বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

  • মোহাম্মদ শাহজাহান   
  • ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৩:৫২

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের একটি দাঁত পড়ে যায়। নির্যাতনের ব্যাপারে দুই প্রধান হোতা ছিলেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা কর্নেল হাসান ও কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান। কর্নেল মোস্তাফিজ প্রধান অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও হিংস্র আচরণ করেছেন। যদিও মহান নেতা বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে মোস্তাফিজকেও ক্ষমা করে দেন। এই মোস্তাফিজ পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খালেদার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

২২ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। গণ-আন্দোলনের চাপে ৫২ বছর আগে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ওই মামলার এক নম্বর আসামি। সামরিক দানব আইয়ুব খান আজীবন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকতে চেয়েছিলেন। আইয়ুবের অভিলাষ পূরণের পথে এক নম্বর বাধা ছিলেন পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয়, অসমসাহসী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যা করাই ছিল আইয়ুব গংয়ের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েমদের আশা অবশেষে দুরাশায় পরিণত হয়। ওই যে কথায় বলে Man proposes- God disposes. অর্থাৎ ‘মানুষ ভাবে এক, হয় অন্য রকম।’ শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত শুধু জনপ্রিয়তার উচ্চতম শিখরেই আরোহণ করেননি- জনগণমন-নায়কে পরিণত হন। ফাঁসির আসামি মুজিব মামলা চলাকালে যে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন, এর কোনো তুলনা হয় না। মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ, সরকার পক্ষের অভিযোগ এবং অভিযুক্তদের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে- পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করাই ছিল শেখ মুজিবের মূল লক্ষ্য।

ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র আসলে মিথ্যা ছিল না। পাকিস্তান সরকার এই মামলার নাম দিয়েছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই মামলাকে একবার বলেছিলেন ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’।

উল্লেখ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশপ্রেমিক বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই বুঝে যান, পাকিস্তান স্বাধীন হলেও বাঙালিরা স্বাধীন হয়নি। শাসকের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। ব্রিটিশের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছেন। ষাটের দশকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কিছু সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ একদল বাঙালি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা করে। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেন। স্বাধীনতাকামী এই বীর সন্তানের পরিকল্পনা ছিল- ‘কোনো একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে হামলা চালানো হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দি করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে।’ অন্যতম অভিযুক্ত কর্নেল (অব.) শওকত আলী ‘সত্য মামলা আগরতলা’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। চারবারের এমপি এবং ডেপুটি স্পিকার (সাবেক) কর্নেল শওকত আলী স্বীকার করেছেন-

‘আগরতলা মামলা সত্য ছিল। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধুসহ আমরা সবাই বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছিলাম।’

আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। মামলা প্রত্যাহারের এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা একজনকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে কয়েকজন সিএসপিসহ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলেন। শুরুর দিকে শেখ মুজিব আসামির তালিকায় ছিলেন না।

১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলার ব্যাপারে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। পরদিন ২ জানুয়ারি (১৯৬৮) করাচির দৈনিক ডন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সরকার রাজনীতি এবং সরকারি চাকরির সঙ্গে জড়িত কিছু রাষ্ট্রদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করেছে। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানের খবরে বলায় হয়, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুজন সিএসপিসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলা হয়। কারাগারে থাকা শেখ মুজিবকে এই মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, ৬ দফা দাবি দেয়ার পর ১৯৬৮ সালের ৮ মে রাতে দলের কজন শীর্ষ নেতাসহ শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকে প্রায় পৌনে দুই বছর তিনি জেলেই ছিলেন।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব বই পড়ে আর গুন গুন করে গান গেয়ে সময় কাটাতেন। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাতে হঠাৎ কক্ষের বাইরে থেকে দরজায় ধীরে আঘাত করা হয়। ওই সময় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন শেখ মুজিব। প্রথম টোকায় জেগে গেলেন জেলসাথি আবদুল মোমেন। ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল হোসেন জেলগেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শ্রদ্ধা করতেন ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল হোসেন। তোজাম্মেল হোসেন দরজার কাছে এসে বললেন, ‘দরজা খুলতে হবে স্যার।’ জেলসাথি আবদুল মোমেন দরজা খুলে দিলেন। জেলকক্ষে প্রবেশ করলেন তোজাম্মেল হোসেন এবং সিপাহি আম্বর আলী। তখনও ঘুমাচ্ছিলেন শেখ মুজিব। তারা কক্ষে ঢোকার পর বঙ্গবন্ধুর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কচলিয়ে বললেন, ‘বলুন, কী খবর!’ একই সঙ্গে বললেন, ‘দুঃসংবাদ বা সুসংবাদ, কোনো খবরই খারাপ নয়।’ একটি আদেশ শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে ডেপুটি জেলার বললেন, ‘আপনাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে স্যার।’ কিছুদিন ধরেই জেলকক্ষে থেকে তিনি নানা খবর পাচ্ছিলেন। আগরতলা মামলায় তাকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে। হঠাৎ কারামুক্তির আদেশের কথা শুনে নির্লিপ্তভাবেই বলে ফেললেন, ‘নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই কি আমাকে খালাস দেয়া হয়েছে?’ ডেপুটি জেলার ও সিপাহি নীরব রইলেন। শেখ মুজিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্চারণ করলেন, ‘বুঝলাম, সংগ্রাম আসন্ন। মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।’

গভীর রাতে মুক্তির আদেশের কথা শুনে মুজিবের মন বলছিল, তার বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি চক্রান্ত শুরু হয়েছে। বিদায়ের আগে আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের নায়ক শেখ মুজিব বললেন, ‘বন্ধু, আপনাদের কাছে বাংলাদেশকে রেখে গেলাম। জানি না, ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাবার বেলায় শুধু এ কথাটি বলে যাই- এই বাংলাদেশের সঙ্গে আমি কোনো দিন বেইমানি করিনি। কোনো দিন করব না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য।’ এ সময় মুজিবের দুচোখ থেকে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে।

জেলগেট থেকে বের হয়ে আসার পর একটি সামরিক ভ্যান সঙ্গিণ উঁচিয়ে দাঁড়াল মুক্ত মুজিবের সামনে। বিজাতীয় ভাষায় বলা হলো- ‘তুমি আবার গ্রেপ্তার।’ এ সময় শেখ মুজিব জেলগেটের সামনের রাস্তা থেকে এক মুঠো মাটি তুলে নিজ কপালে স্পর্শ করে বিধাতার কাছে প্রার্থনা করলেন- ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতেই মরি।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি, ১ম খণ্ড, সম্পাদক : মোনায়েম সরকার, বাংলা একাডেমি, প্রথম মুদ্রণ, মে ২০১৪, পৃ. ৩৪৩)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন আয়োজিত ৬ সপ্তাহব্যাপী এক কর্মশালায় যোগদানের আমন্ত্রণ পান। ইসলামাবাদ যাওয়ার আগে ড. ওয়াজেদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। বঙ্গবন্ধু তখন এক সপ্তাহ ধরে বাতের ব্যথায় ভুগছিলেন। দুজন লোকের কাঁধে ভর করে তিনি জেলে নির্ধারিত কক্ষে তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ইসলামাবাদে যাওয়ার কথা শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে যাওয়ার অনুমতি দেন। সাক্ষাৎকার শেষে জেলে ফিরিয়ে নেয়ার মুহূর্তে তিনি ওই দুই কারা-কর্মচারীকে বলেন, তিনি জামাইয়ের কাঁধে ভর করে গেট পর্যন্ত যাবেন। জামাতার কাঁধে ভর করে যাওয়ার একপর্যায়ে তিনি ফিসফিস করে বলেন, ‘তুমি ইসলামাবাদ গিয়ে তোমার সহকর্মীদের- বিশেষ করে পাঞ্জাবি সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ছয় দফা সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া জেনে নেবে। ব্যাটাদের এবার দেখিয়ে দেব।’

২০ জানুয়ারি (১৯৬৮) রাতে ড. ওয়াজেদ তার ভাগনের কাছ থেকে জানতে পারেন, পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিশেষ আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। ভাগনে গোপন সূত্রে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার খবরটি জানতে পেরেছেন। ইসলামাদে কর্মশালায় অবস্থান করা ড. ওয়াজেদ উপলব্ধি করেন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার পরদিন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি শিক্ষক ও ছাত্ররা তাকে অনেকটা এড়িয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ড. ওয়াজেদ ২৫ জানুয়ারি ঢাকার উদ্দেশে বিমানে ওঠেন। বিমানে একটি ইংরেজি পত্রিকায় দেখেন, শেখ মুজিব এবং তিনজন ঊর্ধ্বতন সিএসপি কর্মকর্তাসহ মোট ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছে তিনি দেখেন, সবাই চুপচাপ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিছুক্ষণ পর বেগম মুজিব জামাতাকে নিচু স্বরে বলেন, ‘বাবা ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে (১৭ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাতে) তোমার শ্বশুরকে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। গত সপ্তাহ থেকে বহু জায়গায় এবং বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত জানতে পরিনি তিনি কোথায় কী অবস্থায় আছেন।’ এ কথা বলার সময় বেগম মুজিব কোনোভাবেই অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলেন না।

শেখ মুজিবকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার খবরে পূর্ব বাংলায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। মামলা, হামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতনে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগও চুপচাপ বসে থাকেনি। গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে ১৯ জানুয়ারি (১৯৬৮) ঢাকায় জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা মুজিবের মুক্তি দাবিতে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে। ২১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এক জরুরি সভায় শেখ মুজিবকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ দেশের প্রচলিত আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করার দাবি জানানো হয়। ২৬ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এক যৌথ সভায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানায়। মুজিবের সপক্ষে এসব দ্রুত প্রতিক্রিয়ার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস এডমিরাল এআর খান এক বিবৃতিতে জানান, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত আটক ২৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকাজ প্রায় সমাপ্ত হয়েছে এবং শিগগিরই দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের প্রকাশ্যে বিচার হবে। ( দৈনিক সংবাদ, ২৭.১.১৯৬৮)।

পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপরিউক্ত বিবৃতির পর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে খুবই দ্রুততার সঙ্গে পালটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ উপলব্ধি করতে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন উভয় গ্রুপ যৌথভাবে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে দাবি দিবস পালন করে। ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ এবং ছাত্রলীগ- এই তিনটি সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারিও পালন করে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৪৯তম জন্মদিন পালন করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচিগুলো পালন করার মূল লক্ষ্যই ছিল শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইস্যুটিকে জনগণের সামনে জোরালোভাবে নিয়ে আসা।

২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক অধ্যাদেশ জারি করেন। অধ্যাদেশ অনুযায়ী একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচারের ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণার পর জনগণ বুঝতে পারে অভিযুক্তরা ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি রয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসএ রহমানের নেতৃত্বে বিচারপতি মুজিবুর রহমান এবং বিচারপতি মকসুমুল হাকিমকে নিয়ে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ মামলার বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্ট আইনে এ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে কোনো আপিল করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়। ‘রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না’ এটা দেখে কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আইয়ুব খানের প্রধান প্রতিপক্ষ জেলে থেকে বাংলার মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হওয়া শেখ মুজিবকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে হত্যা করাই পাকি চক্রান্তকারীদের মূল লক্ষ্য।

২০ জুন (১৯৬৮) ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয়। ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা শুরু হয়েছিল। এ সময় অভিযুক্তদের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের একটি দাঁত পড়ে যায়। নির্যাতনের ব্যাপারে দুই প্রধান হোতা ছিলেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা কর্নেল হাসান ও কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান। কর্নেল মোস্তাফিজ প্রধান অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও হিংস্র আচরণ করেছেন। যদিও মহান নেতা বঙ্গবন্ধু পরবর্তীকালে মোস্তাফিজকেও ক্ষমা করে দেন। এই মোস্তাফিজ পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খালেদার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

মামলা চলাকালে এক লিখিত জবানবন্দিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ঢাকা কারাগার থেকে দৈহিক বলপ্রয়োগ করে তাকে সেনানিবাসে এনে একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখা হয়। এ সময় তাকে বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নির্জনে রাখা হয়। পরিবারের সদস্যসহ কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। এ সময় কোনো পত্রিকা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। পাঁচ মাস ধরে সমগ্র বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন রেখে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।

বিচার চলার সময় অভিযুক্তদের সেনানিবাসে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্য আসামিরা তখন কথাবার্তা বলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু অন্যদের সব সময় সাহস দিতেন। তিনি বলতেন, আমাদের কিছু হবে না। একদিন তিনি বললেন, ‘এখান থেকে বের হয়ে নির্বাচন করব। নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করব। ওরা ক্ষমতা দিবে না। এরপর যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করব।’

শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। উনসত্তরের শুরুতে ছাত্ররা ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ওই আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৬৯-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি সব শ্রেণির মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এসএ রহমানের বাংলা একাডেমি ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলো আক্রমণ করে। এসএ রহমান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নাইট ড্রেসেই দৌড়ে বাসা থেকে বের হন। বিমানবন্দরে গিয়ে ওই রাতেই লাহোরগামী বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। আন্দোলনের চাপে পিষ্ট আইয়ুব খান পিন্ডিতে ‘গোলটেবিল বৈঠক’ ডাকেন। প্রথমেই মওলানা ভাসানী গোলটেবিলে না যাওয়ার ঘোষণা দেন এবং মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্তকে মুক্তির দাবি জানান। গণ-আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলে ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ ৩৪ জন অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বিশাল ছাত্র জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। এরপরের ইতিহাস সবার জানা।

এটা সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সামনে রেখেই দূরদর্শী শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি জাতির সামনে পেশ করেছিলেন। তিনি জানতেন, পাকি সামরিক ও বেসামরিক চক্র ৬ দফা মানবে না। তারা নির্যাতনের পথ বেছে নেবে। মুজিব এটাও জানতেন, ৬ দফা একদিন এক দফা- তথা স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হবে। শেখ মুজিব সহকর্মীদের নিয়ে সারা বাংলা সফর করে মাত্র তিন মাসে ৬ দফাকে বাংলার মানুষের বাঁচার দাবিতে রূপান্তরিত করেন। দীর্ঘ সময় কারা-নির্যাতন ভোগ করে জেলে থেকেই তিনি বাংলার মানুষের সবচেয়ে জনন্দিত নেতা হয়ে যান।

পাকিস্তান শোষকগোষ্ঠী চিরস্থায়ী রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে তাদের পথের কাঁটা শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর অভিযুক্ত আসামি বানায়। বাংলার মানুষ বুঝে যায়, তাদের প্রিয় নেতা মুজিবকে হত্যার জন্যই ওরা এই মামলা দিয়েছে। মামলার কার্যক্রম শুরু হলে ফল দাঁড়ায় উল্টো। এ সময় সাহসের বরপুত্র শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা অবিশ্বাস্য গতিতে বৃদ্ধি পায়। মামলা চলার সময় সওয়াল-জবাবের রিপোর্ট প্রতিদিনের পত্রিকায় বেশ ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে। এতে শেখ মুজিবের এবং ৬ দফা দাবির যৌক্তিকতা জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় পূর্ব বাংলা এবং বাঙালির প্রতি চরম বৈষম্যের কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ক্রমে বাঙালিদের মধ্যে গভীর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

পাকি চক্রের মূল লক্ষ্যই ছিল শেখ মুজিবকে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে চিত্রিত করা। কথায় কথায় শেখ মুজিবকে গালি-গালাজ এবং ভারতের দালাল বলা হতো। বঙ্গশার্দূল শেখ মুজিব তার লক্ষ্যে অটল থাকেন। এভাবে পাকিস্তানি চক্রের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র শেখ মুজিবকে শেষ পর্যন্ত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা এবং জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর শেখ মুজিব বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন।

সত্তরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার প্রায় শতভাগ লোকের সমর্থন পান। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, শেখ মুজিব ৬ দফা দিয়েছিলেন বলেই পাকিস্তানিরা তাকে আগরতলা মামলা দিয়ে ফাঁসিতে হত্যা করতে চেয়েছিল। এ জন্যই ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মুক্তির মহানায়ক মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। জয় বাংলা!

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধকালে দাউদকান্দি, কুমিল্লার মুজিববাহিনীর কমান্ডার।

এ বিভাগের আরো খবর