বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যে কথা যায় না ভোলা

  • মাহবুব-উল-আলম খান   
  • ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৭:৩১

১৯৭২ সালের অনুরূপ ঘটনা পুনরায় জাতি দেখতে পেল ২০২০ সালে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের সেদিনের সেই বিধ্বস্ত, স্বামী পরিত্যক্তা খালেদা জিয়াকে স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের কন্যার মর্যাদা দিয়ে। জাতির পিতা হয়তো ভাবতে পারেননি খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় ১৯৭১-এর ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তিনি তার বিরাট হৃদয় দিয়ে, মহানুভবতা দিয়ে খালেদার সংসার রক্ষা করেছেন। বিপরীতে খালেদা জাতির পিতা নিহতের পর কী কর্মকাণ্ড করেছেন দেশবাসীকে আর নতুন করে বলতে হবে না। যাহোক, খালেদা জিয়ার ভাইবোন আত্মীয়স্বজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর মানবতার মাতা দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ ক্ষমতায় এই দাগী সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে জামিন দিতে সরকারের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন। অবশেষে গত ২৫ মার্চ ২০২০ সাজাপ্রাপ্ত এই আসামি জামিনে মুক্তি পেলেন।

স্বাধীনতার পর জামায়াতসহ সকল স্বাধীনতাবিরোধী দলই নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু জাতির পিতাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যার পর ইতিহাসের চাকা পালটে দেয়া হয়। কায়েমি স্বার্থবাদী দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী ও স্বাধীনতার শত্রুরা স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যা করেছে অত্যন্ত নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ফজরের আজানের আগে ঘাতকেরা তাকে হত্যা করে। প্রকৃতি সেদিন আঝোর ধারায় কেঁদেছিল। আমরা স্তম্ভিত, বিহ্বল ছিলাম। মানবতার এহেন অবমাননা ইতিহাসে ইতিপূর্বে আর ঘটেনি। এই হত্যাকাণ্ড কারবালাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

সেই থেকেই এ দেশে রাজনীতি কলুষিতকরণ শুরু। এই ঘটনার মূল নায়ক ইতিহাসের দুই মীরজাফর খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান। তিন মাসের মধ্যেই আসল নায়ক জিয়াউর রহমান মোশতাককে নিক্ষিপ্ত করেন অন্ধকারে। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগ করিয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে খলনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি কায়দায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জাতির পিতাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান সকল স্বাধীনতাবিরোধীকে ক্ষমা করে দেন। রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। স্বাধীনতাবিরোধী সকল শক্তি সগৌরবে ফিরে আসে। পাকিস্তানি দালাল শাহ্ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। রাজাকার মওলানা মান্নান, আলীম, রাজাকার চখা মিয়াসহ বহু দালাল রাজাকার পুনর্বাসিত হয় এবং অনেককে মন্ত্রী করা হয়। এভাবেই স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো পুনর্বাসিত হয়। কুখ্যাত দালাল পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির সভাপতি গোলম আযমসহ অনেক দালাল পলাতক অবস্থা থেকে ফিরে আসে। তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। সকল যুদ্ধাপরাধী, দালাল, রাজাকার মুক্ত হয়। দুই মীরজাফর মোশতাক ও জিয়া আগস্ট ১৯৭৫ থেকে মে, ১৯৮১ পর্যন্ত দেশ শাসন ও শোষণ করে।

১৯৮১ সালের ৩১ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন। বিচারপতি সাত্তার অতঃপর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বছর খানেকের মধ্যেই বিচারপতি সাত্তার নিজ দলের নানাবিধ দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। এরশাদ ৯ বছর দেশ শাসন ও শোষণ করেন। সামরিক শাসকেরা যুগে যুগে দেশে দেশে এভাবেই এসেছেন আবার গেছেন। পাকিস্তান এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সামরিক শাসক এরশাদ দেশ শাসনকালে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা পদ্ধতি গ্রহণ উল্লেখযোগ্য। উপজেলা পদ্ধতি এখন স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। তিনিও ছলেবলে কলা-কৌশলে দালাল, রাজাকার, ডান, বাম রাজনীতিবিদদের দিয়ে রাজনীতি কলুষিত করেছেন। জিয়া ও এরশাদ দুজনেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। জিয়া বলেছিলেন, “I will make politics difficult for the politicians. Money is no problem.” মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, চিন্তাচেতনা তিনি ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এভাবেই দুই সামরিক শাসক স্বাধীনতার শিশু বয়সেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন। ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এভাবেই অনেক রক্ত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতার মূল্যবোধ ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুগে যুগে দেশে দেশে সামরিক শাসকেরা এভাবেই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এরশাদের শাসনামলের শেষ দিকে নব্বইয়ের তুমুল গণ-আন্দোলনে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।

পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচনে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপি নেত্রী অবিশ্বাস্যভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। স্বশিক্ষিত খালেদার বিজয় ছিল এক বিস্ময়। তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশ শাসন করেছেন। তার দোসর হলেন একাত্তরের পরাজিত জামায়াত-শিবির, মুসলিম লীগসহ সকল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তিন জোটের রূপরেখাকে অমান্য করে মেয়াদ শেষে ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে তিনি একটি একক নির্বাচন করে দুই মাসও টিকতে পারেননি। পদত্যাগে বাধ্য হয়ে স্বশিক্ষিত খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন।

জুন ১৯৯৬ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।

১৯৭৫ থেকে জুন ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশ চলেছে সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারায়। জিয়া-এরশাদ-খালেদা একই ধারায় দেশ শাসন করেছেন। ২৩ জুন ১৯৯৬ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন। শুরু হলো নতুন এক জয়যাত্রা। জনগণ স্বাধীনতার সুফল পেতে শুরু করল। উন্নয়নের ধারা সূচিত হলো। কৃষি, শিক্ষা, যোগযোগ, খাদ্য, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি ও নানাবিধ উন্নয়নে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত থেকে//// লাগল। বিএনপি-জামায়াত আমলে যেখানে লোডশেডিংয়ে মানুষ ছিল বিপর্যস্ত, আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে জনগণকে স্বস্তি দিতে সমর্থ হলো। বিএনপি আমলে বিদ্যুতের দাবির জন্য কানসাটে ১৮ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কৃষককে সারের দাবির জন্যও প্রাণ দিতে হয়।

২০০১ সালে মেয়াদান্তে নতুন নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল প্রায় ৫০০০ মেগাওয়াট। আমি তখন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম-সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আর সচিব ছিলেন ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী; আজকের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা।

২০০১-এর নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের নীল নকশায় আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে হারিয়ে দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শুরু হলো এক বিভীষিকাময় দুঃশাসন। এহেন দুষ্ট, নষ্ট ও দুর্নীতিবাজ সরকার পৃথিবীতে আর কখনও ছিল কি না, আছে কি না জানা নেই। দুর্নীতি, হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও সম্পদ পাচার ছিল তাদের আদর্শ। ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে ১০০ দিনের ক্রাশপ্রোগ্রাম হাতে নিয়ে যে অত্যাচার, অবিচার, অন্যায়, জুলুম, হত্যা, সন্ত্রাস ও ধর্ষণ তারা এ দেশের জনগণের ওপর চালিয়েছে, এর নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। এদের অত্যাচারে শত পূর্ণিমা, মহিমা, ফাহিমার ক্রন্দনে আজও এ দেশের আকাশ-বাতাস কাঁদে। এই রাজাকার সরকারের শত্রু ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। এই জালেম সরকার শত শত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের অকারণে চাকরিচ্যুত করেছে। প্রশাসনকে স্থবির করেছে। বিএনপি-জামায়াতসমৃদ্ধ রাজাকার আলবদরের সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য ‘হাওয়া ভবন’ ও ‘খোয়াব ভবন’ নামে দুটি দুর্নীতির কারখানা সৃষ্টি করে। এহেন অপকর্ম নেই যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাদের লুণ্ঠিত সম্পদের সামান্য অংশ সিঙ্গাপুর আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তার সন্তানদের সাজাও হয়। তার ছোট ছেলে দুর্নীতির এই বরপুত্র মৃত্যুবরণ করে বেঁচে গেছে। অবশ্য লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা মালয়েশিয়া, লন্ডনে সুখে কালাতিপাত করছে। জীবিত থাকলে হয়তো আরও অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যেত। মহা দুর্নীতিবাজ তারেকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআই এসে সাক্ষ্যও দিয়ে যায়। তারেক দুর্নীতি ও নানাবিধ অপকর্মের মূর্ত প্রতীক। নানা অপরাধে এই অপরাধী আজ আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এক পলাতক আসামি। এই আসামি ১/১১-এর সরকারের সময় মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে লন্ডন পালিয়েছিল। লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে সে আজ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মহাসুখে লন্ডনে কালাতিপাত করছে। সে এখন নাকি ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত। কানাডার উচ্চ আদালতের রায়ে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারেক এক বিপজ্জনক ও ভয়ংকর ব্যক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই তালিকাভুক্ত করেছে। তাই তার যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকাও নিষিদ্ধ। এ মর্মে যুক্তরাজ্যকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। খালেদা জিয়া মধ্যপ্রাচ্য ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কত সম্পদ পাচার করেছেন এর হিসাব কে দেবে? ২০০১-২০০৬ সালে ক্ষমতাকালে সৌদি আরব ভ্রমণকালে শত সুটকেস ভর্তি সম্পদ, অর্থ পাচার এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই ছবি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। খালেদা জিয়া তার ভাই সাঈদ ইস্কান্দার ও নিকট আত্মীয়স্বজন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসব তথ্যাদি এসেছে (সমকাল ২৪.১০.২০০৯)।

বিদেশে জিয়া পরিবারের সম্পদ নিয়ে তদন্ত চলছে। গ্লোবাল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনে বিএনপি চেয়ারপারসন থেকে আরম্ভ করে তার পরিবারের সদস্যদের অফুরন্ত সম্পদের বিবরণী আছে (১৪.০৯.২০১৭, প্রথম আলো)। এই প্রতিবেদনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ অনেক নেতা-নেত্রীর অবৈধ সম্পদের বিবরণীও আছে। খালেদা জিয়া ও তার দলের অনেক নেতা-কর্মী অবৈধ উপার্জনের অর্থের জন্য জরিমানা দিয়ে কর পরিশোধ করেছেন। তাইতো ২০০১-২০০৬ কালে বিএনপি সরকার বিশ্বে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিগত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ নির্বাচনের আগে তারেক রহমানের লন্ডনে বসে শত শত কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য এ দেশে কারও অজানা নেই। তখন স্লোগান উঠেছিল ‘টাকা গেল লন্ডনে, হামলা কেন পল্টনে আর গুলশানে’? এভাবেই সামরিক শাসক জিয়া, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও ছেলে তারেক জিয়া দেশকে দুর্নীতিতে বারবার চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন। দলের চেয়ারপারসন, তার ছেলে ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-নেত্রী একেকজন আন্তর্জাতিক কুখ্যাতিসম্পন্ন দুর্নীতিবাজ। পাকিস্তানের সেই সেনা কর্মকর্তারা জেনারেল জানজুয়া ইত্যাদি যারা ১৯৭১ সালে ক্যান্টনমেন্টে খালেদা জিয়াকে তাদের আতিথেয়তায় সুখে রেখেছেন, তারা বেঁচে থাকলে আজ জোরে হাততালি দিতেন। তাইতো এককালের বিএনপি নেতা কর্নেল অলি এই বলে বোমা ফাটালেন; মা ভালো হলে ছেলে খারাপ হবে কেন, দুটোই বদমাশ। যুক্তরাষ্ট্রের এক সভায় তিনি এহেন বক্তব্য রাখেন (২০.০৬.২০০৬, সংবাদ)।

২০০৬ সালে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে কর্নেল অলির বক্তব্য দেশবাসী আজ যথার্থই উপলব্ধি করছে।

১৯৯১ সালে ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এতিমদের অনুদানের জন্য ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার ২১৬ টাকা গ্রহণ করেন। প্রাপ্ত টাকা এতিমদের জন্য খরচ না করে তারেক, কোকো ও মমিনুরের সমন্বয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেন, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এই দুর্নীতির জন্য বিগত ১/১১-এর সরকারের সময় ৩.৭.২০০৮ তারিখে এজাহার দায়ের করা হয়। আসামি খালেদা জিয়া বারবার উচ্চ আদালতে বিভিন্ন অজুহাতে আপিল করে মামলার কার্যক্রম ব্যাহত ও সময়ক্ষেপণ করেন। বিচারক বদলের আবেদনও মঞ্জুর করা হয় কয়েকবার। দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি মামলা চলার পর মহামান্য আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছে। প্রায় দুই বছরের বেশি তিনি জেলজীবন ভোগ করছেন। তার জামিনের জন্য বারবার উচ্চ আদালতে ধরনা দিয়েও আদালত জামিন দিতে পারেনি। ন্যায়বিচারের কোনো ধারায়ই উচ্চ আদালত তাকে জামিন দিতে পারেনি। অবশ্য তিনি জেলজীবনের বেশির ভাগ সময়েই বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জেলে তাকে যত প্রকার সুবিধা দেয়া হয়েছে, পৃথিবীতে আর কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামি এত বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন বলে কোনো নজির নেই। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন ভাগ্যবতী মহিলা।

১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন ৯ মাস ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর অতিথি হিসেবে আয়েশে জীবন কাটিয়েছেন। জিয়াউর রহমান বারবার চেষ্টা করেও তাকে কাছে নিতে পারেননি। যাদেরকে নেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে অপমান করে বলেছেন, ‘ওই গাদ্দার জিয়ার কাছে আমি যাব না।’ দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায় তিনি ৯ মাস আরাম আয়েশেই ছিলেন। আরাম ও সুখ ছাড়তে রাজি হননি। পাকিস্তানি মানুষরূপী পশুদের সঙ্গে তিনি স্বেচ্ছায় ৯ মাস কাটিয়েছেন। তার জীবনের ভয় ছিল না।

স্বাধীনতার পর যখন তিনি ঘরে উঠতে চাইলেন, জিয়া তাকে ঘরে উঠতে দেননি। গালি দিয়ে বের করেছেন। খালেদা জিয়া সেদিন ৩২ নম্বরের বাসায় জাতির পিতার শরণাপন্ন হন। সেদিন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় এই মহিলা নতুন জীবন ফিরে পান। জাতির পিতা খালেদাকে নিজ কন্যার মর্যাদা দিয়ে জিয়ার হাতে তুলে দেন। জাতির পিতার ধমকে জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হন। সেই থেকে এই খালেদা জিয়া নতুন করে বাঁচতে পারলেন। বঙ্গবন্ধুর যদি ১৯৭১ সালে ফাঁসি হয়ে যেত, বাংলাদেশে না আসতে পারতেন তাহলে খালেদা জিয়া আজ কোথায় থাকতেন? পাকিস্তান না কোথায়, জানি না। জাতির পিতার মহানুভবতায় তিনি সেদিন নতুন করে বাঁচতে পেরেছিলেন।

খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভুলে গেলেন পিতৃঋণ। পরবর্তীকালে তিনি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতার হত্যা দিবসকে নিজের ভুয়া জন্মদিন হিসেবে পালন করেন। কোনো অকৃতজ্ঞ, অসভ্য বর্বরের পক্ষেও এহেন কর্মকাণ্ড সম্ভব হবে কি না জানি না। নিজের সারা জীবনের অশুভ কর্মকাণ্ডের জন্য, দুনীতির জন্য, এতিমের টাকা আত্মসাতের জন্য উচ্চ আদালত তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। ইসলাম ধর্মের বিধানে একজন মুসলমানের এতিমের অর্থ আত্মসাৎ মহাপাপ। শেখ হাসিনার সরকার এহেন একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জেলে প্রাপ্যতার বাইরে সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। উচ্চ আদালত তার কৃত অপরাধ, দুর্নীতির জন্য জামিন দিতে পারেননি। তার আইনজীবীরা শত চেষ্টা করেও আইনের কোনো ধারায়ই এই দুর্নীতিবাজকে মুক্ত করতে পারেননি। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে, এটাই অমোঘ নিয়তি। অবশেষে তার নিকট আত্মীয়-স্বজন, ভাইবোন সরকারের শরণাপন্ন হলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।

১৯৭২ সালের অনুরূপ ঘটনা পুনরায় জাতি দেখতে পেল ২০২০ সালে। জাতির পিতা ১৯৭২ সালের সেদিনের সেই বিধ্বস্ত, স্বামী পরিত্যক্তা খালেদা জিয়াকে স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের কন্যার মর্যাদা দিয়ে। জাতির পিতা হয়তো ভাবতে পারেননি খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় ১৯৭১-এর ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তিনি তার বিরাট হৃদয় দিয়ে, মহানুভবতা দিয়ে খালেদার সংসার রক্ষা করেছেন। বিপরীতে খালেদা জাতির পিতা নিহতের পর কী কর্মকাণ্ড করেছেন দেশবাসীকে আর নতুন করে বলতে হবে না।

যাহোক, খালেদা জিয়ার ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর মানবতার মাতা দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ ক্ষমতায় এই দাগী সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে জামিন দিতে সরকারের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন। অবশেষে গত ২৫ মার্চ ২০২০ সাজাপ্রাপ্ত এই আসামি জামিনে মুক্তি পেলেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বাইরে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ ক্ষমতায় নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিলেন। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। অথচ এই খালেদা জিয়া তার বিপজ্জনক ছেলে তারেক জিয়া বিএনপি-জামায়াত সরকার তাকে হত্যার জন্য ২০বার প্রচেষ্টা চালায়। বারবার তিনি অলৌকিভাবে বেঁচে যান। সর্বশেষ ২১ আগস্ট ২০০৪-এর ঘটনা নতুন করে বলার আর কিছু নেই। সেদিন তাদের বিশেষ করে হাওয়া ভবনের পরিকল্পনায় ছিল আর একটি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বিধাতার অশেষ রহমতে হয়তো শেখ হাসিনা সেদিন বাঁচতে পেরেছিলেন। পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে সেদিন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “উনাকে আবার কে মারতে যাবে। ভ্যানিটি ব্যাগে করে তিনিই গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন।” আজ যখন সব সত্য প্রকাশিত হয়েছে, এখন তিনি কী বলবেন? সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এই হত্যায় জড়িতের জন্য খালেদার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরসহ আরও ১৯ জনের ফাঁসি হয়েছে। তার সন্তান তারেক জিয়াসহ আরও ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সেদিনের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং শত শত নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন। অনেকের শরীরে এখনও স্প্লিন্টার রয়েছে, তারা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। শরীরের স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, সাবেক সফল মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। খালেদা জিয়া এই অপরাধ কি অস্বীকার করতে পারবেন?

১৯৭২ সালে খালেদা জিয়া নতুন জীবন পেয়েছিলেন জাতির পিতার মহানুভবতায়; আবার ২০২০ সালে দুর্নীতির জন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার মহানুভবতায়ই সরকারের বিশেষ ক্ষমায় জামিন পেলেন। আদালত তাকে কোনো বিবেচনায়ই জামিন দিতে পারেননি। বিধাতার কী অপরূপ খেলা!

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সচিব

এ বিভাগের আরো খবর