করোনার ভ্যাকসিন নিয়েছি ১১ ফেব্রুয়ারি। তিন দিন আগে অনলাইনে স্ত্রীসহ নিবন্ধন করেছি কন্যার সহায়তায়। ভোটার আইডি কার্ডের নম্বর এবং নাম সংশ্লিষ্ট সাইটে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই একেকটি কোড নম্বর চলে এলো। সেটা পাঠানোর পর পরই আমার কম্পিউটারে দেখলাম নাম, ঠিকানা, পিতা-মাতার নাম, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা- সব কিছু পর্দায় ভেসে উঠেছে। এ এক বিস্ময় বৈকি! ভোটার আইডি কার্ডটি যে যথেষ্ট বিশ্বমানের, সেটা আমার কাছে আরেকবার স্পষ্ট হয়ে গেল।
করোনার ভ্যাকসিন নিতে গেলাম তেজগাঁওয়ের নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউটে। স্ত্রীকে লাইনে দাঁড়াতে হলো না, কারণ নারী সংখ্যা কম। এটা বাড়াতে হবে। নিবন্ধনের কাগজটি দেখিয়ে তালিকায় নাম তুলতে ১৫ মিনিটের মতো অপেক্ষা করতে হলো। কয়েকজন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুবাদে আমায় চিনলেন। কেউ কেউ এ কারণে অগ্রাধিকার দিতে বলেন। কেউ আবার বললেন- এখানে সব সমান, ভিআইপি বলে কিছু নেই। আমিও তেমনটি বিশ্বাস করি। করোনা সংক্রমণ কোনো বাছবিচার করেনি। করোনার টিকা বা ভ্যাকসিনও বাংলাদেশকে একসূত্রে গেঁথে দিল। রাজনৈতিক ভেদাভেদ মুছে গেছে। শহর-বন্দর-গ্রাম একাকার। শ্রেণি-পেশা-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে বিত্তহীন-ধনবান, উচ্চশিক্ষিত-শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত, ভিআইপি-অতি সাধারণ, নারী-পুরুষ- সব এক সারিতে। এটাও বলতে পারি নারী ও শিশুরা বয়স্কদের শেখাতে পুরোপুরি সফল।
‘টিকা নিতে মায়ের কোলে শিশু’- এমন দৃশ্য বহু বছর ধরে দেখেছি। এ অর্জন প্রশংসিত বিশ্বজুড়ে। এখন বয়স্করা ‘টিকার লাইনে’, ঝামেলা ছাড়া।
বছর খানেক আগে করোনা বা কোভাক-১৯ আমাদের একসূত্রে গেঁথেছিল। ভ্যাকসিনও সেটা করতে পারল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতারা যে কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ, সেটা দিব্যচোখে নয়- সাধারণ চোখেই ধরা পড়ল। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফলও দেখলাম সবার হাতের নাগালে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্রহণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে এক নারী যথার্থই লিখেছেন- ‘গাড়ির চালক, গৃহকর্মী, পদস্থ কর্মকর্তা, গৃহবধূ- সব এক লাইনে। কেউ গাড়িতে এসেছেন, কেউ সিএনজিতে, কেউ পায়ে হেঁটে- সবার জন্য এক নিয়ম। এমন একটি সমাজ নির্মাণের জন্যই তো আমরা কাজ করে চলেছি।’
তিনি গিয়েছিলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে, যার অবস্থান ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। কিন্তু বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে যে ‘ভ্যাকসিন উৎসব’-এর খবর পাচ্ছি, তা উৎসাহব্যঞ্জক তো বটেই। বলা উচিত আরও বেশি কিছু। প্রকৃতপক্ষে, করোনা ভ্যাকসিন ফের শুভ বার্তা দিল বাংলাদেশকে। এমনটি হয়েছিল ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও এমনটি ঘটেছিল।
টিকা কবে মিলবে, সবাই পাবে কি না, দাম কেমন পড়বে সর্বোপরি মান কেমন হবে- এসব নিয়ে কত শঙ্কা-সংশয় ছিল। করোনার টেস্ট করানোর সময় কিছু বেসরকারি হাসপাতাল মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। আবার কিছু দুর্বৃত্ত প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসে। তারা ভুয়া সার্টিফিকেট ইস্যু করে- ‘নো করোনা’। ভুয়া স্যানিটাইজার বাজারে ছাড়ে কেউ কেউ। নিম্নমানের মাস্ক-পিপিই নিয়ে মুনাফা করে একদল। কারো খাটের নিচে মেলে রিলিফের ‘ভোজ্যতেলের খনি’।
এটা তো প্রকৃত বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশ অনেক কিছু নিয়ে গর্ব করতে পারে, সেটা আমরা দেখেছি। করোনার ভ্যাকসিন তেমনই একটা কিছু। আমি ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করে দেখি একাধিক চিকিৎসক অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ভ্যাকসিন নেয়ার স্থানে তারাই এগিয়ে দিলেন। সেখানে মোট ৮টি বুথ। নার্স যত্নের সঙ্গে ভ্যাকসিন অ্যাম্পুল হাতে নিয়ে সিরিঞ্জে ভরে আমার হাতে পুশ করতে না করতেই বলে উঠলেন- ‘পাশের সোফায় আধা ঘণ্টা বসে তারপর বাসায় যাবেন।’ আমি সেটা করেছি। কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রতিক্রিয়া আমি অনুভব করিনি। হাতে ব্যথা নেই। শরীরে জ্বালা নেই। খাদ্যে অরুচি নেই। ঘুমে ব্যাঘাত নেই। একই অভিজ্ঞতা আমার পরিবারে যারা এই ভ্যাকসিন নিয়েছে, সকলের।
ভ্যাকসিন নেওয়ার সচিত্র সংবাদ ফেসবুকে দিয়েছি। দেশ-বিদেশ থেকে অজস্র অভিনন্দন-বার্তা পাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি উন্নত দেশ থেকে মনোকষ্টও শুনেছি- ‘তোমরা ভাগ্যবান। এত উন্নত দেশে থেকেও আমরা কবে ভ্যাকসিন পাব, ঠিক নেই।’
আমেরিকা থেকে ফোনে এক পরিচিত বড় ব্যবসায়ী জানালেন, ‘করোনার ভয়ে বাংলাদেশ থেকে সস্ত্রীক এখানে এসেছি। কিন্তু দুজনের কাউকে করোনা রেহাই দেয়নি। আর ভ্যাকসিন? সে তো সোনার হরিণ!’
বিশ্ব মেনে নিয়েছে- অক্সফোর্ডের টিকাটি (যেটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৭০ লাখ ডোজ এসেছে) দামে তুলনামূলক সস্তা, গণহারে উৎপাদন করা যায় এবং সাধারণ ফ্রিজের তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আর্থ-সামাজিক-শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি নির্বিশেষে অনেক দেশের নেতার চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে, করোনা-দুর্যোগ মোকাবিলা কর্মকৌশল সেটা বলে দিল। তিনি অর্থনীতির বিপর্যয় এড়াতে অতি দ্রুততার সঙ্গে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি ‘ঋণ-অনুদান প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছেন, অনেক উন্নত দেশেরও আগে মানসম্পন্ন এবং দেশের পরিবেশের উপযোগী ভ্যাকসিন এনে প্রয়োগ শুরু করেছেন। অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখি যে, বাংলাদেশে যখন প্রায় ৫ লাখ লোক ভ্যাকসিন নিয়ে ফেলেছে, তখন ‘উন্নত বিশ্বের প্রথম সারিতে’ থাকা কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি টিকার বরাদ্দ পেতে অনুরোধ জানিয়ে টেলিফোন করেছেন।
‘ব্র্যান্ডিং এ কান্ট্রি’- এটা বিশ্বে পরিচিত শব্দ। বাংলাদেশ-১৯৭১ এবং মহান একুশে-১৯৫২, এটা আমাদের ব্র্যান্ডিং। বহু বছর ঝড়-বন্যা-খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত দেশ- এটাই ছিল বাংলাদেশের পরিচয়। এসব দুর্যোগের সময় সাহায্য-রিলিফ চেয়ে আকুল আবেদন গেছে। উন্নত দেশগুলো কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ আমাদের নীতি-কর্মকৌশল ঠিক করে দিত। এমন ধারণা এমনকি অনেক পণ্ডিতের মধ্যেও ছিল- বিশ্বব্যাংক যা বলে, তার ওপরে সত্য বলে কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার কিংবা বিশ্বব্যাংকের পারকিনসন-ফাল্যান্ড সাহেবরা স্বাধীনতার পর পরই বলে দিলেন যে বাংলাদেশ ‘বাস্কেট কেস’।
আমাদের দেশের অতিউৎসাহী একটি মহল বাস্কেট কেসকে বানিয়ে ফেললেন ‘বটমলেস বাস্কেট’। একদল লোক এর বাংলা করল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’।
কেন এভাবে নিজেকে ছোট করে দেখানো?
বাংলাদেশে প্রধান দলগুলোর রাজনীতিকরা অনেক বিষয়ে একমত হন না, এমনটিই বলা হয়। করোনার ভ্যাকসিন প্রশ্নেও মতের পার্থক্য ছিল বিস্তর। কিন্তু ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে দলমত-নির্বিশেষে এগিয়ে আসছে, এটা ভালো দিক।
ডিজিটাল বাংলাদেশ সুবিধা সর্বত্র ছড়িয়েছে, এটাও এবারে প্রমাণ মিলল। ‘পোলিও টিকা’ খাওয়ানোর অভিজ্ঞতাও দারুণ কাজ দিচ্ছে। শহর-বন্দর-গ্রাম, সর্বত্র একই অভিজ্ঞতা- ভ্যাকসিন প্রদানে ঝামেলা নেই, সমস্যা নেই। ভালো ব্যবহার মিলছে সবার কাছ থেকে। যারা নিচ্ছেন, অন্যদের উৎসাহিত করছেন।
এ অভিজ্ঞতা জাতীয় জীবনের সর্বত্র কাজে লাগানো হবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক-কলাম লেখক।