ঘুমন্ত মানুষ অবচেতন মন স্বপ্ন দেখে। মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে, তখন সে স্বপ্ন দেখে তার মাতৃভাষায়। স্বপ্নের মধ্যে মানসপটে ঘটনাগুলোর উপলব্ধি আবর্তিত হয় তার মাতৃভাষায়। তাই মানুষের সঙ্গে মাতৃভাষার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক জন্ম থেকেই ভালোবাসার। একে ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে যখন কেউ ষড়যন্ত্র করে তখন মানুষ তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতির জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রের নীতি-আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও চেহারায় ছিল ভিন্নতা। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ এই ঘোষণা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ কখনই মেনে নিতে পারেনি। তখন থেকেই বাঙালির মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫২ সালে ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশন বসলে ছাত্ররা গণপরিষদ ঘেরাও করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল করলে পুলিশ ওই মিছিলে গুলি চালায়। গুলিতে রফিক উদ্দীন, আবদুল জব্বার, শফিউর প্রমুখ শহিদ হন। এই দিনটিকে আমরা প্রতিবছর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য জীবনদান পৃথিবীতে বিরল ঘটনা।
দিনটিকে ইউনেসকো বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে থাকি ভাষাশহিদদের প্রতি। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা আরও গৌরবোজ্জ্বল পর্যায়ে পৌঁছতে পারতাম যদি ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের তাৎপর্য অনুধাবন করে বাংলাকে দেশের সবক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারতাম। মনের গভীরে গাঁথতে পারতাম নিজের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি নিরন্তন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই, দেশবরেণ্য কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বেড়ে ওঠা জমিদারপুত্র এবং প্রখর মেধাসম্পন্ন মানুষ। তিনি হতে চেয়েছিলেন শেকসপিয়ার ও বাইরনের মতো নামকরা ইংরেজ কবি। এই স্বপ্নকে সামনে রেখে তিনি ইংরেজি শিক্ষার মোহে এতটাই ব্যাকুল ছিলেন যে, ইংরেজি ভাষার চর্চায় বাংলা ভুলেই গিয়েছিলেন। যৌবনে তার আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন সবকিছুর মধ্যেই সম্ভ্রান্ত ইংরেজ পরিবারের ছাপ প্রতিভাত হয়। ইংরেজ কবি-সাহিত্যিকদের মতো হওয়ার অভিপ্রায়ে তিনি তার পিতা, প্রপিতামহের ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। বিয়েও করেন তিনি খ্রিষ্টান নারীকে। এত কিছুর পরেও কিন্তু তার শেষরক্ষা হয়নি। ভগ্নমনোরথ নিয়ে ফিরে এসেছেন নিজ জন্মভূমি ও মানুষের মাঝে। দেশে এসে বাংলা বিষয়ে পণ্ডিত রেখে তিনি আবার বাংলা শেখেন। নতুন করে বাংলা ভাষায় লেখেন তার অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য।’ বাংলা ভাষায় রচনার মাধ্যমেই তিনি হয়েছেন আমাদের মাঝে চির স্মরণীয় ও বরণীয়। তার জীবনোপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছে তার রচিত ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার দুটি চরণের মাধ্যমে- ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব/ বিবিধ রতন/ তা সবে অবোধ আমি/ অবহেলা করি/ পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি/ কুক্ষণে আচরি।’
অধুনা বাঙালি সমাজে বিত্তশালী গোষ্ঠীর মধ্যে বাংলার চেয়ে ইংরেজিকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। এ দেশের মাটি, পানি, আকাশ, বাতাস, নদী, প্রকৃতি সবকিছু থেকে তারা জীবনের নির্যাস গ্রহণ করে। শুধু নিতে চায় না ভাষাটিকে। ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয় এই ভেবে যে, জীবন গড়ে দিচ্ছেন।
আমার এক ঘনিষ্ঠজনের দুই ছেলে-মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ত। তাদের মা প্রায়ই বলতেন, ‘আমার ছেলেরা বাংলা পড়তেই পারে না।’ কথাটি বলে তিনি আবার গর্বভরে এদিক-ওদিক তাকাতেন। আমার মতে, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষায় শিক্ষার্থী ইংরেজি বলতে পারদর্শী হলেও অঙ্ক, পদার্থ ও রসায়নে তথা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে দুর্বল থেকে যায়। বাস্তব জীবনে খুব কাছ থেকে আমার পরিচিত বন্ধুদের হতাশ দেখেছি। ফোনে বা আড্ডায় তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমাদের সন্তানেরা পদার্থ, অঙ্ক ও রসায়ন ছাড়া সব বিষয়েই ভালো করছে। আপনার খোঁজে তো অনেক প্রকৌশল শিক্ষার্থী আছে। পদার্থ, অঙ্ক ও রসায়ন পড়ানোর জন্য একজন ভালো ছাত্র দেন। প্রকৃতপক্ষে, এই অভিভাবকরা বোঝেন না যে, প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তার রহস্য উন্মোচনের মাধ্যম হলো অঙ্ক ও বিজ্ঞান। এগুলোকে অনুধাবনের জন্য মাতৃভাষা সবচেয়ে বেশি কার্যকর। ঔপনিবেশিক শাসনের জের হিসেবে ইংরেজিপ্রীতি আমাদের মধ্যে রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিদেশে চাকরি করতে গেলেও ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ইংরেজি শিখতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষায় লেখা ও পড়া ভুলে যাওয়া মোটেও কাম্য নয়।
কোনো দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় বেশি হওয়ার দুটি কারণ। প্রথমত, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য সারা বিশ্বে বিপণন। এই বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়নে দেশগুলো কোনো বিদেশি ভাষার সাহায্য নেয়নি। স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত তাদের শিক্ষাদানের ভাষা নিজ মাতৃভাষা। এ দেশে এখনও আমরা পড়ে আছি ঔপনিবেশিক মানসিকতায়। কোনো সভা-সমাবেশে বাঙালির মধ্যেই ইংরেজি বলে গর্বের সঙ্গে এদিক-ওদিক তাকাই এই আত্মতুষ্টিতে যে, সমাজে আমি একজন উচ্চবংশীয় মানুষ। এই মানসিকতা যত দিন পর্যন্ত না দূর হবে তত দিন জ্ঞান বিতরণের সাবলীল মাধ্যম মাতৃভাষাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব না। আমাদের জাতিগত ও মানসিক উন্নয়ন সাধিত হবে না। আমরা পারব না দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে। নোবেল বিজয়ী কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনী এরপর ইংরেজী ভাষার গোড়াপত্তন।’ এ ছাড়া পবিত্র কোরআনের সুরা ইব্রাহিমের ৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘সব পয়গম্বরকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি যাতে তাদের পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারেন।’ সুতরাং জ্ঞানের পরিপক্ব অনুধাবনে মাতৃভাষার বিকল্প নেই।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিগূঢ় সম্পৃক্ততা ছিল। তিনি মাতৃভাষাকে সব সময় সর্বোচ্চ পর্যায়ে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে চীনের শান্তি সম্মেলনে এবং ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান মাতৃভাষার প্রতি তার অদম্য ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হলেও আজও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটাতে পারিনি। মুজিব শতবর্ষে আমাদের অঙ্গীকার থাকবে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়