বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মাতৃভাষার চেতনা নিয়ে ভাবনা

  • মামুনুর রশীদ   
  • ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৫:৩২

একসময় স্বৈরাচারের পতন হয়, কিন্তু শহীদমিনারের ওপর রাজনৈতিক দখলদারী নতুনভাবে শুরু হয়। এর মধ্যে দীর্ঘ পনেরো বছরের সামরিক শাসনের সময় অনেক নতুন উপাদান ঢুকে যায়। সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু করার যে বার্তা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে এসেছিল, এর রং ধূসর হয়ে ইংরেজির রংটা উজ্জ্বলতর হতে থাকে।

১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে শীতের তীব্রতা কিছুটা কমলেও শীতটা মার্চ মাস পর্যন্ত থেকে যেতো। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রথম দাঁতের ব্যথা শুরু হয়। মায়ের কোলে কাঁদতে কাঁদতে মামা বাড়ির স্কুল-ঘরের সামনে গিয়েছিলাম। আমার কান্না থামাতে থামাতে আমার অষ্টাদশবর্ষীয়া মা স্কুল-ঘরের সামনে এসে পড়েছিলেন। আমার ছোট মামা তখন জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই।

এরপর ছোটবেলার ২১ পালনের আর কোনো স্মৃতি আমার নেই। বাবা সরকারি চাকরি করতেন ছোট ছোট থানা শহরে। সেগুলোকে শহর বলা যায় না একটু বড় গ্রাম। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় আবার শহর-গ্রাম জেগে উঠেছিল কিন্তু ২১ পালন তেমন একটা হতো না। শুনেছি ঢাকায় এবং বড় শহরগুলোতে প্রভাতফেরি হতো। বুকে থাকতো কালো ব্যাজ। ষাটের দশকে সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় ২১ পালনের পরিধি বাড়তে থাকে। উনসত্তর থেকে একাত্তর সাল পর্যন্ত ২১ পালনের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এর আগে পয়লা বৈশাখ উদযাপনও শুরু হয়। পয়লা বৈশাখের মেলা অবশ্য তারও বহু আগের ঘটনা। আমাদের সেই বাল্যকালে গ্রামে গ্রামে বৈশাখের মেলা বসতো, সারাদিন নানা ধরনের মুড়ি-মুড়কি, হালচাষের যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় সামগ্রী বেচাকেনা হতো। কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে কেমন করে যেন বিকেল বেলায় কালবৈশাখী হয়ে সব ভেঙে চুরমার করে দিতো। ষাটের দশকে ২১ পালন বাঙালির জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের কালে এই মাত্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কালে কালে তা এক পালনীয় বিষয় রূপ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ পালন এবং তার সঙ্গে সৃজনশীলতার সর্ম্পকও গড়ে ওঠে, বিশেষ করে একুশে বইমেলা যখন থেকে শুরু হয়। প্রথমে লেখকদের কাছে এবং পরে পাঠকদের কাছেও একুশের বইমেলার জন্যে অপেক্ষা একটা বাৎসরিক ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

পরবর্তী সময়ে সম্ভবত আশির দশকের গোড়ার দিকে প্রভাতফেরির স্থান দখল করে পশ্চিমা নিয়ম। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন গণনা শুরু হয় ২০ তারিখ রাত বারোটার পর থেকে। শহীদমিনারে কে আগে ফুল দেবে তা নিয়ে একটা তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতা ধাক্কা-ধাক্কি, ধস্তাধস্তি এবং শেষ পর্যন্ত মারামারিতে গিয়েও শেষ হয়েছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর থেকে রাত বারোটায় আর শহীদমিনারে যাওয়া হয়নি।

সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে শহীদমিনারেও কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে। নানা ধরনের প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের কেন্দ্রভূমি হয়ে দাঁড়ায় শহীদমিনার।

একসময় স্বৈরাচারের পতন হয়, কিন্তু শহীদমিনারের ওপর রাজনৈতিক দখলদারী নতুনভাবে শুরু হয়। এর মধ্যে দীর্ঘ পনেরো বছরের সামরিক শাসনের সময় অনেক নতুন উপাদান ঢুকে যায়। সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু করার যে বার্তা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে এসেছিল, এর রং ধূসর হয়ে ইংরেজির রংটা উজ্জ্বলতর হতে থাকে। ইংরেজি স্কুলের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর ধনাঢ্য, রাজনৈতিক নেতা, আমলার সন্তানরা শিক্ষার জন্যে বিদেশে পাড়ি জমাতে থাকে। কোটি কোটি টাকা লগ্নি হতে থাকে ইংরেজি শিক্ষা এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে। ও লেভেল, এ লেভেল পরীক্ষার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। গ্রামের স্কুল বা কলেজগুলোতে ভালো শিক্ষক পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। ইংরেজি ও বাংলা দু’টি ভাষারই ভালো শিক্ষক পাওয়া দুষ্কর হওয়ার কারণে শিক্ষার মান ক্রমানবতির দিকে ধাবিত হয়। যাদের প্রবল ইংরেজিপ্রীতি তাদের কোনো ধরনের দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ থাকে না। সাধারণভাবেই তারা বিদেশে পাড়ি জমায়। সঙ্গে করে নিয়ে যায় দেশে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ। এই সময়ে মনে হয় বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে আরও একটি ভাষা আন্দোলন প্রয়োজন।

ইতোমধ্যে পৃথিবীর দরিদ্র এবং ছোট রাষ্ট্রগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্যে সদাপ্রস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতার সংগ্রামে যে রাষ্ট্রটি সর্বদা এই দায়িত্বটি পালন করতো প্রথমে নিজেদের মধ্যে ভাঙন এবং পরে তাদের সমমনা রাষ্ট্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

গ্লোবাল ভিলেজের নামে একচেটিয়া পুঁজির দৌড়াত্ম্য যেকোনো জাতির সংস্কৃতিকে আঘাত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী ইউরোপীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে সারা পৃথিবীকে প্রভাবিত করে ফেলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সেই রাষ্ট্রগুলোও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুটোতেই আর জনগণের অধিকার থাকে না, পণ্য হয়ে পড়ে। শিক্ষা নামের এই পণ্যটি কেনার ক্ষমতা তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের নেই। তাই দুর্বল বিদ্যালয়গুলো থেকে দুর্বল ছাত্ররাই বেরিয়ে আসে। এই অবস্থায় ভাষা শিক্ষাটাই প্রথমে আক্রান্ত হয়। নিজের ভাবনাকে কথায় এবং লেখায় প্রকাশ করার যে দক্ষতা প্রয়োজন তার জন্যে বিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে তা নিতান্তই দুর্বল। এই বিষয়টি একটি মানুষের সারা জীবনকে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ফেলে দেয়। এর মধ্যে শিক্ষার উপর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়। এই নিরীক্ষার একটা বড় অংশ সৃজনশীল নামের একটি শিক্ষাপদ্ধতি । এই পদ্ধতিতে যেকোনো বিষয়ে আত্মস্থ করার বিনিময়ে শুধু মুখস্থ বিদ্যা হলে কাজ চলে যায়। এই এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতিতে দেশের সর্বোচ্চ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চাকরির পরীক্ষাও পরিচালিত হয়ে থাকে। দেশের প্রশাসনিক কাজে যারা নিয়োজিত তাদের নিয়োগের জন্যে এই পরীক্ষা পদ্ধতি একেবারেই সমীচীন নয়। দেখা যায় মূল বিষয় না বুঝে শুধু রাত-দিন মুখস্থ করে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একেবারেই সাধারণ মানের কোনো শিক্ষার্থী এখানে উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারের মেধাবী ছাত্রটি প্রাথমিক পরীক্ষায়ই বাদ পড়ে যায়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দেশের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে নূন্যতম দেশপ্রেমও থাকছে না। ভাষা হিসেবে বাংলার যে উন্নতমান এবং সাহিত্য হিসেবে পৃথিবীর অনেক ভাষার চাইতেও এগিয়ে। সেই উপলব্ধিও তাদের মাঝে জন্ম নিচ্ছে না।

বাংলা ভাষায় আজকের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গবেষণা এবং সেই গবেষণা গুদামজাত না করে মানুষের কাজে লাগানোর চেষ্টা করা দরকার। ইতোমধ্যে যে গবেষণাগুলো সত্যিকার অর্থে শিক্ষক-ছাত্রদের কাজে লাগবে সেগুলোকে নিয়ে চর্চা করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেসব ডক্টরেট দিয়ে থাকে সেগুলোও ডক্টরেটদের কাছেই সঞ্চিত থাকে। ভাষার প্রশ্নে বিভিন্ন সৃজনশীল মাধ্যমে, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদপত্রে সর্বত্র বছরব্যাপী আলোচনা, বিতর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন।

বর্তমানে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রকাশ ভঙ্গিতে ভাষার ব্যপক পরিবর্তন আসা উচিত। যেকোনো দেশের শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে ভাষারও একটা বিপ্লব সাধিত হয়। আমাদের দেশেও সে সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভবনাকে মানবিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখা উচিত।

দুঃখজনক এই যে, আমরা ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে ভাষার জন্যে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়। আরও দুঃখজনক তা শহীদমিনারকে কেন্দ্র করেই, শহীদমিনারের ফুল শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের ভাষাপ্রেম যেন শেষ হয়ে যায়। এই ফুল সারা বছর জীবন্ত রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি।

শুধু বাংলা ভাষা নয় আমাদের দেশের আদিবাসীদের আরও চল্লিশটি ভাষা আছে। পরিচর্যার অভাবে সেগুলোও শুকিয়ে যাবার পথে। তাঁদেরকেও বাঁচিয়ে রাখা আমাদের জরুরি কর্তব্য।

লেখক : নাট্যজন, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

এ বিভাগের আরো খবর