্তির সংগ্রাম হয়েছিল, সে মূলমন্ত্রগুলো জাতির সমবেত মস্তিষ্ক থেকে সমূলে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। শুধু প্রচারণা বা প্রচার দিয়ে তো আর সত্য প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সত্যিকার গভীরতা ও সত্য। মিথ্যাকে বা অর্ধমিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রকাশ করলে অধঃপাতে যাওয়া ছাড়া তো আর কিছুই থাকতে পারে না। তাই যারা অপরাধ করেছে, তাদের অপরাধগুলোকে তথ্যভিত্তিক করা, মানুষকে জানানো, কোন অপরাধের জন্য তাকে আমরা দোষী বলছি। তাদের ঘৃণ্য আদর্শের জন্য পৃথিবীজুড়ে যদি নাৎসি ও ফ্যাসিস্টদের অপরাধের কথা এখনও বলা হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এই ঘাতকেরা আর কতকাল তাদের নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে দেশবাসীর মায়া অর্জন করে যাবে? আমি কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, ‘আহা রে! কতদিন আগের কথা! ওদের ক্ষমা করে দিলেই তো হয়!’
ক্ষমা করে দিলে আসলে হয় না। মানুষকে খুন করা, তার ভিটেমাটি পুড়িয়ে দেওয়া, তাকে জাতিগতভাবে ঘৃণার শিকারে পরিণত করার সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল, তাদের জন্য জিরো টলারেন্সই একমাত্র সত্য। তা পালন করতে না পারলে পরবর্তীকালের নৃশংসতাগুলোও ক্ষমার আওতায় পড়ে যাবে।
এখানেই একটা কথা পরিষ্কার করে বলি, যেকোনো সরকারের সময় যেকোনো মানবতাবিরোধী কাজেরই বিচার হওয়া উচিত। জবাবদিহি না থাকলে রাষ্ট্র তার চরিত্র হারায়। না চাইলেও ফ্যাসিবাদ এসে জায়গা করে নেয় দেশের শ্বাস–প্রশ্বাসে। এ কারণেই আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া আদি পাপের বিচার জরুরি।
স্বাধীনতার পর কী করলে কী হতো, সে বিতর্কে এখন আর লাভ নেই। বরং এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই বিবেচনায় আনা উচিত।
যে সত্য আমরা জানি, তা নিয়েও কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের সময়মতো বিচার করা হয়নি বলে তারাই দেশের রাজ–কার্যাবলির সঙ্গেও যুক্ত হতে পেরেছিল একদা। বিএনপির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতায় এসেছিল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের দলের দুই ঘাতক এ দেশের মন্ত্রীও হয়েছিল। একে বিজয়ের পরাজয় বলে মনে হয়েছিল অনেকের কাছেই। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হলে আবার আশার আলো জ্বলে উঠেছিল মানুষের মনে। একাত্তরের ঘাতকদের মধ্যে যারা ছিল পালের গোদা, তাদের অনেকেরই বিচার হয়েছে। এদের একটা অংশ অবশ্য বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছে, ফলে তারা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি না পেয়েই পৃথিবী ছাড়তে পেরেছে।
দুর্ভাগা বাংলাদেশের কথাই বললাম। এবার সেই দুর্ভাগ্য যে আরও অনেকের জন্য প্রযোজ্য, সে কথা না বললে এই আলোচনাটি থেকে যে প্রশ্নটি উঠে আসবে, তা নিয়ে বিতর্ক করার মতো রসদ পাওয়া যাবে না।
২.
ঘাতকদের বিচারের ব্যাপারে আমরা প্রায়ই একটা উদাহরণ দিয়ে এসেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত নাৎসি আর ফ্যাসিস্টদের ব্যাপারে পৃথিবীর যেকোনো দেশে জিরো টলারেন্স দেখানো হয়। আমরা বলে এসেছি, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের কথা, টোকিও ট্রায়ালের কথা। সেসব অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়েই চলেছে আমাদের ঘাতকদের বিচারকাজ। কিন্তু একটি দিক রয়ে গেছে আমাদের চোখের আড়ালে। সত্যিই কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের হত্যাকারী নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট সদস্যদের ঘৃণার চোখেই দেখা হয়েছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার অঙ্গীকার কি বাস্তবায়িত হয়েছে?
আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রেও নাৎসিদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেখানে নাৎসিদের একটি অংশ মার্কিন অনুমতি নিয়েই সে দেশে ঢুকেছে, বহাল তবিয়তে সেখানে করে খাচ্ছে। ফলে নাৎসিদের ব্যাপারে যে সতর্ক ও ক্ষমাহীন দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়, সেটা একটা চক্ষুধোলাই কি না, কে জানে।
এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বার্থের কারণে নাৎসিদের ব্যাপারেও চোখ বন্ধ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এত যে হম্বিতম্বি, তারপরও পেশাদার, বুদ্ধিদীপ্ত নাৎসিদের নাগরিকত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়েছে তারা। সম্প্রতি নাৎসিদের নির্যাতন শিবিরের রক্ষী ফ্রিডরিখ কার্ল বারগারকে যুক্তরাষ্ট্র–ছাড়া করার পর অনেকেই সরকারকে বাহবা দিয়েছে। অনৈতিকভাবে এই নাৎসিদের তোষণ করার বদলে দেশছাড়া করার এই প্রক্রিয়া যেন চলতে থাকে, সে আশা পোষণ করছে মার্কিন নাগরিকদের সচেতন অংশটি। মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মন্টি উইলকিনসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশংসা করে বলেছেন, ‘আমেরিকা নৃশংস নাৎসিদের পালানোর জায়গা হতে পারে না।’
৩.
ঘটনাটি কী করে ঘটল?
এর সহজ উত্তর হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই পৃথিবী মার্কিনি ও সোভিয়েতদের মধ্যে যে ঠান্ডা যুদ্ধ দেখেছে। এই ঠান্ডা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য মার্কিনিরা অবাধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মার্কিন দেশে অবাধে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, জার্মান বাহিনীকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৪ লাখ মার্কিনি নিহত হয়েছে। এই বিষণ্ন ও শোকাহত ঘটনাবলির পর যা হওয়া উচিত ছিল, তা না হয়ে বরং নাৎসি তোষণ শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রে। নাৎসিদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠল দেশটি।
কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করলে কথাগুলো বোঝা সহজ হবে।
নাৎসি ও এসএস বাহিনীতে যারা ছিল, যারা নির্যাতন শিবিরগুলো পাহারায় ছিল, যারা নির্যাতনে অংশ নিয়েছে, এমনকি নাৎসি সরকারে ছিল, তাদের অনেকেই আশ্রয় পেয়েছে এই দেশটিতে। শুধু আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি মার্কিনিরা, তাদের যেন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়, সে ব্যবস্থাও করেছে।
এ কারণেই কেউ কেউ প্রশ্ন করেছে, ১৬১৯ সালে আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস বানিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের এই দেশে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে যে অন্যায় করা হয়েছে, সেগুলোর কাছে পৌঁছাতে হলে ১৯৪৫ সালের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। নইলে সত্যের নাগাল পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠবে।
এ কথা তো এখন আর অজানা নেই যে, তৃতীয় রাইখের ১২০ জন বিজ্ঞানীকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অপারেশন পেপারক্লিপ নামে তা পরিচিত ছিল। এই নাৎসি বিজ্ঞানীরা কাজ করেছিল নাসায়। এদের মধ্যে ফন ব্রাউনের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়।
যখন মার্কিনিরা চাঁদে অবতরণ করল, তখন ফন ব্রাউন আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা হয়ে উঠল সুপারস্টার। পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত সবাই তাদের তারিফ করতে শুরু করল।
এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, ফন ব্রাউন আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মূলত অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর এবং তারা প্রত্যেকেই রাজনীতির বলি। কখনওই না। তারা মহানন্দে হিটলারের হাতে তুলে দিয়েছিল রকেট, যা দিয়ে লন্ডনের শান্তিকামী মানুষদের হত্যা করেছিল নাৎসিরা। ধ্বংস করে দিয়েছিল বাড়ির পর বাড়ি, শহরের পর শহর। নির্যাতন শিবিরের বন্দিদের বাধ্য করা হয়েছিল এই রকেট বানানোর জন্য। সাক্ষী আছে, যারা বলেছে ফন ব্রাউন সেসব কারখানায় যেতেন। সেসব কারখানায় বন্দিদের অমানুষিকভাবে পেটানো হতো এবং ক্রীতদাসের মতোই তাদের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো। ফন ব্রাউন নিজেও বলেছেন, এসব বন্দির ইচ্ছার বিরুদ্ধে রকেট বানাতে বাধ্য করা হতো।
এই বিজ্ঞানীরা ছিলেন নাৎসি, কিন্তু মার্কিন সরকারের মাথায় ছিল মহাশূন্যের যুদ্ধে জয়ী হতে হবে তাদের। অন্যদিকে ব্রিটেন আর সোভিয়েত ইউনিয়নও তৃতীয় রাইখ থেকে কখনও কখনও পিস্তলের মুখেও বিজ্ঞানীদের তুলে এনেছে।
ইউক্রেনের দালাল ইয়ারোস্লাভ স্তেৎস্কো নাৎসিদের স্বাগত জানিয়ে কত ইহুদিকে হত্যা করেছে, এর হিসাব নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্তেৎস্কো লিখেছিলেন, জার্মানির আদলে ইউক্রেনের ইহুদিদের হত্যা করার অঙ্গীকারের কথা। তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানে ওয়াশিংটনের উচ্চশ্রেণির রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই ছিল তার দহরম মহরম। রোনাল্ড রিগ্যান ও জর্জ বুশ (সিনিয়র) তার মধ্যে দেখেছিলেন একজন তুখোড় কমিউনিস্ট–বিরোধীকে, আর তাতেই তারা ছিলেন আহ্লাদিত।
কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিপ্রায়েই পশ্চিমারা নাৎসিদের এতটা প্রশ্রয় দিয়েছে।
৪.
এতগুলো কথা বললাম হতাশা থেকে। রাজনীতির কারণে পৃথিবীর সর্বত্রই নৃশংস লোকেরা পার পেয়ে যায়। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে যদি কেউ পার পেয়ে যায়, তাহলে শান্তির সব হিসাব–নিকাশই পাল্টে যায়।
এ কারণেই যেকোনো অপরাধীকে আগে তার অপরাধী পরিচয়েই দেখতে হবে। সে কোন দল করে, সেটা দেখার দরকার নেই। বিচার বিভাগ কাজ করবে নিজের মতো। শাসক দল যেন কোনোভাবেই বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই এখন উগ্রবাদ আবার ঘনীভূত হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য ছলেবলেকৌশলে কী না করে যাচ্ছে শাসক দলগুলো! এই গভীর অসুখ থেকে বের হয়ে আসতে হলে আইনের শাসন খুব দরকারি।
এই মুহূর্তে সেটা পৃথিবীর আনাচ–কানাচে খুঁজে দেখলেও খুব একটা মিলছে না।
ঘাতকদের নিজের ছায়ায় রাখলে তা দৈত্য হয়ে ঘাড় মটকাবার জন্য প্রস্তুত হবেই।
লেখক: গবেষক, কলাম লেখক-সাংবাদিক