বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আইনের নিজস্ব গতি আছে?

  •    
  • ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৩:৪০

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বিএনপির পুরো পাঁচ বছরে বঙ্গবন্ধুহত্যা মামলাটি ডিপ ফ্রিজে ছিল, এক ইঞ্চি অগ্রগতিও হয়নি। বিএনপির তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাফল্যের সঙ্গে মামলাটি আটকে রাখতে পেরেছিলেন। ব্যারিস্টার মওদুদের অনেক অপকর্ম আছে। কিন্তু তিনি কি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আটকে রাখা নিয়ে নিজের বিবেকের সঙ্গে কখনও প্রশ্নোত্তর করেছেন? ’৭৫-এর পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রেখে জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে দেয়নি।

প্রায়ই একটা কথা শুনি- আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু এরচেয়ে বড় মিথ্যা খুব বেশি নেই। বাস্তবতা হলো, আইনের নিজের কোনো গতি নেই। কখনো অর্থ, কখনো প্রভাব, কখনও দাপট, কখনও আইনজীবীর চাতুর্যে আইনের গতি নির্ধারিত হয়। কখনও নিরপরাধ ব্যক্তি যেমন সাজা পেয়ে যায়, তেমনি অনেক সময়পার পেয়ে যায় অপরাধীও। এমনিতে আইনের মূল কথা হলো, ১০ জন অপরাধী পার পেয়ে যাক, কিন্তু কোনো নিরপরাধ যেন সাজা না পায়। কিন্তু প্রায়ই আমরা খবর পাই- ভুল তদন্ত, তদন্তকারীর খামখেয়ালি, নামের মিল ইত্যাদি নানা কারণে নিরপরাধব্যক্তিকেও সাজা পেতে হয়।সিনিয়র সাংবাদিক মহসিন আব্বাসের কাছে শোনা একটি গল্প এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। গরিব আর গরিবের মধ্যে আইনি লড়াই হলে দুজনই ধ্বংস হয়ে যায়।ধনীর সঙ্গে গরিবের আইনি লড়াই হলে গরিব ধ্বংস হয়ে যায়। আর ধনীতে ধনীতে আইনি লড়াই হলে আইন ধ্বংস হয়ে যায় বা আইন বদলে যায় কিংবা আইন কেনা হয়ে যায়।মামলা-মোকদ্দমা, আদালতকে আমার বড্ড ভয়। ন্যায়বিচার পেতে হলেও দিনের পর দিন আদালতে যেতে হয়, উকিলকে পয়সা দিতে হয়। মামলা যত ন্যায্য আর সত্যই হোক অর্থ আর সময় একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশের কোনোআদালতে কদিন গেলেই আপনি টের পাবেন কত মানুষের আহাজারি, কান্নায় ভারী হয় আদালত চত্বর।

বাংলাদেশে সত্য মামলা যেমন আছে; মিথ্যা মামলা আছে, আছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, রাজনৈতিক মামলা আছে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মামলা আছে। এমনকি প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের ক্ষতি করে মামলা করারনজিরও কম নয়। ধরুন একজন নিরীহ-গরিব কোনো একজন সম্পদশালী বা প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা করলো। এখন সম্পদশালী লোকটি শহরের সেরা আইনজীবীকে নিয়োগদিতে পারবে। আর গরিব মানুষটি নিয়োগ দিতে পারবে একজন নিরীহ উকিলকে। এখন যতই প্রমাণ আর সাক্ষি-সাবুদ থাকুক, চতুর আইনজীবী কিন্তু তার মক্কেলকে বাঁচিয়ে দিতে পারেন। প্রয়োজনে সাক্ষি কেনাবেচার ঘটনাও ঘটে বাংলাদেশে।আবার প্রভাবশালী কারো বিরুদ্ধে সাক্ষি দিতেও ভয় পান অনেকে। প্রভাবশালীদের মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার উদাহরণও কম নয়।আইনের নিজস্ব গতির অজস্র উদাহরণ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এই ২১ বছর বাংলাদেশে একটি কালো আইন ছিল। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পরিচিত সেই আইনে সপরিবারে রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে আইন অপসারণ করা হয়। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চাইলে দ্রুত বিচার করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসি দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিয়েছিলেন। তাতে প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা তার পরিবারের খুনিদের বিচার শেষ করে যেতে পারেননি।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বিএনপির পুরো পাঁচ বছরে বঙ্গবন্ধুহত্যা মামলাটি ডিপ ফ্রিজে ছিল, এক ইঞ্চি অগ্রগতিও হয়নি। বিএনপির তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাফল্যের সঙ্গে মামলাটি আটকে রাখতে পেরেছিলেন। ব্যারিস্টার মওদুদের অনেক অপকর্ম আছে। কিন্তু তিনি কি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আটকে রাখা নিয়ে নিজের বিবেকের সঙ্গে কখনও প্রশ্নোত্তর করেছেন? ’৭৫-এর পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রেখে জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতে দেয়নি।

আওয়ামী লীগ যখন সেই বাধাটি দূর করে দিল, তারপরও বিএনপি কেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ এগিয়ে নিলো না? এই প্রশ্নের উত্তর কি বিএনপির কারো কাছে আছে? এখন যখন বিএনপির প্রতি বর্তমান সরকার নানানঅত্যাচার-নির্যাতন, সত্য-মিথ্যা মামলা করে, হামলা করে, গুম-খুন করে; আমরা তার নিন্দা জানাই। কিন্তু বুঝি এটা আসলে প্রতিশোধ। আমি জানি, একটা অন্যায়, কখনো আরেকটা অন্যায়ের যুক্তি হতে পারে না। তবে বিএনপি এত বেশি অন্যায় করেছে বলেই আজ তাদের প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হতে হচ্ছে। এবার বলুন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ক্ষেত্রে আইনের নিজস্ব গতি কোনটা? ’৭৫-এর পরের ২১ বছর, নাকি আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর, নাকি বিএনপির পাঁচ বছর?আইনের নিজস্ব গতির আরেকটা ক্ল্যাসিক উদাহরণ হলো মঞ্জুর হত্যা মামলা। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। তখন চট্টগ্রামের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর আত্মগোপনে যাওয়ার পথে তাকে পুলিশ আটক করে। এরপর ২ জুন মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে হাটহাজারী থানার পুলিশ হেফাজত থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ করা হয়, এরশাদের নির্দেশে ঢাকা থেকে তার বিশ্বস্ত সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রামে গিয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করেন। এত বড় ঘটনার মামলাই হয় ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালে। ঘটনার ৪০ বছর পার হচ্ছে, মামলার বয়সও ২৫ হয়েযাচ্ছে, কিন্তু মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচার আর শেষ হচ্ছে না। এর মধ্যে কত তদন্ত হয়েছে, কত বিচারক বদল হয়েছে, কতবার তারিখ পড়েছে; তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন ঘরানার হলেও এরশাদ যে মৃত্যুর আগের এক যুগ আওয়ামী লীগের পোষা হয়ে থাকলেন, তার মূল চাবিকাঠি কিন্তু এই মঞ্জুর হত্যামামলা। এই মামলার ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন এরশাদের মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে।মাঝে মাঝে তিনি মুক্তির জন্য ডানা ঝাপটাতেন। সরকারের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতেন। তখনই মঞ্জুর হত্যা মামলার একটা তারিখ পড়তো। আর এরশাদের সব বিপ্লব ফুরিয়ে যেত। সম্প্রতি এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেযেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুল লতিফ।

মারা যাওয়ায়তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ মামলায় এ দুজনই মূল অভিযুক্ত। বাকি তিন আসামিও জামিনে আছেন। এরশাদের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের কাছে মঞ্জুর হত্যা মামলার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। এই প্রিয় অস্ত্রটি আর কোনো কাজেরনয় এখন। আমার ধারণা মামলাটি আবার ফ্রিজে চলে যাবে। এবার বলুন, মঞ্জুরহত্যা মামলার ক্ষেত্রে আইনের নিজস্ব গতি কোনটা?

হঠাৎ আইনের গতি নিয়ে আমার এত মাথাব্যথার কারণ তুফান সরকার। এই নামটি নিশ্চয়ই আপনাদের সবার পরিচিত। ২০১৭ সালে বগুড়ায় এক ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং মা-মেয়েকে নির্যাতনের পর মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রধান আসামি ও শহর শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়কতুফান সরকার।

ঘটনাটি তখন ‘তুফান’ সৃষ্টি করেছিল সারা দেশে। কিন্তু সম্প্রতি এ মামলায় জামিন পেয়েছেন তুফান। খবরটি শুনে নিশ্চয়ই আপনারাও অবাক হয়েছেন? এত বড় ঘটনায় জামিন হয় কীভাবে? হয়েছে, কারণ ভিকটিম ও তার মা, যিনি আবারমামলার বাদী, আদালতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন। তুফানের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই বলেও আদালতকে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তাদের কাছ থেকে জোর করে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। ভুল বোঝাবুঝি থেকে মামলাটিহয় বলেও তারা আদালতকে জানিয়েছেন।

এরপর আসলে জামিন দেয়া ছাড়া আদালতের আর কিছু করার থাকে না। পরে অবশ্য গণমাধ্যমে ভিকিটিম এবং তার মায়ের উলটো সাক্ষ্যের রহস্য ফাঁস হয়েছে। তুফানের পরিবার ৪০ লাখ টাকায় আপস করেছে।হয়তো আপস করা ছাড়া ভিকটিমের পরিবারের আর কিছু করার ছিল না। কিন্তু এটা তো প্রমাণ হয়ে গেল, আইনের নিজের কোনো গতি নেই। চাইলে টাকা দিয়ে আইন কিনে নেয়া যায়।উদাহরণ দিলে সারাদিন দেয়া যাবে, মহাভারত লেখা যাবে। কিন্তু বার বার প্রমাণিত, আইনের নিজস্ব কোনো গতি নেই। তাই কেউ যদি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, বলে; আমার খালি হাসি পায়।লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর