রাষ্ট্রভাষা আন্দোলের সফল পরিণতির মধ্য দিয়েই একদিন স্বাধীনতা এসেছিল। তরুণ শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু মুজিব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েই হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় নেতা। কিন্তু এত দিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে খুব ছোট করে দেখানো হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন বলে তিনি আন্দোলনে ছিলেন না, সেটা বোঝানো হতো।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর আক্রোশের শিকার হয়ে কারাগারে ছিলেন, সেই কঠিন সত্যটাকে অর্বাচীনরা সুকৌশলে এড়িয়ে যেত। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক নেতাই গ্রেপ্তার হতেন, আবার খুব অল্প সময়ের মধ্যে ছাড়াও পেতেন। কিন্তু সেদিনের তরুণ শেখ মুজিব শাসক গোষ্ঠীর কাছে এতটাই প্রাসঙ্গিক ছিলেন যে তাকে ছেড়ে দেয়ার সাহস করত না। সত্য কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায় না। আজ সঠিক ইতিহাস স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এমনকি দুটি দেশের সীমান্ত এক না হওয়া সত্ত্বেও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি অদ্ভুত রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। তখন সমগ্র পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা, সেখানে মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। সেই উর্দু ভাষাকেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।
তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল বাঙালিকে দাবিয়ে রেখে শোষণ ও শাসন করার এক গভীর ষড়যন্ত্র। বাঙালিরা যাতে পূর্ব বাংলার নেতৃত্ব দিতে না পারে, তারা যাতে লেখাপড়া, সংস্কৃতিকে ধারণ করতে না পারে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে- সে জন্য মাতৃভাষার পরিবর্তে বিদেশি ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। তাদের এই ষড়যন্ত্র সফল হলে বাঙালি আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না, আজকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকায় আগমন করে ১৫০ মোগলটুলীতে ওঠেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। ঢাকায় এসেই মুসলিম লীগবিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি প্লাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেন। যার ফলে শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দিন, শামসুল হক, তাজউদ্দীন, তসাদ্দক আহম্মেদ প্রমুখ ব্যক্তির উদ্যোগে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর আলোচনায় ভিত্তিতে ঢাকায় গঠিত হয় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সংগঠনটি তখন সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সংগঠন।
সংগঠনটিতে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও ভাষা নিয়ে তাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনগণের ওপর ছাড়িয়ে দেয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’
১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৪৮ সালের এই দিনে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ‘বাংলা ভাষা দিবস’ পালনের সিন্ধান্ত হয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই শ শ ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে। সবার সামনে তৎকালীন অকুতোভয় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। সেদিনই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করতে হয় শেখ মুজিবকে। ১৫ মার্চ তিনি মুক্তি পান। এরপরই ভাষা আন্দোলনকে রাজধানীর বাইরে ছড়িয়ে দিতে জেলা সফর শুরু করেন। আন্দোলনটিকে শুধু ছাত্রদের মধ্যে না রেখে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে ভাষা আন্দোলনের দাবিকে গণদাবিতে পরিণত করেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হলে বঙ্গবন্ধু জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার এক মাস পর জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জেলখানা থেকে মুক্ত হয়েই আবার ভাষা আন্দোলনসহ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাজপথে নেমে পড়েন। ২৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগের এক সমাবেশে ছাত্রলীগের ১০ দফাকে সমর্থন করে জোরালো বক্তব্য দেন। এই দফাগুলোর অন্যতম প্রধান দফা ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তুখোড় যুবনেতা শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছেন। সে জন্য বাববার শাসকদের আক্রোশের শিকার হয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে। জননিরাপত্তা আইনে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে একটানা দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় কারাগারে ছিলেন। কারাগারে বসেই তিনি নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন। বন্দিদশা থেকেও তিনি নীরব থাকেননি, দাবির সমর্থনে জেলের মধ্যে নিজে অনশনে থেকেছেন এবং আন্দোলনকে গতিশীল করতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
২৬ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দিল উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এ ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তান, বিশেষ করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বঙ্গবন্ধু তখন কারাবন্দি হিসেবে ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। সেখান থেকে সংগ্রাম পরিষদকে দূত মারফত খবর দিলেন ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল করে আইনসভা ঘেরাও করা যায় কি না, সেটা বিবেচনা করতে। কারণ, সেদিন ছিল পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন।
৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার ছাত্র সমাবেশ থেকে ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতালের ডাক দেয়া হয়। কর্মসূচি ঘোষণার পরই সরকার এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী গোয়েন্দা মারফত জানতে পারে যে, শেখ মুজিব হাসপাতাল (কেন্দ্রীয় কারাগার) থেকে দূত মারফত আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এরপর সরকারি সিদ্ধান্তে ১৫ ফেব্রুয়ারি তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারে ফরিদপুরে যেতে হতো। ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে পৌঁছানোর আগেই হাজার হাজার নেতা-কর্মী ঘাটে উপস্থিত হন। পুলিশের বাধা অতিক্রম করে ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল সফল করতে জনতার উদ্দেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য ও আন্দোলন সফল করতে নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনা দেন শেখ মুজিব।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করলে পাকিস্তানি শাসকদের বর্বরতায় রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার নিহত হন। ভাষার জন্য বাংলার বীর সন্তানদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এই দিনটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল- ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। গুলি করার তো কোনো দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলযোগ সৃষ্টি করার কথা তো কেউ চিন্তা করে নাই। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।’
বিক্ষুব্ধ জনতার দাবির মুখে ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি পেয়েই তিনি সারা দেশ ঘুরে জনমত গঠন করে হত্যার প্রতিবাদ ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি করেন। ১৯৫২ সালের ৩০ মে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে গিয়েও রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবির সঙ্গে সরকারের দুর্নীতি ও পাটচাষিদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে জোরালো বক্তব্য দেন।
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীতে মিছিল ও আরমানিটোলার সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে তিনি বলেছিলেন, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালনকালে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন।
আজন্ম বাংলা ভাষাপ্রেমী বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়েছেন। সরকারি অফিসের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। আবার ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে নিজের প্রথম বক্তব্য বাংলা ভাষায় দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাকে তুলে ধরেছেন। বাংলাকে তিনি হৃদয়ে ধারণ ও লালন করতেন। যখনই বাংলা ভাষার জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, তখনই সবটুকু উজাড় করে করেছেন।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।