১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলেও প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের বীজ রোপিত হয় আরও আগে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। যেখানে কথা বলার সুযোগ রাখা হয় কেবল উর্দু এবং ইংরেজিতে। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব বাংলার কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষারূপে সরকারি স্বীকৃতির দাবি তোলেন। যা ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য একটি শান্তিময় প্রস্তাব। কিন্তু তার এ যৌক্তিক দাবির সরাসরি বিরোধিতা করলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন, গণপরিষদের সহসভাপতি মৌলবি তমিজউদ্দিন খান প্রমুখ। তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন।
ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগ নেতাদের ষড়যন্ত্র, প্রতিবাদ, আন্দোলন-সংগঠন এবং এতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ নিজের ভূমিকার প্রেক্ষাপট প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেন শেখ মুজিবুর রহমান তার লেখনীতে-
“এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করলো। তমদ্দুন মজলিশ একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেব। এদিকে পুরানা লীগ কর্মীদের পক্ষ থেকে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব অনেকেই সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম।” ‘সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. শামসুজ্জামান খান লিখেছেন-
“৪ মার্চ ১৯৪৮ সাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির পক্ষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত এক লিফলেটে স্বাক্ষর করেন। এবং ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে এবং সচিবালয়ে ছাত্র বিক্ষোভে নেতৃত্বে দিয়ে তিনিসহ কয়েক ছাত্র গ্রেপ্তার হন।”
এ সম্পর্কে গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৬-৩-৪৮-এ গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। বিকেলে এস এন একাডেমি এবং এম এন ইন্সটিউটের ৪০০ ছাত্র শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নাজিমউদ্দিন নিপাত যাক’ ‘মুজিবকে মুক্তি দাও’, ‘অন্য গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। এখানে উল্লেখ্য ঢাকায় এর আগের দিন শেখ মুজিবুর রহমানসহ গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। সে খবর যথাসময়ে গোপালগঞ্জে না পৌঁছানোয় ছাত্র বিক্ষোভটি ওই দিন অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে আন্দোলনের প্রাথমিক স্তরে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসমাজের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে পুলিশি আক্রমণে বহু ছাত্র আহত হন এবং শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শামসুল হক, শওকত আলী ও গোলাম মাহবুবসহ বিপুলসংখ্যক ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের কারণে বিক্ষোভ প্রশমিত না হয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। এভাবে ভাষা আন্দোলনে ক্রমান্বয়ে চরম আকার ধারণ করার দিকে অগ্রসর হতে থাকে পূর্ব বাংলাজুড়ে। তথ্যমতে, বাংলা ভাষা আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমঝোতার উপায় খুঁজতে থাকে। ফলে সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ একটি চুক্তিতে উপনীত হন। ১৫ মার্চ সই করা চুক্তিতে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, পুলিশি নির্যাতনের তদন্ত, সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ছাড়াও বাংলা ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। চুক্তিটি সই হওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতাদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই তখন জেলে। এ অবস্থায় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী প্রমুখ বন্দি ছাত্রনেতাদেরকে চুক্তিপত্রটি দেখিয়ে তাদের সম্মতি গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।
প্রসঙ্গত, ওই চুক্তি সইয়ের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে চুক্তির অসারতা প্রমাণ হয় বলে জানা যায়। ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা’ করার ঘোষণা দেন রেসকোর্স ময়দানে। ভাষার অধিকার নিয়ে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ জোরদার হলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে নূরুল আমিন সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে রূপ দেয়ার চেষ্টা চালান। ওই দিন (২১ ফেব্রুয়ারি) ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিলে পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ড যুদ্ধ শুরু হলে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়। একপর্যায়ে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানানোর জন্য পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার সময় মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের কাছে পুলিশ গুলি চালালে রফিক উদ্দিন, জব্বার ও আবুল বরকত শহিদ হন। এই ঘটনার পর একদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠে, অপরদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের এদেশীয় তোষামোদকারী গোষ্ঠীর যোগসাজশে প্রাসাদ যড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে।
এখানে উল্লেখ্য তৎকালীন ছাত্র ও যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকার কারণে ’৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেপ্তার হন, ১৫ মার্চ চুক্তি সম্পাদনের পর মুক্তি পেলেও ’৪৯ সালের ১২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সময় তাদের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। কিছুদিন পর মুক্তি পেয়ে ’৫০ সালে দুর্ভিক্ষের সময় মুখ্যমন্ত্রী লিয়াকত আলীকে ঘেরাও করতে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন ভাসানী-মুজিব ও শামসুল হক। সেই থেকে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্নেও মুজিব জেলে বন্দি ছিলেন। সে সময় জেলে থেকে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদ জেলের ভেতর অনশন ধর্মঘট পালন শুরু করেন (১৬ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি)। শেখ মুজিব অনশনের কারণে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত হন ১৮ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সময়ে সময়ে জেলখানায় গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরামর্শ করে আসতেন। ওই সময়ে শেখ মুজিব ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং কার্যত দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক। ভাষার এই মাসে শ্রদ্ধাভরে সম্মান করি বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গকৃত শহিদদের এবং কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করি ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় অবদানকে।
লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।