অনেকে বলে থাকেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলবন্দি হয়ে ফরিদপুরে ছিলেন। ফলে, এই আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ সম্ভব ছিল না। যারা এহেন কথা বলে থাকেন, তাদের বক্তব্যে তথ্য ও যুক্তি নেই। কারণ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু কিছু মুহূর্তের ব্যাপার নয়। এর ছিল প্রস্তুতি ও প্রবহমানতা। এই প্রস্তুতি ও প্রবহমানতা বিচার করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান স্থপতি বলতে হয়।
বাঙালির আত্মশক্তির উত্থান দেখা গিয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষার জন্য প্রকাশ্যে আন্দোলন করে শহিদ হওয়ার পূর্বদৃষ্টান্ত আর নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন জেলে অন্তরীণ নিশ্চয়। একুশের ঘটনা স্মরণ করে জেলখানাতে বসে তিনি লিখেছেন:
“মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। জনাব নূরুল আমিন বুঝতে পারলেন না, আমলাতন্ত্র তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল। গুলি হলো মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।’ (রহমান, ২০১২ : ২০৪) ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এভাবেই একুশের রক্তদান এবং এই রক্তদানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জেলে বসে (১৯৬৬) সেই আন্দোলনের পরিণাম নিয়ে রাজনৈতিক গ্রন্থরচনা, কম সাহসের কথা নয়। এই সাহস বঙ্গবন্ধু নিজে লালন করতেন এবং তা বাঙালিদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে তিনি পেরেছিলেন।
ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা এক দিনের নয়। ছাত্ররাজনীতিতে যখন তিনি ছিলেন, আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতিতে যখন তিনি যুক্ত, স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন তিনি- সব সময়ই ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তিনি উন্নত ভাবনা ভেবেছেন এবং তা কার্যকরের ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এই ভাবনার ধারাবাহিকতা আছে।
১৯৫২-এর আন্দোলনের পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে এর ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাঙালির জন্য বিলম্বে হলেও এটি একটি বিজয় নিশ্চয়। কিন্তু এতেই তুষ্ট ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৬ সালের ৮ জুন, বুধবার জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শহিদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে স্রষ্টার কাছে নীরবে প্রার্থনা করেন এবং অন্তরের মণিকোঠায় নেন সুদৃঢ় সংগ্রামের শপথ। ‘কারাগারের রোজনামচায়’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন:
“বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেপ্তার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি [বঙ্গবন্ধু] আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।” (রহমান, ২০১৭ : ৭৩-৭৪) এই প্রতিজ্ঞা বঙ্গবন্ধু শেষপর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন এবং সে কারণেই বাঙালি পেয়েছিল একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় যুবলীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং সেখানে ভাষা-বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিশিষ্ট ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক লিখেছেন-
“সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। (আজিজ, ১৯৯২ : ১৫) কী ছিল সেই প্রস্তাবে? গাজীউল হক বঙ্গবন্ধুর সে বচন উল্লেখ করে লিখেছেন:
“পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।” (আজিজ, ১৯৯২ : ১৫)
এই দাবি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। কিন্তু সরকারের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“ফেব্রুয়ারি ৮ হবে, ১৯৪৮ সাল। করচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য [তখন ‘জাতীয় কংগ্রেস’ নামে রাজনৈতিক দল ছিল; তিনি সেই দল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।] বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।” (রহমান, ২০১২ : ৯১)
আদতে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকেই আরম্ভ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সংসদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ও তার পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দৌহিত্রী আরমা দত্ত লিখেছেন-
“একদিন দাদু [ধীরেন্দ্রনাথ] আর দিলীপ কাকুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের জীবনে সে এক অমাবস্যার কাল। [...] পরবর্তীকালে ময়নামতি সেনানিবাসের তৎকালীন বেসামরিক কর্মচারী রমণীমোহন শীলসহ অন্যদের স্মৃতিচারণা থেকে জেনেছি, কী নির্মম নির্যাতন চলেছে তখন দাদুর ওপর। দাদু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাকু দিলীপ দত্তের লাশ আমরা পাইনি।” (ইসলাম, ২০১৩ : ৬১৩) এভাবেই পাকিস্তানিরা তাদের শত্রুকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনও তার একটি।
মূলত ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছড়িয়ে পড়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি এবং সে-সূত্রেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে। তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় এই পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলের এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিতকুমার গুহ প্রমুখ। সভায় পূর্বাপর ঘটনাসমূহ আলোচনা করে গণপরিষদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে এর বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনের স্বার্থেই গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। গণতান্ত্রিক যুবলীগ, গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাস বা হোস্টেলগুলোর সংসদ ইত্যাদি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে পরিষদ গঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ ঢাকা শহরে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ওই দিন পূর্ববাংলায় সফল হরতাল পালিত হয় আর বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে এভাবেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সূচনা ঘটে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল প্রথম হরতল। হরতালে বিক্ষোভ দেখানোর সময় সচিবালয়ের প্রথম প্রবেশদ্বার বা গেইটে পিকেটিংয়ে অংশ নেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ, দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারে অন্যরা। এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সূচনা করতে গিয়ে পুলিশ ও শাসক দলের ভাড়াটে গুন্ডাদের হাতে বহু আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা আহত এবং অনেক ছাত্রনেতা গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রনেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন চরমে ওঠে। ফলে ১৫ মার্চও হরতাল পালিত হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বিবেচনা করে ওই দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের নির্বাচিত প্রতিনিধি কমরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর চুক্তি! একটি অভাবিত ঘটনা। সেটিও সম্ভবপর হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানসহ বন্দিদের মুক্তির লক্ষ্যে ছাত্রসমাজের বজ্রকঠোর মনোভাবের জন্য। এই চুক্তির আটটি শর্ত ছিল।
প্রধান কয়েকটি হলো: গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তিদান; হামলার তদন্ত ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিপ্রদান; বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদাদানের জন্য ব্যবস্থাপক সভায় প্রস্তাবের ব্যবস্থা; কলেজগুলোতে বাংলায় পঠনপাঠনের সুযোগ সৃষ্টি; আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ না নেয়া; সংবাদপত্রসমূহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার; ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার; ‘আন্দোলনকারীরা বিদেশের অনুচর’ সরকারের এই বক্তব্য প্রত্যাহার। উল্লেখ্য, এই চুক্তিপত্র যখন তৈরি হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশিষ্ট ছাত্রনেতারা জেলে। সে কারণে চুক্তিপত্রের খসড়া জেলখানাতে নিয়ে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজনের অনুমোদন করিয়ে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে এতোটাই প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন যে, জেলে থাকলেও তাকে না দেখিয়ে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ছাত্রনেতৃবৃন্দ একমত হতেন না। এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন যে, ১১ মার্চ তাদের জেলে নেওয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় মুক্তি দেওয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে তাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বন্দি ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং জেল থেকে মুক্তি পাবার পর দিনই বঙ্গবন্ধু এই বিক্ষোভে শামিল হন। শুধু শামিল নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সমাবেশে তাকে সভাপতিত্ব করতে হয়। এই সভাপতিত্বের ব্যাপারটি পূর্বনির্ধারিত ছিল না। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় কোনো সভাতে সভাপতিত্বও করেননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ সে সময় বঙ্গবন্ধুর ওপরই নেতৃত্ব প্রদান করে। তাই ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি আন্দোলনের জন্য কিছু দিকনির্দেশনাও ঘোষণা দেন। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শোভাযাত্রা নিয়ে পরিষদ ভবনের দিকে গমন এবং সেখানে দাবিনামা উত্থাপন করে আবার ফিরে আসা- এই ছিল বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং বঙ্গবন্ধুও কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন ঢাকা থেকে সারা দেশে তখনই ছড়িয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানিরা এই আন্দোলনকে হিন্দু, কমিউনিস্ট ও ভারতের আন্দোলন বলে প্রপাগান্ডা চালায়। তারা বলে, ভারত থেকে হিন্দু ও কমিউনিস্টরা পাকিস্তানে এসে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এই আন্দোলন করছিল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পাকিস্তানিদের কূটচাল। বাংলা কেন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব ভাবনা ব্যক্ত করেছেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। তার বক্তব্য:
‘‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পাশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচ ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না।’’ (রহমান, ২০১২ : ৯৮)
তারপরও বঙ্গবন্ধু বাংলার একক মর্যাদা দাবি করেননি, করেছেন উর্দুর সঙ্গে সমমর্যাদা।
১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ পূর্বদিনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভাতেও ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ ও বক্তব্য প্রদান করেন। তবে এই অভূতপূর্ব ধর্মঘট পালনের জন্য নেতৃবৃন্দের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতার কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার ফলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন সমগ্র পূর্ববাংলা বাঙালির আত্মার আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সারা দেশ কেঁপে ওঠে; রাস্তা, দেয়াল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পোস্টারে ছেয়ে যায়। তাতে লেখা থাকে: ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। এই দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যায় এবং এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেসব ছাত্রনেতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বাগ্রে। তার ভূমিকা ও সাহস ছিল স্মরণে রাখার মতো।
১৯ মার্চ মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এসে ২১ মার্চ ঢাকা ঘোড়দৌড় মাঠে (রেসকোর্স ময়দান) এক ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুসহ চার-পাঁচশ ছাত্র সেই সমাবেশে একত্রে বসেছিলেন। ছাত্ররা ধ্বনি ও হাত তুলে জিন্নাহর এই প্রত্যয়ের বিপক্ষে জানিয়ে দেয়: ‘মানি না’। এরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের সময় জিন্নাহর বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা। ২১ মার্চের প্রতিবাদ থেকেই ২৪ মার্চের প্রতিবাদের সাহস সঞ্চয়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের ভিত তৈরিতে এভাবেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। মোহম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা ত্যাগ করার পর ছাত্রসমাজের মধ্যে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে খানিকটা দ্বিধার জন্ম যে হয়েছিল, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। কেননা, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানেই জিন্নাহর গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি ছিল। জিন্নাহর মুখ দিয়ে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে বক্তব্য এলে অনেক বাঙালি ছাত্রনেতা পর্যন্ত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে জিন্নাহর অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য কেউ কেউ বক্তব্যও রাখেন। কিন্তু এখানেই আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা লক্ষ করা যায়। ছাত্রসমাজের এই দ্বিধাকালে দ্ব্যর্থহীনভাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, নেতা অন্যায় করলেও ন্যায়ের স্বার্থে তার প্রতিবাদ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লেখেন: “আজও আমার একটা কথা মনে অছে। আমি বলেছিলাম, ‘কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন, হজরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্ন জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।”
সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সকল কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।” (রহমান, ২০১২ : ১০০)
ছাত্রসভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর এই দ্ব্যর্থহীন অবস্থানের কারণে ছাত্রসমাজের দ্বিধাও কেটে যায় এবং সরকারের অবস্থান সমর্থনকারী ছাত্রসংগঠনের অবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু সঠিক পথনির্দেশ করতে পেরেছিলেন বলেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে আন্দোলনে রূপলাভ করে। আসলে বলা চলে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথমপর্যায় শেষ হয়।
এ সময় বঙ্গবন্ধু বাঙালির রাজনৈতিক দল গঠনে তৎপর হন। আসলে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে’র ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। বঙ্গবন্ধু এই ব্যাপারটি ভালো করে ছাত্রসমাজে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন। তাই ছাত্রদের মধ্যে সমর্থন হারিয়ে ফেলে এই ছাত্রসংগঠনটি। দেশ ও ছাত্রদের স্বার্থে সঠিক পথে আন্দোলন পরিচালনার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৪৮ সালে মার্চের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমানসহ চৌদ্দজন ছাত্রনেতা একটি প্রচারপত্র বিলি করেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় সরকারবিরোধী প্রথম সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। রাষ্ট্রভাষা সংগঠনে এই ছাত্রসংগঠনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে বিনাবিচারে আটকে রাখে। এদিকে ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হত্যা-পাল্টা হত্যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন পূর্ব বাংলার এককালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি বক্তৃতায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। অথচ, তিনিই ১৯৪৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ছাত্রদের সঙ্গে যে আট দফা চুক্তি করেছিলেন, তাতে বাংলাকে উর্দুর সমমর্যাদা প্রদান করা হবে বলে অঙ্গীকার ছিল। যারা লেখেন, এ সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনে তার উপস্থিতি নেই। যারা এগুলো লেখেন, তারা প্রকৃত ইতিহাস হয় জানেন না অথবা জেনে গোপন করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরও স্থপতি। এই আন্দোলন কীভাবে, কারা আরম্ভ করবে, জেলে বসে তার নিজের করণীয় কী হবে এসব তিনি আগেই ভেবেছেন এবং অনুসারীদের দিয়ে সে অনুসারে কাজ করিয়েছেন। ভাষাসৈনিক গাজিউল হক এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই লিখেছেন-
“১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ (আজিজ, ১৯৯২ : ১৭)
আবদুল গাফফার চৌধুরীও ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
“শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।” (আজিজ, ১৯৯২ : ২১)
এই চিরকুটে ছিল আন্দোলন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। এ ব্যাপারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু নিজে সব প্রকাশ করে গেছেন। আসলে, ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারির পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় এবং আরম্ভকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন-ঘোষণার পর জেল-হাসপাতালে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল এমন: যে ঢাকায় বসে খাজা নাজিমুদ্দিন ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই উল্টো বললেন। জেল-হাসপাতালে সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে, তারাসহ বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের আরও নেতা নিয়ে রাত একটায় জেল-হাসপাতালের গোপনীয় স্থানে সভা করেন। এই সভা করাটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, আই.বি’র লোকজন, পুলিশের সদস্য, গোয়েন্দা কর্মচারী আর সাধারণ ডাক্তার-নার্স- এতো সংস্থা ও লোকের চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতের এই সভাটি আহ্বান করা একজন বন্দির জন্য স্বাভাবিককর্ম ছিল না। বঙ্গবন্ধু সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং সে রাতের অনানুষ্ঠানিক সভায় যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল সেই পরিকল্পনা অনুসারেই পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ সূচিত হয়েছে। এই সভা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছে। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’ আরো দুএকজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি [বঙ্গবন্ধু] আরও বললাম, ‘আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব।” (রহমান, ২০১২ : ১৯৬-৯৭)
বঙ্গবন্ধুর এই পরিকল্পনা অনুসারে তার সুপরিচিত কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক মনোনীত করে ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুধু ছাত্ররা করে আসছিল তাতে সর্বমহল যুক্ত হয়, এতে রাজনীতিবিদগণ আসার সুযোগ পান। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় পূর্ববাংলা আইনসভার অধিবেশন আহ্বানের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এই আন্দোলনের ডাকের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পায় অনেক গুণে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা অনুসারে জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেন যে, তাকে বিনাবিচারে আটক রাখা হয়েছে। হয় তাকে মুক্তি দেয়া হবে, তা না হলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশনের মাধ্যমে দেহত্যাগ করে জেলমুক্ত হবেন। এই গোপন সভার সংবাদ নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং সে কারণেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে দ্রুত স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুরে আসার সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি হোটেলে আবার গোপন রাজনৈতিক বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
‘‘আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া করলাম, আলাপ-আলোচনা করলাম। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললাম। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করব। বললাম, সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ তো আছেই। আমরা যে আগামীকাল থেকে অনশন শুরু করব, সেকথাও তাদের বললাম, যদিও তারা পূর্বেই খবর পেয়েছিল। [...] তারা আমাকে বলল, ‘২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” (রহমান, ২০১২ : ২০০)
এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগঠিত ও বিভিন্ন স্থানে বিস্তারে বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকার পরও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ফরিদপুর জেলে এসে বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমেদ পূর্বসিদ্ধান্ত অনুসারে অনশন আরম্ভ করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তারা শারীরিকভাবে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু অনশনরত অবস্থায় জেলে বসেই কর্তব্যরত পুলিশদের কাছে সংবাদ পান ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় গুলি হয়েছে, ছাত্ররা শহিদ হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে ফরিদপুরে মিছিল হয়েছে ইত্যাদি। এই সংবাদ শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, বিশেষ করে ছাত্রহত্যার ব্যাপারটি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোন দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোন খবর নাই। ঘুম তো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর।” (রহমান, ২০১২ : ২০৩)
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু জেলবন্দি থাকলেও তার মন ছিল আন্দোলনে, তার চিন্তা ছিল আন্দোলনকারীদের ঘিরে। অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল বঙ্গবন্ধু এরই মধ্যে প্রত্যয় গ্রহণ করেন যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ঘরে ফেরার আর উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে এভাবে-
“গুলি হল মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেই তো চলত। আমি [বঙ্গবন্ধু] ভাবলাম, দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।” (রহমান, ২০১২ : ২০৪)
অনশনে বঙ্গবন্ধুর শরীরের এমন অবনতি হয়েছিল যে, ডাক্তারেরা পর্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছিলেন। অবশেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে বের হন।
ভাষা আন্দোলনের প্রবল স্রোত পাঁচ বছরের শিশু শেখ হাসিনা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তাই জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিন পর বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জের বাড়িতে পৌঁছেন, শিশু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর গলা আদরে জাপটে ধরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর রাজবন্দিদের মুক্তি চেয়ে স্লোগান দেন। সেই স্মৃতি বঙ্গবন্ধু ভুলতে পারেননি। তিনি লিখেছেন-
‘‘পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।” (রহমান, ২০১২ : ২০৭)
এ থেকে বোঝা যায়, ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কতোটা তীব্র হয়েছিল এবং শেখ হাসিনার মধ্যে শৈশব থেকেই রাজনীতি কতটুকু আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল। পরে দেখা যাবে শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন এবং আরও পরে জাতীয় রাজনীতিতে। তাই একথা বলাই চলে, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি, আর শেখ হাসিনার রাজনীতিতে প্রবেশের সূচনাদ্বার হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এই আন্দোলন শেখ হাসিনার মনে দাগ কেটেছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছেন, গ্রামের মানুষেরাও ঢাকা শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র শহিদ হওয়ার কথা জানে এবং তারা পাকিস্তানি শাসকদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। জনগণের এই বিক্ষুব্ধতাকে তাদের শোষণমুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে পরে যুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অব্যবহতি পরে বঙ্গবন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আদায় ও তা প্রকাশ-প্রচার করা। ইতিপূর্বে সোহরাওয়ার্দীর নামে মুসলিম লীগ সরকার পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশ করিয়েছে যে, সোহরাওয়ার্দী উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। এ সময় সোহরাওয়ার্দী দীর্ঘদিন করাচিতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাই করাচিতে যান এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সোহরাওয়ার্দী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে- এই বার্তাটি যে বিপুলসংখ্যক বাঙালি সোহরাওয়ার্দীকে অন্ধভাবে সমর্থন করতো তাদের দ্বিধায় ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর করাচি সফরের কারণে সোহরাওয়ার্দীর মত সর্বাংশে বাংলা ও উর্দুর দিকে আসে এবং বাঙালির সংগ্রাম অনুকূল বাতাস পায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু রচিত গ্রন্থে আছে-
“আমি [বঙ্গবন্ধু] আর একটা অনুরোধ করলাম, তাঁকে [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] লিখে দিতে হবে যে, উর্দু ও বাংলা দুইটাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে তিনি সমর্থন করেন। কারণ অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মুসলিম লীগ এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা প্রপাগান্ডা করছেন তাঁর [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] বিরুদ্ধে। তিনি [হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী] বললেন, ‘নিশ্চয়ই লিখে দেব, এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস।’ তিনি লিখে দিলেন।” (রহমান, ২০১২ : ২১৬)
এই বক্তব্যটি পরে পূর্ববাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠী সেসময় মিথ্যে প্রচার করেছিল যে, বাঙালিরা শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে আন্দোলন করছে। করাচিতেই সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মারফত বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে সত্য তুলে ধরেন। এটি যে শাসকদের মিথ্যে প্রচারণা সে কথাও বলেন বঙ্গবন্ধু। এই সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লেখেন-
“খাজা সাহেব ও লাহোরের শহীদ সাহেবের ভক্তরা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন। প্রেস কনফারেন্সে সমস্ত দৈনিক কাগজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনকি এপিপি’র প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য পেশ করার পরে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তাঁদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আমরা যে উর্দু ও বাংলা দু’টাই রাষ্ট্রভাষা চাই, এ ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের বলা হয়েছে, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করছি আমরা।” (রহমান, ২০১২ : ২১৭)
বঙ্গবন্ধুর এই করাচি সফরের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সঠিক গতিপ্রাপ্ত হয় ও সাধারণ বাঙালি বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পায়।
১৯৫২ সালের অক্টোবরে চীন দেশে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের ৩০ প্রতিনিধির একজন হিসেবে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেন। পূর্ববাংলা থেকে গিয়েছিলেন পাঁচ জন। কিন্তু একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাংলায় বক্তৃতা করার সাহস দেখান। এতে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়ে এবং এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। কারণ, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদেশে গিয়ে বাংলার অস্তিত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, কম কথা নয়! ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-
“পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করলেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।”
কেন কর্তব্য? এর উত্তর আছে বঙ্গবন্ধুর অন্য বইয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, স্বদেশের ভাষা নিয়ে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই গর্ববোধ করে; ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে গর্বের কিছু নেই বলে তিনি লিখেছেন। একই সঙ্গে তিনি এটাও লিখেছেন, বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা যেহেতু বিশ্বের মানুষ জানে, সেহেতু বাংলাতেই বক্তৃতা দেওয়া উচিত। বাংলায় বক্তৃতা দেওয়াটা তার পূর্বপরিকল্পিত বলেই এ ব্যাপারে তিনি আতাউর রহমান খান, তফাজ্জাল হোসেন ও খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে কী বলবেন তা আলাপ করে নিয়েছিলেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-
“বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান, ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’ (রহমান, ২০২০ : ৪৩)
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি লক্ষ করেছেন চীন দেশের অনেকে ইংরেজি ভাষা জানার পরও ইংরেজি বলে না। এমনকি নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বভাষায় বঙ্গবন্ধু ও তাদের দলকে অভ্যর্থনা করেন। দোভাষী যখন ভুলভাবে এর উপস্থাপন করেন তখন উপাচার্য ইংরেজিতে দোভাষীর ভুল শুধরে দেন। উপাচার্যের এই স্বভাষা প্রীতির ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। আদতে চীনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন করে পাকিস্তানের শাসকদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বাংলায় এই ভাষণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রবাহকে তীব্র করেছে নিশ্চয়। এই ভাষাপ্রীতির জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী পালনের সময় বঙ্গবন্ধু ঢাকাতেই থাকেন, নেতৃত্ব দেন মিছিলে, করেন বক্তৃতা। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে প্রভাতফেরি বের করা হয়; কালো পতাকা বহন করা হয়; ঢাকা শহর প্রদক্ষিণও করা হয়। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর্মানিটোলা মাঠে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। এভাবেই ২১-এর চেতনার ধারাবাহিকতায় আন্দোলনে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে বার বার জেলে যেতে হয়েছে। ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি জেল থেকেই স্মরণ করেছেন বায়ান্নের বীর শহিদদের এবং ‘কারাগারের রোজনামচায়’ লিখেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলে ছিলেন-
“আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।” (রহমান, ২০১৭ : ২০৬)
বন্দিত্ব-আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদির পথ ধরে একুশের চেতনার মধ্য দিয়ে অবশেষে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে একটি স্বাধীন দেশ অর্জনের প্রেরণা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি আন্দোলনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারতো বলে মনে করেন ভাষাসংগ্রামী গাজিউল হক। তিনি লিখেছেন-
“১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও নেতৃত্বদানের পর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব যদি কারাগারের বাইরে থাকতেন, তা হলে সেদিন (২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে) সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষে হরতাল প্রত্যাহার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভবপর হতো না বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।” (আজিজ, ১৯৯২ : ১৪)
অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকালে কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেতাদের মধ্যে যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু জেলে না থাকলে তার সঠিক নেতৃত্বে এই বিরোধ সৃষ্টির অবকাশ হতো না বলেই গাজিউল হক মনে করেন। তবে, এম আর আখতার মুকুলের এই কথাই শেষ অবধি সত্য-
“১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এর পরবর্তী অধ্যায়ে শুরু হলো বাঙালি সংস্কৃতির উন্মেষ আন্দোলন। প্রায় একই সময়ে দ্রুত গড়ে উঠলো স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা ও স্বাধিকরের আন্দোলন এবং চরম পর্যায়ে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সবই একসূত্রে গাঁথা। কিন্তু সর্বত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সংগঠিত জাতীয়তাবাদীদের হাতে।” (মুকুল, ২০০০ : ৪৫)
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মুর্তাজা আলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন তার পরে বাংলা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদেরা যত খুশি গবেষণা করুন আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেবো, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ (রহমান, ১৯৯৭ : ২৯)
বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান মনে করেন, এই বক্তব্যের মধ্যে ‘স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার একটা ডাক’ (রহমান, ১৯৯৭ : ২৯) আছে। সত্যি, মাত্র তিন সপ্তাহ পরেই (৭ মার্চ) বঙ্গবন্ধু ঘোড়দৌড় মাঠে তার ঐতিহাসিক ভাষণে সেই ডাকটি দিয়েছিলেন। এর আগেই অবশ্য বঙ্গবন্ধু একুশের কথা স্মরণ করিয়ে জনগণকে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকতে বলেছেন এবং সাহসী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে শহীদমিনার পাদদেশে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের মোকাবেলায় বাঙালি যাতে কাপুরুষের মতো পিছু না হটে। কারণ, শহিদের আত্মারা ভিক্ষা চাইছে বাঙালিরা সাহসী হোক। ভাষা আন্দোলনের সময় যেসব ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন তারা তখন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, অতীতে ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানে তা অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও ষড়যন্ত্র হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন,“সামনে আমাদের [বাঙালির] কঠিন দিন। আমি [বঙ্গবন্ধু] আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে তো একদিন মরতেই হয়। আমি জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারবো। তাই আজ আমি আপনাদের এবং সারা বাংলার মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হোন। বাঙালি যেন আর অপমানিত-লাঞ্ছিত না হয়। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।” (সালাহউদ্দিন, ২০১১ : ১১৮) এভাবেই একুশের চেতনার আলোকে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে লড়াইয়ে আহ্বান করেছেন এবং পরবর্তী সময় দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর তার দৃঢ় নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ, ১৯৭১ সালে।
বাংলা ভাষার জন্য মমতা ও আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধুর কম ছিল না। তিনি ১৯৪৮ সালেই বুঝেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান দেখাবে না। তাই, তিনি সে সময় থেকেই আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে বাঙালি স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে পৌঁছে এবং অবশেষে তারা লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বিদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মূলত তিনটি বাংলা ভাষণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে; দ্বিতীয়টি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়; তৃতীয়টি ১৯৭৪ সালের ২৫শ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে। এর আগে চায়নার শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি দেশের কর্ণধার ছিলেন না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে বীরের মতো মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এবার তার স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। লন্ডন ও দিল্লি হয়ে তার ঢাকায় পৌঁছার কথা। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে গার্ড-অব-অনার প্রদান করা হয়। তিনি সেখানে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি-শুভেচ্ছা বক্তব্যও প্রদান করেন। তার সম্মানে দিল্লিতে আয়োজন হয় একটি জনসভার।
স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাজনৈতিক ভাষণ এটি। শীতের দিনে মূলত হিন্দিভাষী দিল্লিবাসীর সম্মুখে এই ভাষণ দেবার আগে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে।
করাচি থেকে লন্ডন হয়ে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অবশেষে দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি তার সেই প্রত্যাবর্তন দিবসটি স্মরণীয় করতে উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। রাষ্ট্রপতি ভিপি গিরিকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি বিমানবন্দরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের উপস্থিত করিয়ে বিশ্ববাসীকে চমক দেন ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও তার নেতাকে এভাবেই সম্মান জানায় ভারত। একটি খোলা মঞ্চ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার ভাষণ শেষ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর দেহকে আটক করেছিল কিন্তু তার আত্মাকে তারা আটক করতে পারেনি। সেই আত্মাই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধুর পালা, তার অভিব্যক্তি তিনি প্রকাশ করবেন। মাইকের সামনে দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাঁড়ান। দিল্লির জনসভায় উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। সেদিনটি ইন্দিরা গান্ধীর ছিল না, ছিল বঙ্গবন্ধুর। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মঞ্চে আছেন কিন্তু জনতার মনোযোগ তিনি ছাড়া অন্য কারো প্রতি, সম্ভবত ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এমন ঘটনা এই একবারই ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে বক্তব্য শুরু করেন: ‘প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতী গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, প্রেজেন্ট...’, এরপরেই জনতার মধ্য থেকে প্রবল দাবি ওঠে: ‘বাংলা... বাংলা...’। থেমে যান বঙ্গবন্ধু। পাশে দাঁড়ানো ইন্দিরা গান্ধী ও অন্য নেতারা বলেন, তিনি যেন বাংলাতেই বক্তৃতা করেন। মুচকি হেসে, ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আরম্ভ করেন বাংলায় তার বক্তৃতা-
“আমার ভাই ও বোনোরা”। বাংলাদেশে পা রাখার আগেই বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম ভাষণ বাংলায়! এটিও ইতিহাস। ভাষণে সম্বোধনের পর তিনি সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন-
আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যক্তিগত অবস্থানের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, দুদিন আগেও তিনি পশ্চিম পকিস্তানের অন্ধকার সেলে কারারুদ্ধ ছিলেন। তিনি ভাষণে বলেন, তার মুক্তির জন্য, তাকে রক্ষার জন্য শ্রীমতী গান্ধী পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে চেষ্টা করেননি। ব্যক্তিগতভাবে ও দেশের মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার, ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভারতের মানুষও সবাই সচ্ছল নয়, কিন্তু তারপরও এক কোটি শরণার্থীকে তারা আহার ও বাসস্থান দিয়েছে- একথা উল্লেখ করেও বঙ্গবন্ধু ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। পাশাপাশি তিনি বিশ্বের সচেতন মানুষের সাহায্য ও সমর্থন কামনা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য। আদর্শ, নীতি, মনুষ্যত্ব, বিশ্বশান্তির কথা উল্লেখ করে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল বলে সেই ভাষণে জানান। এভাবে স্বাধীন দেশে পদার্পণের পূর্বকালেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলকাঠামো কী হবে, বিশ্বের কাছে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম থেকেই যে অপজিজ্ঞাসা শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তা পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন, তাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার আদর্শের এত মিল কেন? এর উত্তর তিনি দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেন; বলেন, নীতি, মনুষ্যত্ব, বিশ্বশান্তিতে তাদের আদর্শ অভিন্ন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে পরে যে নানা তিক্ত প্রশ্ন বিভিন্নজন তোলে, তার সূচনা যে শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই সে উল্লেখ আছে। ভাগ্যিস কেউ বলে না, ভারতের আকাশ, বাতাস, বৃক্ষলতার সঙ্গে বাংলাদেশের এত মিল কেন!
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চেয়েছিল ১৯৭২-এর জানুয়ারির ১০ তারিখেই বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে একটু দেখা দিয়ে তবে ঢাকায় যান। কিন্তু তা হয়নি। ভারতের যে রাজ্যটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কাছে থেকে এত ঘনিষ্ঠভাবে সাহায্য করেছে, সেই রাজ্যের মানুষের দাবিপূরণ করার জন্য বঙ্গবন্ধু তার প্রথম আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফর করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। যে কলকাতার রাস্তার ধুলোতে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর পদসঞ্চালন ঘটেছে অগণিতবার, যে কলকাতার কলেজে তিনি পাঠ নিয়েছেন, হোস্টেলে থেকেছেন, তার সেই স্মৃতিময় কলকাতায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসেন প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। কলকাতায় ব্রিগেড মাঠে দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে তার দ্বিতীয় বাংলা ভাষণটি রাখেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ভাষণের প্রথমেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জনগণের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। কিন্তু কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের একটি রাজ্যের নামও ভুল করে তিনি বাদ দেননি। এক নিঃশ্বাসে বলেন, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের নাম। তাদের জনগণ ও রাজ্য সরকারকেও ধন্যবাদ জানান।
বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা চিত্তে আরও বলেন, “আপনাদের এই দান কোনো দিন আমরা শোধ করতে পারব না। স্বাধীনতা পেয়েছি, বড়ো রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। এত রক্ত কোনো জাতি, কোনো দেশে কোনো দিন দেয় নাই, যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। না হলেও ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। শতকরা ৪০ খানা ঘর আমার বাংলাদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারফিউ আইন জারি করে আমার জ্ঞানী-গুণী, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হয়েছে। আমার এক কোটি লোক ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।” (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েব সাইটের ভিডিও থেকে) এরপর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে কত সম্পদ ক্ষয় হয়েছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সংগ্রাম করে বাঙালি স্বাধীন হয়। তিনি এই ভাষণে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরেন সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। তারপর বলেন, পাকিস্তানিরা দেশের উন্নয়নে সময় না দিয়ে, দেশে দারিদ্র্য দূর না করে প্রতিহিংসা ছড়িয়েছে। তারা কাশ্মির নিয়ে, নেতাদের নিয়ে আর হিন্দুদের নিয়ে মিথ্যে কথা বলে জনগণকে বাস্তব থেকে দূরে রেখেছে। ভাষার অধিকার না দেয়া, অন্য অধিকার না দেয়ার কথাও তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিরা পরাজয়বরণ করে পালানোর আগে খাদ্যগুদাম থেকে শুরু করে কী কী ধ্বংস করে চলে গেছে, সে কথাও বলেন তিনি। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বভাবের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাঙালির স্বভাব যেমন কোমল, তেমনি কঠিনও। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে প্রমাণ তারা রেখেছে। এই ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আমেরিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, মুক্তিযুদ্ধকালে তারা যথাযথ কাজ করেনি। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মানুষ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকার সাধারণ মানুষ, সাংবাদিকরা এ সময় সাহায্য করলেও আমেরিকার সরকার সমর্থন করেনি। তাই তিনি স্পষ্ট বলেন-
“আমি আমেরিকা সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাই না। কৃতজ্ঞতা জানাতে পারব না।” বরং তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন, গণতন্ত্রের কথা মুখে না বলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিন। আমেরিকা সম্পর্কে দেশের বাইরের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থানটি ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। একদিকে তিনি রাশিয়াকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, অন্যদিকে আমেরিকাকে দিচ্ছেন না এবং তা স্পষ্ট করে আবার উল্লেখও করছেন। তার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বক্তব্যের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। আবার তিনি পাকিস্তানিদের উদ্দেশেও বলেছেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর তার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার যে বিদেশের মাটিতে বলছে, বাংলাদেশ এখনও তাদের অংশ- এর প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি তিনি। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রভাবে পাকিস্তান আমলে তার গড়া আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি দিল্লির ভাষণের মতো এখানেও বলেন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র হবে তার সরকারের মূলস্তম্ভ। পরে দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে এগুলোই বাংলাদেশের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথের একাধিক কাব্যপঙক্তি তিনি আবৃত্তি করেছেন এবং এর শেষদিকে বঙ্গবন্ধু বেশ আবগাপ্লুত হয়ে পড়েন। নিজের ভাষায় বক্তৃতার কারণে এই আবেগপ্রকাশ আরও গভীরভাবে প্রকাশ করা গেছে বলে মনে করা যায়।
বৈশ্বিক রাজনৈতিক কূটচক্রান্তে খানিকটা বিলম্বই হয়ে যায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তি। বিশেষ করে ভেটোদানের শক্তিসম্মত দুটো পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা ও চায়না বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান করায় জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে বাংলাদেশকে বেগ পেতে হয়। তবু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জয় হয় এবং ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ পায় এবং বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। নির্দিষ্ট দিনে নিউইয়র্কসময় বিকেল ৪টায় তাকে বক্তৃতার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এ সময় সাধারণ সভার সভাপতি আলজিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ ব্যুতফলিকা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে তুলে এগিয়ে দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়ান গলাবন্ধ কোট, কালো ফ্রেমের খুব চিরচেনা চশমা, আর ব্যাকব্রাশ করা চুলে অপরূপভাবে। এমন একজন সুদর্শন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আগে বিশ্ব খুব কমই দেখেছে। দীর্ঘদেহী, চৌকস, সুদর্শন আর আভিজাত্যপূর্ণ এক সৌম্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে নিশ্চয়ই মুগ্ধ হয়েছিলেন সেদিনের বিশ্বনেতারা। এরপর তার ভরাটগলায় বাংলা উচ্চারণ! ১৯১৩ সালে এক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উঁচু আসনে তুলে ধরেছিলেন, তার একষট্টি বছর পরে আর এক বাঙালি বিশ্বসভায় বাংলা ভাষাকে উঁচু আসনে তুলে ধরেন।
১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকো। সেই পথও এভাবেই তৈরি হয় নিশ্চয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার দেহভঙ্গিমায় সকলকে সম্মান জানান এবং জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির পার্লামেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সেই অধিবেশনে যোগদান করায় সবার মধ্যে সন্তুষ্টচিত্ত লক্ষ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে এই অধিবেশনে যোগদান বিশেষ সফলতারই দ্যোতক। এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শুধু ১৯৭১-এর বাংলাদেশকেই তুলে ধরেননি। বাংলাদেশ কেন সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল, কী তার ত্যাগ, কোন ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রটির- এসব ইতিহাস চমৎকারভাবে উঠে আসে বক্তৃতায়। বক্তৃতার শুরুতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাঙালি ‘জাতি’র কথা। তিনি জানেন, বাঙালি জাতির বাস শুধু নবগঠিত দেশ বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহারসহ বহির্বিশ্বেও। এটি জেনেই তিনি বলেছেন, বহু শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মুক্ত জীবনযাপনের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাঙালির দীর্ঘসংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“স্বাধীনভাবে বাঁচবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচবার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করেছে, তারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে বাস করবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।” (হোসেন, ২০১২ : ৩৯৭)
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বিশ্বমুদ্রাস্ফীতি, কৃষিযন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি, বিশ্ব-অর্থনীতির বিপর্যয়কালের কথাও স্মরণ করে বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত গড়ে তুলতে হবে। তিনি বাংলাদেশে নানা বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির কথাও উল্লেখ করেন তার ভাষণে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। তারপর একাধিকবার বন্যা ও খরাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখেও পড়তে হয় দেশটিকে। এই বিপর্যয়ে সহায়তাদানের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা জানান জাতিসংঘের প্রতি। তবে তিনি এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বহু অনুন্নত দেশের অবস্থাও। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের গরিব দেশগুলোর নেতার মতো বলেন, উন্নত বিশ্ব যদি সমন্বিতভাবে এগিয়ে না আসে তাহলে বিশ্বে এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, যার দৃষ্টান্ত মানব-ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি পুঁজির পাহাড়গড়া কিছু মানুষের কথাও উল্লেখ করে বলেন, এরই মধ্যে কিছু মানুষ পুঁজির দাপটে বিত্তবৈভবের যে ভোগবাদী অবস্থান নিয়েছে, তারও উদাহরণ বিরল। বঙ্গবন্ধুর এই কথার মধ্যে কিন্তু তার জীবনদর্শনও প্রতিফলিত হয়। তিনি শোষিতের নেতা এবং শোষকশ্রেণির কারণেই যে সমাজে সব সংকটের সূচনা- এই কথা তিনি তার বিশ্ববক্তব্যে এভাবেই উল্লেখ করেন। আদতে বঙ্গবন্ধু তার এই বক্তৃতায় সমকালীন বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্টভাষায় বলেছেন-
“একদিকে অতীতের অন্যায় অবিচারের অবসান ঘটাতে হয়েছে, অপর দিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। আজকার দিনের বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বেছে নেবে তা নিয়ে সংকটে পড়েছে। এই পথ বেছে নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়িয়ে তুলে এগিয়ে যাবো অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাবো যে বিশ্ব মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করে তুলবে এবং যে বিশ্ব কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করবে।” (হোসেন, ২০১২ : ৩৯৯)
বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে তার নিজের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলেন যে, বাংলাদেশ প্রথম হতেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে। কেবল শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে সক্ষম করে তুলবে বলে মত দেন তিনি। মানবিক ঐক্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণ, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা বর্তমান সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে তিনি বক্তৃতায় দৃঢ়ভাবে বলেন; আর এর প্রতি তিনি সমর্থন ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর এই বাংলায় বক্তৃতার সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে তার কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করার রীতি চালু করেন।
বাংলাদেশের বাইরে বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত এই বাংলা বক্তৃতাগুলো জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ববাসীর কাছে সগর্বে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার হিসেবে বাংলায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা তিনটি ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে আছে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়