বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টিকায় বদলাচ্ছে প্রচলিত প্রেক্ষাপট

  • আমীন আল রশীদ   
  • ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১২:২৮

করোনায় ইউরোপ-আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোও যেখানে নাকানি-চুবানি খেয়েছে; অর্থনীতির বারোটা বেজেছে—সেখানে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি যথেষ্ট কম। এর প্রধান কারণ সরকারের, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা এবং তার দৃঢ়চেতা মনোবল। প্রথম দফাতেই বাংলাদেশ যে করোনার টিকা পেল, সেখানেও ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার ভূমিকাই মুখ্য।

২৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকালে করোনার টিকা নিতে যাই রাজধানীর শ্যামলিতে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে, যেটি মূলত পঙ্গু হাসপাতাল নামেই পরিচিত। আগে যেখানটায় আউটডোর ছিল, সেই জায়গাটি এখন টিকাকেন্দ্র। পরিপাটি। গোছানো। পরিচ্ছন্ন। কোনো ভিড় নেই। অনেকগুলো বুথ। ফলে টিকা নিতে যাওয়া মানুষের অপেক্ষায়ও দীর্ঘ নয়।

কেন্দ্রে ঢুকতেই শরীরের তাপমাত্রা মাপার পরে স্বেচ্ছাসেবক টিকা কার্ড পরীক্ষা করে পাঠিয়ে দেন নির্দিষ্ট বুথে। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কক্ষের ভেতরে গিয়ে টিকা গ্রহণ। সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। এরপর নার্সের পরামর্শ অনুযায়ী ৩০ মিনিট অপেক্ষা—যদি কোনো জটিলতা বা অসুস্থতা দেখা দেয়! যদিও টিকা নেয়ার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়া বা জটিলতার সম্মুখীন হওয়ার কথা এখনও সেভাবে শোনা যায়নি।

যারা কাজ করছেন, তারা রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী এবং এই কাজের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের আচরণ সুন্দর। মার্জিত। সব মিলিয়ে সরকারি হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে সাধারণ ধারণা বা কমন পারসেপশন ও অভিজ্ঞতা—তার সঙ্গে করোনার টিকা ব্যবস্থাপনার এই চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ফলে প্রশ্ন হলো, হাসপাতালটির এই জায়গাটিতে কিছুদিন আগেও যে আউটডোর ছিল, সেখানে কেন এমন পরিচ্ছন্নতা, এমন সুন্দর সেবা, কর্মীদের এমন আন্তরিকতা ছিল না? টিকাকেন্দ্রে যারা কাজ করছেন, তারা তো অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসেননি। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? টিকাকেন্দ্রের এই ব্যবস্থাপনা দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কেন প্রতিনিধিত্ব করে না?

এর মূল কারণ করোনার টিকাব্যবস্থাপনাটি সরকারের অগ্রাধিকার কর্মসূচি এবং যেহেতু করোনা একটি বৈশ্বিক মহামারি, ফলে এই সংকট বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করছে, তার দিকে পুরো বিশ্বের নজর রয়েছে। দ্বিতীয়ত, করোনার শুরু থেকেই এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানারকম তর্ক-বিতর্ক এবং রাজনীতির মাঠ ঘোলা হয়েছে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগেরও শেষ নেই। ফলে করোনা ব্যবস্থাপনার কোথাও ন্যূনতম কোনো ত্রুটি থাকলে সেটি সরকারের বিরোধীপক্ষের জন্য যে বড় ইস্যু হবে—সরকার সেটি জানে। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে টিকা ব্যবস্থাপনায় সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টি রয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রথম দফায় বিশ্বের হাতে গোণা যে কটি দেশ করোনার টিকা পেয়েছে, বাংলাদেশ সেই সামান্য সংখ্যক দেশের একটি। নিশ্চয়ই এটি বর্তমান সরকারের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। টিকা নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে এখনও জনমনে যে কিছুটা অনাস্থা রয়ে গেছে, তার মূল কারণ টিকা নিয়ে প্রচারের চেয়ে অপপ্রচার বেশি হয়েছে। অনেকে এটিকে রাজনৈতিক ইস্যুও করতে চেয়েছেন। ফলে শত ভাগ মানুষ এখনও এই টিকার ব্যাপারে আস্থাবান নন। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেও এ কথা বলা যায়, করোনায় ইউরোপ-আমেরিকার শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোও যেখানে নাকানি-চুবানি খেয়েছে; অর্থনীতির বারোটা বেজেছে—সেখানে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি যথেষ্ট কম। এর প্রধান কারণ সরকারের, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা এবং তার দৃঢ়চেতা মনোবল। প্রথম দফাতেই বাংলাদেশ যে করোনার টিকা পেল, সেখানেও ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার ভূমিকাই মুখ্য। বিশ্বকেও এটি দেখানোর প্রয়োজন ছিল যে, বাংলাদেশ করোনার টিকা শুধু আগে পেয়েছে তাই নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নাগরিকদের টিকা প্রয়োগের সক্ষমতাও বাংলাদেশের রয়েছে।

সুতরাং, যে দেশ এরকম একটি প্যানডেমিক বা অতিমারির ব্যবস্থাপনায় উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে, সেই দেশের হাসপাতালে গিয়ে মানুষ সেবা পাবে না; হয়রানির শিকার হবে; দালালের খপ্পরে পড়ে জানমাল খোয়াবে; জনগণের করের পয়সায় কেনা ওষুধ লুটপাট হয়ে যাবে; বালিশকাণ্ড ঘটবে—তা মেনে নেয়া যায় না। যে দেশ করোনার টিকাব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে রাতারাতি হাসপাতালের একটি অংশের চেহারা বদলে দিতে পারে, সেই দেশ নিশ্চয়ই হাসপাতালের অন্যান্য অংশেও একইরকম পরিবর্তন আনতে পারে।

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে নাগরিকদের ক্ষোভ ও প্রশ্নের শেষ নেই। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী ধরে আমরা স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাব্যবস্থার নামে কী গড়ে তুলেছি, সেটি করোনার মতো একটি অণুজীব এসে সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে মরে যাওয়ার একাধিক ঘটনা সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।

করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকেই দাবি উঠছিল স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। হয়েছেও তাই। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা বাজেটের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বরাদ্দকৃত অর্থ কোথায় কীভাবে খরচ হয়, সেটির খবর কি সাধারণ মানুষ জানে? বড় কোনো অনিয়ম দুর্নীতির খবর সংবাদমাধ্যমে না আসার আগে সেসব চোখের আড়ালেই থাকে। সাহেদ-সাবরিনার মতো কিছু লোক ধরা পড়েছেন। কিন্তু তারা কীভাবে অন্যায় করলেন, কাদের যোগসাজসে করলেন, কারা প্রশ্রয় দিয়েছেন—তার সঠিক ও নির্মোহ তদন্ত হয়েছে? শুধু সাহেদ-সাবরিনার নাম জানা গেছে। নাম না জানা এরকম মাফিয়ার সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের অনেক ‍গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও রয়েছেন। ধরা না পড়ার আগপর্যন্ত তারা সাধু।

গত অর্ধ শতাব্দীতে যারা সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় বড় পদে ছিলেন, তারা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে আসলে কী করেছেন; বেসরকারি খাতে যে বড় বড় হাসপাতালের অনুমোদন দেওয়া হলো, সেগুলো হাসপাতাল না কসাইখানা—কী হিসেবে গড়ে উঠলো, রাষ্ট্র সেটি কোনোদিন খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছে? নাকি ঠিকাদারের তালিকা অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার কেনাকাটা এবং সেই টাকার ভাগ নেয়া আর সুন্দর সুন্দর ভবন নির্মাণকেই আমরা স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন হিসেবে ধরে নিয়েছি?

এতসব প্রশ্নের মধ্যে করোনার টিকাকেন্দ্র ব্যবস্থাপনার মতো ঘটনাগুলো আমাদের আশাবাদী করে। সেই আশাবাদে ভর করেই দেশবাসীর প্রত্যাশা, টিকাকেন্দ্রের মতোই বদলে যাবে দেশের সকল সরকারি হাসপাতালের জরুরি ও বহিঃবিভাগ, অপারেশন থিয়েটার, বেড ও কেবিনের চিত্র। রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকদের মতোই আন্তরিকভাবে সেবা দেবেন জনগণের করের পয়সায় বেতন হওয়া হাসপাতালের ডাক্তার, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। যদিও কাজটি খুব সহজ নয়। বছরের পর বছর ধরে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যে অনিয়ম ও দুর্নীতির দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে, যে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বীজ এখন বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, তার শেকড় একদিনে উপড়ে ফেলা যাবে না। কিন্তু করোনার টিকাব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যে পরির্তনটি দৃশ্যমান হলো, সেটিকে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থায় পরিবর্তনের একটি শুভসূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর