‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।’…
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোবাসাকে কেন যাতনাময় বলেছিলেন ইতিহাস ঘাঁটলে জানা গেলেও যেতে পারে। কিন্তু আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সে চেষ্টা আমরা না-ই করি।
কবিগুরু ভালোবাসাকে যে শুধু যাতনাময় বলেছেন, তা তো নয়। ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’, ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’, ‘এই সুরে কাছে দূরে’… এসব গানে তো তিনি ভালোবাসাকে আহ্বান করেছেন। ভালোবাসায় ডুবে যাওয়ার কথা বলেছেন।
তার মানে ভালোবাসা কবির কাছে একেক সময় একেকভাবে ধরা দিয়েছে। আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার কবিতা-গানে।
শুধু রবীন্দ্রনাথের বেলায় এমনটি ঘটেছে, তা নয়। একেক মানুষের কাছে ভালোবাসা একেক সময় একেকভাবে ধরা দিয়েছে। কারও কাছে তা যাতনাময়, কারও কাছে গভীর সুখের।
চোখে দেখা যায় না কিন্তু মনের ভেতর অদ্ভুত ঢেউ তোলা এক অনুভূতির নাম ভালোবাসা। এই অনুভূতি নারীর প্রতি নরের। নরের প্রতি নারীর। হ্যাঁ, আমি এখানে শুধু নর-নারীর ভালোবাসার কথাই বলছি।
যুগে যুগে নর ও নারী একে অপরের প্রেমে পড়েছে। পরস্পরকে ভালোবেসেছে। অনেকের জীবনে ভালোবাসা এসেছে সহজে। অনেককে আবার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কত ত্যাগই না স্বীকার করতে হয়েছে। ছাড়তে হয়েছে জগৎ-সংসার।
‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি, দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি লাল পদ্ম’। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতায় একজন প্রেমিকপুরুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য কী কী করতে পারে, তার বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন।
এত সব করেও অনেক প্রেমিকপুরুষই তার আরাধ্য নারীকে নিজের করে পাননি। তখন জীবন হয়েছে যাতনাময়। চোখের জল হয়েছে সঙ্গী। যাতনা সহ্য করতে না পেরে জীবন দেয়ার উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি। কিন্তু তারপরও ভালোবাসা হয়। ভালোবাসা উদ্দাম, ভালোবাসা দুরন্ত।
কিশোর কুমার গেয়েছেন, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী’…। সত্যিই তো ভালোবাসা ছাড়া এই জগৎ-সংসার অর্থহীন। আসলে পৃথিবীটা টিকে আছে ভালোবাসার ওপর। পৃথিবীতে এত হানাহানি, হিংসা-যুদ্ধ, সংঘাত। তারপরও পৃথিবী টিকে আছে কী করে? সে তো এই ভালোবাসার জোরেই। ভালোবাসা নেই তো কিছুই নেই। ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। ভালোবাসা আছে বলেই সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সব গান, কবিতা। ভালোবাসাকে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে বহু গল্প, উপন্যাস, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র।
কবি নির্মেলন্দু গুণ লিখেছেন, আবার যখনই দেখা হবে, প্রথম সুযোগেই আমি বলে দেব স্ট্রেটকাট: ভালোবাসি। তার মানে ভালোবাসা প্রকাশে কোনো দেরি নয়। কাউকে ভালোবাসলে তাকে জানান সে কথা।
যদিও প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে বছরের সব দিনই ভালোবাসার দিন। তারপরও ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ তাদের কাছে বিশেষ দিন হিসেবেই ধরা দেয়। ভালোবাসার মানুষকে আরেকটু বেশি করে ভালোবাসার, আরেকটু বেশি করে কাছে পাওয়ার জন্য যেন এই দিন। অনেক প্রেমিকপুরুষ এই দিনটির অপেক্ষা করে তার প্রেয়সীকে মনের কথাটি বলার জন্য।
তা ছাড়া যে ভালোবাসা নিয়ে এত মাতামাতি তার কোনো দিবস থাকবে না, তা কি হয়? গুগল করে জানা যায়, ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সারা বিশ্বে ভালোবাসা দিবস পালিত হয়ে আসছে। তবে বঙ্গদেশের নারী-পুরুষরা এ দিবসের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে আরও বহু বছর পর।
গত শতকের নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে এ দিবস পালন শুরু হয়। বিদেশি সংস্কৃতি বলে অনেকে গালাগাল করলেও ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেনটাইন ডে পালন এখন অনেকটাই আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভালোবাসা দিবস পালন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। এ দিবসের পক্ষে ও বিপক্ষে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। তারপরও সব বিতর্ক পেছনে ফেলে আজ অনেকে দিবসটি উদযাপন করবে, প্রকাশ করবে মনের মানুষের কাছে নিজের অনুভূতি। গাইবে ভালোবাসার জয়গান।
জয় হোক ভালোবাসার। জয় হোক ভালোবাসা দিবসের। সবাইকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক