প্রায় ১৭৫ বছর আগে বাংলা কবিতার নতুন ছন্দের অনন্য রূপকার ও বাংলা ভাষার আধুনিকায়নে অপূর্ব অবদান রাখা মাইকেল মধুসূদন দত্ত যৌবনে ইউরোপের নীলনয়না নারীর স্বপ্ন দেখেছিলেন। যিনি শেকসপিয়ার আর মিল্টনের দেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং তাদেরই একজন হবার অন্বেষায় ইউরোপের প্রবাসে অনেক ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে বাংলা ভাষার কাছে ফিরে এসেছিলেন। রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত বঙ্গভাষা কবিতা –“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন- তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।”
বাংলা ভাষার ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯২৬ সালে প্রমাণ করেন যে, চর্যাপদ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছরের কাছাকাছি। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, বাংলা পৃথিবীর অন্য ভাষার তুলনায় কম সমৃদ্ধ অথবা কম ঐতিহ্যবাহী নয়।
বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে অজস্র সমৃদ্ধ কাব্যগ্রন্থ, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ সাহিত্য, ছোটগল্প এবং সংগীত। বিশ্ব মানবের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেই বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সংস অফারিংস’ (গীতাঞ্জলি) রচনা করে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সেটা তার জন্যে এমন কোনো মনিহার নয়। আমি রাশিয়া, চীন, জাপান, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় তার বিশাল সাহিত্য ভান্ডার অনুবাদ দেখেছি যা পৃথিবীর অন্য কোনো কবির এ সৌভাগ্য হয়নি। রবীন্দ্রনাথের যৌবনের প্রায় ৭-৮ বছর কেটেছিল আমাদের বঙ্গের (পূর্ববঙ্গের) শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুরে।
আমাদের দেশের চারণকবি গগন হরকরার ‘আমার মনের মানুষ যারে, কোথায় গেলে খুঁজে পাব তারে’ গানের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথের কলমে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির বীজ রোপিত হয়। বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলনের সময় ১৯০৫ সালে রচিত হয় এই গান এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই গানটিকেই বেছে নিলেন আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অমূল্য গ্রন্থ ‘ছিন্নপত্রে’ লিখেছেন এই বঙ্গে না এলে তিনি পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথ হতে পারতেন না।
আমাদের মহাত্মা, লালন শাহ, শাহ আব্দুল করিম, পালাগান রচয়িতারা, পুথি রচয়িতারা, কবি মুকুন্দ দাশ আমাদের গৌরবান্বিত করেছেন। বাংলা ভাষায় রচনা করে যদি নোবেল পুরস্কার লাভ করা যেত, তাহলে ১০ জনের বেশি বাংলা ভাষায় সাহিত্যস্রষ্টাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করতে হতো।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জীবনানন্দ দাশ, সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সাহিত্যিক আবুল ফজল, কবি শামসুর রাহমান, সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ আমাদের দেশের সাহিত্যসম্ভারকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছেন।
পাশাপাশি, আমি পশ্চিমবঙ্গ যা ভারতের একটি প্রদেশ, সেখানকার অত্যন্ত স্বনামধন্য ও বিশ্বমানের ১০ থেকে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করতে পারি, কিন্তু তাদের তালিকা দীর্ঘ হবে বলে নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম।
বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের জন্যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে আমাদেরকে অনেক নিগৃহীত হতে হয়েছিল। অবশেষে ১৯৫২ সালে রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হই। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন থেকে আমাদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আপ্রাণ সংগ্রাম করেছিলেন। তারই নেতৃত্বে আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের মর্যাদা লাভ করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান। তিনিই জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ভাষার বৈশ্বিক মর্যাদাকে উন্নীত করেছিলেন। তারও আগে ১৯৫২ সালে চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সম্মেলনে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
আজ বাংলা ভাষা একটি বিশ্বমানের সমাদৃত একটি ভাষা। কোনো জাতি আজ পর্যন্ত ভাষার অধিকার অর্জনের জন্যে রক্তদান করেনি। আমাদের বাংলা একাডেমি একটি সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান। বাংলা ভাষায় আমরা বিশ্ব-সাহিত্য অনুবাদ অথবা রূপান্তর করে আমাদের নিজেদের সাহিত্য সম্ভারের সঙ্গে যুক্ত করেছি। এভাবেই আমরা পরকে আপন করে চলেছি।
সবশেষে বলব, আমরা অনেকেই আজ বাংলা ভাষার ইংরেজির মিশ্রণ ঘটিয়ে কথা বলি। সেটা পরিহার করা উচিত। এতে বাংলা ভাষার সম্মান কমে যায়। আজকাল প্রায়ই দেখি ও শুনি যে, অনেকেই ভুল বাংলা শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি টেলিভিশন মাধ্যমকে তা সংক্রমিত করেছে। যেমন, ‘দারিদ্র্য’কে দারিদ্রতা বলে (দারিদ্র্য অথবা দরিদ্রতা)। ‘সখ্য’কে সখ্যতা বলে। আমার সঙ্গে অমুকের ‘সখ্য’ আছে (সখা থেকে সখ্য) ‘সখ্যতা’ নয়। এমন আরও অনেক ভুল বাংলা শব্দ আমরা নিত্যদিন ব্যবহার করি।
ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দান করেছে, যা জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত হয়।
এবারকার অমর ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের দেশের অঙ্গীকার হওয়া উচিত আমরা বাংলা ভাষাকে আরও উন্নত করব এবং উন্নত ভাষার শিখরে নিয়ে যাব।
জয় আমার মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।
লেখক : মঞ্চ সারথি, লেখক-নাট্যকার, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।