বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

  •    
  • ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৭:৫৯

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতা; এভাবেই বলা হয়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, এভাবেই অনেকে বলতে পারেন। এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ পদক্ষেপ গ্রহণের পেছনে রয়েছে জাতিসংঘ।

একুশে ফেব্রুয়ারির আবেদন অফুরান। তবে দিনটি হঠাৎ করে আসেনি। ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ গানটি যখন কোথাও বেজে ওঠে কিংবা এমনকি সুরটিও শোনা যায়- আমাদের দেহ-মনে সৃষ্টি হয় অনন্য উন্মাদনা। সব বয়সের মানুষের কাছে এর আবেদন রয়েছে। এ গানের জন্য গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ অমরত্ব লাভ করেছেন, সন্দেহ নেই। এখন দুই শতাধিক দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে এ গানটি শোনা যায়।

আলতাফ মাহমুদ একুশের গানের সুর দিয়েছেন ১৯৫৩-১৯৫৪ সালের দিকে। ১৯৭১ সালে তাকেই আমরা দেখি অন্য ভূমিকায়- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সক্রিয় যোদ্ধা। তিনি প্রাণ দিলেন এ মহান সংগ্রামে। একুশের গানের সুর দিয়েছিলেন ২০-২১ বছর বয়সে (১৯৩৩ সালে জন্ম), আর একুশের পথ ধরে যে স্বাধীনতা- সেই মহান সংগ্রামে জীবন দিলেন ৩৮ বছরে। এক জীবনে এত অর্জন, এমন মহৎ কীর্তি!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৪৭ সালেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন। ধর্মীয় বিভাজনের মধ্যে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালির অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের পথে বড় বাধা, তরুণ বয়সেই এ উপলব্ধি আসে তার। মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই সংগঠন, সেটা বুঝতেও সময় লাগেনি।

এ কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার মাসের মধ্যেই গড়ে তোলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি)। শুরুতেই বিবেচনায় ছিল, সাম্প্রদায়িক সংগঠন দিয়ে দাবি আদায় করা যাবে না। তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় জনমনে বিভ্রান্তি ছিল, সেটা বিবেচনায় রেখেছেন। একই বিবেচনা কাজ করেছিল ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময়। তখন তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিজীবনে। তার বিরুদ্ধে তখন অভিযোগ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থনদান। এই অভিযোগে তার ছাত্রত্বও কেড়ে নেয়া হয়। আরও কজনের একই অভিযোগে শাস্তি হয়। তারা মুচলেকা দিয়ে রেহাই পান। কিন্তু তরুণ বয়সেই শেখ মুজিবুর রহমান যে অদম্য! তিনি সাফ জানিয়ে দেন- আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

ছাত্রলীগ গঠনের দুই মাসের মধ্যেই আসে বড় চ্যালেঞ্জ- রাষ্ট্র্রভাষা বাংলা দাবি দিবস- ১১ মার্চের হরতাল। ২৮ বছর বয়সী শেখ মুজিবুর রহমান এ কর্মসূচি পালনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। সে সময় পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ক্ষমতায়, অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নেই। কেউ সামান্য প্রতিবাদ করলেও জেল-জুলুম নেমে আসে। মাত্র দুই মাস আগে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের বিভিন্ন জেলা কমিটি কেবল গড়ে উঠছে।

শেখ মুজিবুর রহমান জেলায় জেলায় ঘুরে এ দায়িত্ব পালন করছেন। ১১ মার্চের কর্মসূচি সফল করতেও তাকে উদ্যোগ নিতে হয়। এ ক্ষেত্রেও দেখি, রণাঙ্গনে তিনি সম্মুখ সারিতে। হরতাল সফল করায় তিনি অন্য ছাত্রদের নিয়ে পিকেটিংয়ে বসে যান সচিবালয়ের সামনে। সেখান থেকে আরও ৭০-৭৫ জনের সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্থান হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিও তিনি কারাগারে। ১৯৫০ সালের প্রথম দিনে তার স্থান হয়েছিল কেন্দ্রীয় কারাগারে। একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে তিনি অসুস্থতার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকার সুযোগ কাজে লাগান। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছাত্রলীগসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের নিয়ে পুলিশ-গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে গভীর রাতে সভা করেন। তিনি নিজেও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অনশন ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেন।

মুসলিম লীগ সরকার এসব জানতে পেরে তাকে হাসপাতাল থেকে ঢাকার জেলে স্থানান্তর করে। তাদের ভয় ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয় নেতা অনশন করলে ঢাকার আন্দোলন আরও বেগবান হবে। এ কারণে তাকে সরিয়ে নেয়া হয় ফরিদপুর কারাগারে। কিন্তু জীবন নিবেদিত যার মুক্তির সংগ্রামে, তাকে কে রুখবে? তিনি ফরিদপুর কারাগারেই অনশন শুরু করেন। সালাম-বরকত-শফিক-রফিকের আত্মদানে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সফলতা লাভ করার ছয় দিন পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। একটানা দুই বছরের বেশি বন্দিজীবন এবং কয়েক দিনের অনশনে শরীর তার ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু মুক্তির দুই মাসের মধ্যেই (২৬ এপ্রিল, ১৯৫২) নতুন বড় দায়িত্ব অর্পিত হয়- আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কাজেও তাকে সক্রিয় অংশ নিতে হয়। মুক্তির পরপরই সরকারি নির্দেশ যায়- শেখ মুজিবের ওপর তীক্ষ্ন নজর রাখ- যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করতে হতে পারে।

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতা; এভাবেই বলা হয়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীনতার পর ‘বাংলা’ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয়। জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সাধারণ পরিষদের সভায় প্রথম যে ভাষণ প্রদান করেন, ভাষা ছিল বাংলা।

আমাদের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, এ যে বড় অর্জন। একই সঙ্গে অনেক দায়ও এসে বর্তায়। বাংলা ভাষা বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি লোকের ভাষা। এর মধ্যে বাংলাদেশে বসবাস করে ১৬ কোটির মতো। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ। সাহিত্য সমৃদ্ধ। বিশ্ববাসীর কাছে এসব পৌঁছাতে হলে আমাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি নিজেই অনুবাদ করেছিলেন। আমাদের অনেক কবি-সাহিত্যিকের রচনা বিশ্বমানের। বিভিন্ন ভাষাভাষীর কাছে তা পৌঁছে দিতে অনুবাদের কাজটি প্রধানত আমাদেরই করতে হবে। কারও কারও রচনা হয়ত ইংরেজি, চীনা বা স্প্যানিশ ভাষাভাষী কারও নজরে পড়বে। এ কারণে কিছু উদ্যোগ দেখা যাবে।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা বা আমার দেখা গণচীন- এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশে অনেক দেশের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। যুগ যুগ ধরে এমন মূল্যবান সাহিত্যকীর্তি কী করে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, সেটা বড় বিস্ময়। বঙ্গবন্ধু কারাজীবনে বসে এসব লিখেছেন। প্রথম দুটি গ্রন্থ ১৯৬৭ সালের দিকে রচিত, যখন ছয় দফা প্রদানের কারণে তার ফাঁসির দণ্ডের গভীর শঙ্কা। এমন ভয়ংকর সময়ে ধীরস্থিরভাবে লিখে গেছেন আমাদের জাতির পিতা। নির্ভীক তিনি, কতভাবেই না প্রমাণ রেখে গেছেন! তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি রাষ্ট্রীয় ও অন্য কাজে শত ব্যস্ততার মধ্যেও এসব গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিরবচ্ছিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোও তথ্যভাণ্ডার। জাতির পিতাকে নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান, তারা এসব থেকে অনেক কিছু জানতে পারবেন। আমজনতাও জানছে অনেক কিছু। আমাদের লেখক-গবেষক এসব কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বসমাজের কাছে বিশেষভাবে তুলে ধরবেন, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর