প্রায় ১ লাখ থেকে ২ লাখ বছর আগে আদি মানুষের পরিবর্তিত জিন এমনভাবে কাজ করে যাতে জিভ ও মুখের পেশি অধিকতর সংবেদনশীল এবং গতিময় হয়ে ওঠে। এ কারণেই শব্দ উচ্চারণ সহজ হয়ে ওঠে এবং উৎপত্তি হয় ভাষার। জিনের ক্রমাগত বিবর্তন মানুষের জন্মগত আক্রমণাত্মক মনোভাবকে আপেক্ষিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তি ও সহাবস্থানের প্রবণতাকে জাগিয়ে তোলে। আর এই শান্তিময় সহাবস্থানের পেছনে যা সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হলো- ভাষা। এভাবেই আদি মানবের মধ্যে উদয় হয় সৃজনশীলতা ও সহমর্মিতা।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সব ভাষার আদিভাষা এক ও অভিন্ন। আদি মানবের পূর্বপুরুষদের মতো ভাষার জন্মও আফ্রিকায়। তাদের মতে, মানুষ পূর্ণাঙ্গ ভাষা খুঁজে পায় প্রায় ১ লাখ বছর আগে।
ব্রিটেনের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ড. কোয়েন্টিন অ্যাটকিনসল ৫০৪টি ভাষা নিয়ে গবেষণা করে দেখেন যে, কিছু ধ্বনি আছে যেগুলো লক্ষ বছর আগে লৌহযুগের মানুষ ব্যবহার করত। তাদের মতে, পৃথিবীর নানা ভাষায় এর ৭০ হাজার বছর পর আফ্রিকা থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ ছড়িয়ে পড়ার পরই পরিবর্তন হয় ভাষার। আজও আদি ভাষার কিছু ধ্বনি রয়ে গেছে।
এ ক্ষেত্রে লেখক মনে করেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষের জন্ম, তাদের মিশ্রণে সৃষ্টি হয় নতুন মানুষ। নানা কারণে তাদের ঐক্য রয়ে গেছে। ঐক্য রয়েছে স্বরতন্ত্র সৃষ্টি এবং তা কণ্ঠনালীর ওপরে উঠে আসার বিষয়। তাদের ঐক্যের কারণে মানুষের ব্যথা, বেদনা, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা স্বরতন্ত্রে যে কম্পন সৃষ্টি করে এর মধ্যে সামঞ্জস্য থাকাটাই স্বাভাবিক, কেননা গঠনতান্ত্রিকভাবে মানুষের Vocal cord-এর মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন ফুসফুসের বায়ু ধারণক্ষমতা এবং কার্যক্রিয়া অনেকটা একই রকম। তারপরও পরিবেশ, বায়ুর চাপ, তাপমাত্রা, জীববৈচিত্র্য এবং তার ধ্বনির একটা প্রভাব রয়েছে ভাষার ওপর।
তুষারাবৃত পার্বত্যাঞ্চলে মানুষ যেভাবে শব্দ উচ্চারণ করে, মরুভূমির পার্বত্যাঞ্চল বা গিরিখাতে মানুষ সে রকম ধ্বনি প্রকাশ করে না, নদীর তীরে মানুষ যেমন টেনে টেনে উচ্চস্বরে ধ্বনি প্রকাশ করে, উষ্ণ দিনে গাছের নিচে তা কখনই করে না। উচ্চ মালভূমি অঞ্চলের সঙ্গে সমুদ্রস্তরের একই রকম পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে নদী অববাহিকা অঞ্চলের মানুষের ভাষা ও ধ্বনির মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। যেমন ভলগা ও গঙ্গাতীরের মানুষ মাতাকে মা অথবা আম্মা বলে, বাবাকে বাবা বা আব্বা বলে। ইরান দেশে বাবাকে পেদার ও ইউরোপে ফাদার বলে। উভয় অঞ্চলে মাকে মাদার বলে। এরা উভয়ই আর্য রক্তধারার ধারক।
ধ্বনি উচ্চারণে ফরাসিদের সঙ্গে ফারসিভাষীদের একটা মিল লক্ষণীয়। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়।
বোধগ্রাহ্য অর্থময় ধ্বনিকে ভাষা বলে। বহু বিভক্ত প্রাচীন বঙ্গাল এলাকার ভাষা এই বাংলা। বাঙালির ভাষা আর্যগোষ্ঠীর। অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা হলো- খাসিয়া, শবর, কোল ইত্যাদি। দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা হলো- তামিল, তেলেগু, মালায়লাম, কানাড়ি প্রভৃতি। আর্যগোষ্ঠীর আদিভাষা বৈদিক ও প্রাকৃত (সংস্কৃত)। পরবর্তীকালে তা বিবর্তিত হয়ে বাংলা, হিন্দুস্তানি, মারাঠি, গুজরাটি ইত্যাদি ভাষার সৃষ্টি করে। তবে এটা স্মর্তব্য যে, এই ভাষা দ্রাবিড় বা আর্য জাতির পরিচায়ক নয়। ভাষাগোষ্ঠীর পরিচয়মূলক নামমাত্র। এই দৃষ্টিতেই ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষাসংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিচার করতে হবে। তিনি বলেছেন, Bengali is a member of the Indic group of the Indo Iranian or Aryan Branch of the Indo-European family of Language. ১৯১১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলা ভারতের সর্ববৃহৎ একক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ছিল। সে সময় ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬৭হাজার ৯শ ১৫ জন ভারতীয় মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।
বাংলা ভাষা অন্যান্য আধুনিক ভাষার মতো একটি মিশ্রভাষা। এ ভাষায় নানা জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষা মিশ্রিত হয়েছে। শুরুতেই বহু দ্রাবিড় শব্দ তৎসম শব্দ রূপে বাংলায় সংযুক্ত হয়। এর মধ্যে বহু তামিল ও কানাড়ি শব্দ রয়েছে। অল্প হলেও সংযুক্ত হয়েছে চীনা ও অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা। প্রচুর ফার্সি শব্দ বাংলাকে এমন সমৃদ্ধ করেছে যে, তা বাদ দিলে বাংলাভাষা কিছুটা হলেও জরাজীর্ণ হবে। আরবি, তুর্কি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি রয়েছে বাংলায়। এই মিশ্র জাতিগত, ভাষাগত, শঙ্কর-মিশ্রণ বাঙালি জাতির ঔদার্য এবং সহনশীলতার কথাই ব্যক্ত করে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক-গবেষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা।