সফল উদ্যোক্তা হতে হলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাধারারও পরিবর্তন আনতে হবে। যারা চিন্তাধারার মাধ্যমে নতুন ধারণা তৈরি করতে পারবে না তারা ব্যবসার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। উদাহরণ হিসেবে পৃথিবীর বিখ্যাত ফটোগ্রাফিক কোম্পানি সবাই নতুন আইডিয়া খোঁজে। খোঁজে আর খোঁজে যে যেভাবে পারে, যখন-তখন। যদি সেটা ক্রিয়েটিভ আইডিয়া হয়, তবে তো কথাই নেই। সাত রাজার ধন পাওয়ার মতো বিস্ময়কর একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। মানুষের মধ্যে এই আইডিয়াগুলো ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে, খুঁজতে খুঁজতে একসময় সেটা বেরিয়ে এসে সবাইকে চমকে দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে।
সবচেয়ে আশার কথা হলো, একেকটি নতুন আইডিয়া একেকটি নতুন শিল্পে ধারণার জন্ম দিতে পারে। বদলে দিতে পারে মানুষের জীবন; ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে একটি দেশের। কারা এই নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করবে? কেন করবে? প্রশ্নটি হয়তো কঠিন, কিন্তু উত্তরটি খুব সহজ। সরলভাবে বলতে গেলে বলা যায়, যাদের রিস্ক নেয়ার সাহস আছে, চ্যালেঞ্জ নেয়ার শক্তি আছে, আর আছে হার না-মানা লড়াই করার দৃঢ় মনোবল। এদের মধ্যে আছে আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মেধা নিয়ে আমরা গর্ব করি, আগামী দিনের স্বপ্ন দেখার সাহস পাই; কিংবা লেখাপড়ার শেষ প্রান্তে এসে যারা ভাবছে চাকরিবাকরি নয়, শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে চাকরির বাজার সৃষ্টি করা দরকার এমন তরুণদের। শিল্প আইডিয়াগুলো গতানুগতিক ও পুরোনো ধাঁচের হলে সেখান থেকে অর্জন করার তেমন কিছুই থাকে না, বরং সেখানে তরুণদের মধ্যে এক ধরনের জড়তা কাজ করে।
আমাদের তরুণ উদ্যোক্তারা গবেষণাভিত্তিক কাজ করতে পারে। যেমন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টজাতীয় প্রতিষ্ঠান তারা গড়ে তুলতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও লাভজনক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান করে দেবে। শিল্প-কারখানাগুলোকে নতুন শিল্পধারণা দিয়ে দেশের বাণিজ্যিক বাজারকে সম্প্রসারিত করবে। শিল্প-কারখানার বিদ্যমান পণ্যগুলোকে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে ধারণাও প্রদান করবে। এই ধরনের ছোট ছোট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম শুধু দেশের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোতে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করবে।
ইসরায়েল এই ভাবনা দ্বারা তাড়িত হয়েছে। তাদের মেধাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে এ ধারণা দিয়ে গোটা পৃথিবীর নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন ও উদ্ভাবন করে চলেছে। কয়েক দশক ধরে এই উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের ধারণা তারা বিক্রি করে প্রযুক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিতেও সমৃদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক গতিধারার নিয়ন্ত্রণও তারা নিতে পেরেছে। মাত্র ৮০ লাখের চেয়ে সামান্য বেশি জনসংখ্যার এই দেশে ৪ হাজারেরও বেশি প্রযুক্তির গবেষণাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমেরিকাসহ অনেক উন্নত দেশ তাদের শিল্পভিত্তিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য ইসরায়েলি প্রযুক্তিগত ধারণার ওপর নির্ভর করে। সিসকো, আইবিএম, পেপাল, মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, আমাজন, অ্যাপল কিংবা ইন্টেলসহ অনেক উন্নত শিল্প-কারখানার রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ইসরায়েলে রয়েছে। ইন্টেলের মাইক্রোপ্রসেসর ক্রমাগত উন্নয়নে ইসরায়েলের বিজ্ঞানীদের অসাধারণ অবদান রয়েছে। এ দেশটির সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশও সম্পর্ক রাখে না সংগত কারণে। তবে এদের প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন কৌশল ও গবেষণার ব্যাপারে আলোচনা করতে কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়।
পৃথিবীর এই বড় কোম্পানিগুলোর ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ সেক্টরে কাজ করার ফলে এবং প্রযুক্তি আমদানির ফলে যে অর্থ আয় হয়, তা ইসরায়েলের জিডিপির ১২.৫ শতাংশ। মরুভূমির দেশ হিসেবে ইসরায়েল যে পদ্ধতিতে ড্রিপ সেচ, পানিকে আর্সেনিক এবং লবণমুক্ত করাসহ যে বহুমাত্রিক প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে তা আমেরিকা তার টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়ার মতো মরুপ্রধান উত্তপ্ত অঞ্চল উন্নয়নে কাজে লাগাচ্ছে। চীন উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে হলেও নতুন প্রযুক্তির ধারণা তৈরি ও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ইসরায়েল সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। তার মানে ইসরায়েলের মানুষেরা তাদের মেধা বিক্রি করে সারা পৃথিবীর প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছে। ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষায়তন হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে অর্থের জোগান দিচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই তৈরি করছে না, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গবেষণা করানো হচ্ছে যে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় পেশাদার গবেষক হিসেবে গড়ে উঠছে।
গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় একেকজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছে, যাদের মাথা থেকে বের হয়ে আসছে বিস্ময়কর সব আইডিয়া। এই আইডিয়াগুলো বিক্রি করে শিক্ষার্থীরা শুধু নিজেরাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে না, বরং দেশের অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তাদের মতো করে সাজাতে হবে। দক্ষ জনশক্তিই শুধু নয়, আইডিয়া তৈরির সৃজনশীল জনগোষ্ঠী তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবেই নতুন নতুন গবেষণালব্ধ আইডিয়া বিপণন করে বা সেগুলোকে ব্যবহার করে তরুণরা সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে। আমাদের তরুণরা মেধাবী ও আত্মবিশ্বাসী, তবে সেটাকে কাজে লাগানোর বহুমুখী পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব আমাদের। ‘জিরো টু ওয়ান’ ফর্মুলার ব্যবহার করে তরুণরা একেকজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
পেপালের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে উন্নতিকে দুভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো ০ থেকে ১, অন্যটি হলো ১ থেকে ‘এন’ পর্যন্ত। যদি কেউ অসাধারণ সাফল্য পেতে চান, তাকে ০ থেকে ১-এ যেতে হবে, যেটিকে ÔVertical ProgressÕ বলা হয়। এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন কেউ এমন কিছু করে দেখাতে পারবে, যা আগে কেউ ভাবেনি। উদ্যোক্তাকে সৃজনশীল মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। নতুন নতুন সৃষ্টি আর ধারণাকে লালন করতে হবে। এটার মানে হচ্ছে, উদ্যোক্তার মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মাধ্যমে গবেষণামনস্ক চিন্তাধারা থাকতে হবে। উদ্যোক্তাকে বিজ্ঞানের পরিবর্তন ও উন্নয়ন বিষয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানসংক্রান্ত ম্যাগাজিন, জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে জানতে ও বুঝতে হবে।
এভাবে জ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা করে নিজের মেধা-মননকে চিন্তাশক্তির উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এ ধরনের উদ্যোক্তারা মৌলিক আবিষ্কারকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পকে সম্প্রসারিত করে। বিষয়টি যদি গতানুগতিক হয়, যেমন আগে থেকেই কোনো একটি ধারণা আছে, এমন কিছুতে নতুন পরিবর্তন ঘটিয়ে উদ্যোক্তা যদি ব্যবসা করেন, তবে এখানে আগের মতো অসাধারণ সাফল্য আসবে না।
চিরাচরিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলেও সেটা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক কম। এটিকে ‘Vertical Progress’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আর এ ক্ষেত্রে তা উন্নয়নের মানদণ্ড হবে ১ থেকে এন (এন হচ্ছে একটি ধরে নেওয়া মান, যা ১-এর আওতায়ই থাকে। সোজা কথায়, ইউনিক কিছু নয়)। এ ধরনের ধারণাকে ফলিত গবেষণার ফলাফলের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা যায়। টাইপরাইটারের উদাহরণ দিয়ে পিটার তার বই জিরো টু ইনফিনিটিতে বলেন, আপনাকে একটি টাইপরাইটার দেওয়া হলো। আপনি আরও ১০০ টাইপরাইটার বানালেন। এই উন্নতি হলো ১ থেকে ‘এন’ ধরনের উন্নতি। আর আপনি যদি সেই টাইপরাইটার থেকে নতুন কোনো ওয়ার্ড প্রসেসর তৈরি করেন তাহলে সেটা হবে ‘০’ থেকে ‘১’ ধরনের উন্নয়ন।
কোডাকের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯০ সালে আমেরিকাসহ পৃথিবীর ৯০ শতাংশ ফিল্মের বাজার ও ৮৫ শতাংশ ক্যামেরার বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছিল কোডাক। কিন্তু প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে ২০১২ সালে এই বিশ্বখ্যাত কোম্পানিটি আমেরিকার একটি আদালতে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭৫ সালে কোডাকে কর্মরত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার স্টিভেন স্যাসন ফিল্মবিহীন ডিজিটাল ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। কিন্তু কোডাকের প্রধান ব্যবসা ফিল্ম ছিল বলে সে সময় তারা ফিল্মবিহীন ক্যামেরাকে বাজারজাতকরণের বিষয়টি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। বরং স্টিভেন স্যাসনকে তারা বলেছিল, এটা চমৎকার কিন্তু কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলো না। কিন্তু এর মধ্যে কোডাকের ব্যবসায়িক প্রতিযোগী যেমন- সনি, ক্যানন, নিকন ও অলিম্পাস ফিল্মবিহীন ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারজাত করে। মানুষ এ সময় কোডাকের প্রতি তাদের আগের যে আগ্রহ ছিল তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এর ফলে কোডাক ব্যবসার ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এখান থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হলো, তরুণ উদ্যোক্তাদের আধুনিক ও অগ্রসর ধারণাকে কেন্দ্র করে তাদের ব্যবসা শুরু করতে হবে। তবেই তরুণ উদ্যোক্তারা সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হবেন। তরুণ উদ্যোক্তাদের আমদানিমুখী না হয়ে রপ্তানিমুখী ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হতে হবে। বাংলাদেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে রপ্তানিমুখী পণ্য ও সার্ভিস যেমন- বিভিন্ন ধরনের ম্যাটেরিয়াল, বায়োলুব্রিকেন্ট, পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে জ্বালানি তেল উৎপাদন, সফটওয়্যার, চিকিৎসাসামগ্রী উৎপাদন, পাটসহ বিভিন্ন উদ্ভিদের বিভিন্ন উপাদান থেকে বাণিজ্যিক ফাইবার, রোবট, আলিবাবা ও অ্যামাজনের মতো অনলাইন ব্যবসা, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রী উৎপাদন, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি করাসহ নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অটোমেশনের ধারণাকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করে ইন্ট্রিগ্রেটেড টেকনোলজি ও ডিভাইস উৎপাদন ও বাজারজাত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্র সম্পদকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সেটি নিয়ে সরকারকে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মোটকথা, উদ্যোক্তাদের মধ্যে যখন গবেষণার প্রতি ঝোঁক থাকবে, তখন উদ্যোক্তাদের সৃজনশীল চিন্তাধারার মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্পধারণা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। এখন দরকার তরুণ উদ্যোক্তাদের গবেষণামুখী করে বাংলাদেশে নতুন নতুন শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর