বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গণহত্যা ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব

  •    
  • ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ২০:০০

যা হোক, ২০০৯ সালে তামিল এই গণহত্যা ঘটলেও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন তাদের তদন্ত রিপোর্ট গত ২৭ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে। ৪৭ সদস্যের এই তদন্ত কমিশন তাদের ওই রিপোর্টে উচ্চপদস্থ জেনারেল (যারা গণহত্যায় জড়িত ছিলেন) তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অনেক কিছু সুপারিশ করেছে। তাছাড়া ওই তদন্ত রিপোর্টে বলা হচ্ছে, কমপক্ষে ৪০ হাজার তামিলকে হত্যা করা হয় ২০০৯ সালে।

একবিংশ শতাব্দীর সব থেকে বড় গণহত্যা শ্রীলংকার তামিল গণহত্যা। যে সকল উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটালে সেটা গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে, তামিল গণহত্যায় তা স্পষ্ট। এখানে সুস্পষ্টভাবে শ্রীলংকার এই হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে।

শ্রীলংকায় বর্তমানের বৌদ্ধ ধর্মীয়বাদ ও সিংহলী ন্যাশনালিজমের জোরে বাস্তবে কোনো সংখ্যালঘু ধর্মীয় শ্রেণি সেখানে নিরাপদ বোধ করছে না। যেমন এবারের এই কোভিডে সেখানে প্রথম দোষারোপ করা হয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের। বলা হয়েছে, তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না বলে শ্রীলংকায় কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে। তারা সরকারের বিধিকে লঙ্ঘন করে এক জায়গায় সমবেত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোভিডে শ্রীলংকায় যে সকল মুসলিম মারা গিয়েছিল, তাদের শবদেহকে কবর দেবার বদলে আগুনে পোড়ানো হয়েছিল।

এর থেকে স্পষ্ট, শ্রীলংকায় কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নিরাপদ নয়। ধর্মীয়, বর্ণভিত্তিক বা অনান্য সংখ্যালঘুরা কম বেশি সব দেশেই একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কিন্তু শ্রীলংকায় এর মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। এবং ২০০৯ সালে সেখানে যেভাবে সেনাসদস্য নামিয়ে শুধু বিদ্রোহী তামিল নয়, সাধারণ তামিলদের হত্যা করা হয়, তা ছিল মূলত একবিংশ শতাব্দীর সব থেকে বড় গণহত্যা।

বিবিসির সাংবাদিক ফ্রান্সিস হ্যারিসন এ নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন। তিনি তার বই স্টিল কাউন্টিং দ্য ডেড এ যে-সকল বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়ে কোনো পাঠকের পক্ষে চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব নয়। ফ্রান্সিস আমাদের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। তাই দক্ষিণ এশিয়া তার পরিচিত। এ কারণে তিনি অনেক কষ্ট করে তার বইতে অনেক তথ্যের সমাবেশ ঘটাতে পেরেছেন।

তারপরও ব্যক্তিগত আলোচনায় ফ্রান্সির বলেছেন, শ্রীলংকার সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে তিনি খুব কম অংশই তুলে আনতে পেরেছেন ওই গণহত্যার। অনেক কথা তাকে জানতে হয়েছে যে সমস্ত শ্রীলংকান তামিল পালিয়ে অস্ট্রেলিয়া বা অনান্য দেশে গেছেন, তাদের কাছ থেকে।

তামিল এই গণহত্যা নিয়ে প্রায়ই লেখেন গাজালক্ষ্মী প্রেমাশিবম। তিনি তার ব্লগে নানান তথ্য ও শ্রীলংকার অসঙ্গতি তুলে ধরেন। তার বই ন্যান অস্ট্রেলিয়ানেও এ নিয়ে অনেক কথা আছে। তবে সত্যি অর্থে একবিংশ শতাব্দীর এই বিশাল গণহত্যাটি অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই আছে, ওইভাবে পৃথিবীতে প্রচার পায়নি। তাছাড়া এর পেছনে শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষ ও শ্রীলংকার তামিলদের বিদ্রোহই মূল কারণ কিনা তাও কিন্তু পরিষ্কার নয়। তামিলদের ওইভাবে হত্যা করার পেছনের রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার মতো কোনো পোর্ট নির্মাণের বিষয় আছে কিনা, বিদেশেী কোনো রাষ্ট্রের স্বার্থ আছে কিনা, তাও এখনও অবধি পরিষ্কার নয়। কারণ, তামিল গণহত্যাকারী রাজাপাকসে গোটাবায়ে ও সে সময়ের প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে দুই ভাই এখন দেশের ক্ষমতায়। একজন প্রেসিডেন্সি ও একজন পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করছেন। অভিযোগ আছে, দুজনের নির্বাচনে বড় অর্থনীতির দেশ চায়নার অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছিল। এবং দুজনেই চীনপন্থি। তবে বর্তমানে হাম্বানটোটা পোর্টের কারণে জনমতের চাপে তাদেরকে অনেকখানি ভারতমুখী হতে হয়েছে।

যা হোক, ২০০৯ সালে তামিল এই গণহত্যা ঘটলেও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন তাদের তদন্ত রিপোর্ট গত ২৭ জানুয়ারি প্রকাশ করেছে। ৪৭ সদস্যের এই তদন্ত কমিশন তাদের ওই রিপোর্টে উচ্চপদস্থ জেনারেল (যারা গণহত্যায় জড়িত ছিলেন) তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অনেক কিছু সুপারিশ করেছে। তাছাড়া ওই তদন্ত রিপোর্টে বলা হচ্ছে, কমপক্ষে ৪০ হাজার তামিলকে হত্যা করা হয় ২০০৯ সালে।

তদন্ত কমিশন অনেক পরে তদন্ত করেছে। তাই স্বাভাবিকই তারা সব তথ্য পায়নি। যে কারণে ফ্রান্সিসের ও গাজালক্ষ্মীর হিসাব অনুযায়ী এখানে সংখ্যা কম। বিশেষ করে ফ্রান্সিস কাজটি করেছিলেন ২০০৯ থেকে ২০১১ এর ভেতর। তাই তিনি অনেক বেশি তথ্য জোগাড় করতে পেরেছিলেন।

তারপরেও শ্রীলংকার এই তামিল গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। এবং অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারা এখানে নিয়ে আসতে পেরেছেন। জাতিসংঘের হিউম্যান রাইট কমিশন এমন সময়ে এই তদন্ত রিপোর্টটি দিয়েছেন, যখন সামনে অর্থাৎ আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ মার্চ অবধি জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অধিবেশন। এবারের এ অধিবেশন গত চার বছরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। কারণ, গত চার বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প অনেকখানি পঙ্গু করে রেখেছিল এ কমিশনগুলোকে। কারণ, ডনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে এই কাউন্সিল থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এদিকে এবার আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলিনকেন বলেছেন, আমেরিকা অবজারভার হিসেবে আবার এই কাউন্সিলে থাকবে। এবং বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা এবং বৈষম্য দূর করা। তাই স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায়, এবারের জাতিসংঘ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অধিবেশনে শ্রীলংকার গণহত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠবে। এ বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত আসতে পারে। পাশাপাশি সে দেশে এখনও যে সব ধরনের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেম সে বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের শ্রীলংকার তামিল হত্যার ওই তদন্ত রিপোর্টে অনেকগুলো সুপারিশ এসেছে। তার ভেতর ওই সকল গণহত্যাকারীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং তাদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছে। এই গণহত্যার আরো তথ্য সংগ্রহ করে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবার সুপারিশ করেছে।

শ্রীলংকার গণহত্যা যেমন একবিংশ শতাব্দীর সব থেকে বড় গণহত্যা, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যা ছিল বিংশ শতাব্দীর সর্বশেষ বড় গণহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের গণহত্যাই সব থেকে বড় গণহত্যা। বাংলাদেশ সরকার এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মাত্র কয়েকজনের বিচার করতে সমর্থ হয়েছে। তাও বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর। কিন্তু তারপরেও এই গণহত্যাকারীদের অনুসারীরা এখনও দেশের ভেতর খুবই বড় আকারে সক্রিয়। তাছাড়া গোটা পৃথিবী জুড়ে এদের অনুসারীরা ভ্রমণ করছে। এমনকি বিপুল অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে ধর্মের নামে, যেহেতু এই সরকার কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছে, তাই এ সরকারকে উৎখাত করার জন্যে। এর সঙ্গে বিদেশী কিছু রাষ্ট্রও সহায়তা করছে।

শ্রীলংকার গণহত্যার তদন্ত কমিশনের সুপারিশকে লক্ষ্য করে বাংলাদেশ সরকার তাই এ মুহূর্তে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারে, যাতে এই গণহত্যাকারী ও তাদের অনুসারীদের তৎপরতা কিছুটা হলেও কমবে। প্রথমত, অবিলম্বে যে সকল যুদ্ধাপরাধী বিচারে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে, তাদের সকল সম্পত্তি জব্দ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের অনুসারী যারা আছে বা যারা তাদের পক্ষে কথা বলে, তাদের সব ধরনের বিদেশ যাওয়া নিষিদ্ধ করে তাদের পাসপোর্ট জব্দ করতে হবে। এছাড়া জাতিসংঘের কাছে ও পাশাপাশি সকল দেশের কাছে আবেদন রাখতে হবে তারা যেন তাদের দেশে যে সকল যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থক আশ্রয় নিয়েছে, তাদেরকে অবিলম্বে বাংলাদেশে বিচারের জন্যে ফেরত পাঠায়। যাদের সাজা হয়ে গেছে তাদের সাজার জন্যে যেন বাংলাদেশে পাঠায়। এছাড়া তারাও যেন বাংলাদেশ সরকার যাদেরকে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করছে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওই সব দেশে প্রবেশের। যে সকল দেশ এখনও বাংলাদেশের এই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের অর্থসহ নানান ধরনের সাহায্য দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে একটি সম্মিলিত ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে মিডিয়ার যে প্রতিষ্ঠানগুলো এই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যাতে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও জাতিসংঘ অবস্থান নেয়, সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের কূটনীতি জোরদার করতে হবে।

এ বিভাগের আরো খবর