এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে অনেক কথা বলবেন। তবে আমার বিবেচনায় এক নম্বর সমস্যা দুর্নীতি। নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, গণতান্ত্রিক স্পেস সংকুচিত হয়ে যাওয়া, মতপ্রকাশের পথে নানান বাধা, সরকারের একনায়কতান্ত্রিক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনও নিশ্চয়ই সমস্যার তালিকায় স্থান পাবে। তবে দুর্নীতি একাই গ্রাস করে নেয় গোটা সমাজকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশিত হলে সরকার খুব রাগ করে।
এবারও দুর্নীতির ধারণাসূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। নিচের দিক থেকে আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪, এবার নেমে হয়েছে ১২; যদিও স্কোর আমাদের আগের মতোই ২৬। সরকার-সমর্থকরা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট মানতে চান না। কিন্তু নিছক অস্বীকার করে তো আর দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘সরকারি-বেসরকারি খাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। মাঠপর্যায় থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত সবখানেই দুর্নীতি।’ পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যা বলেছেন, তা তো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টেরই প্রতিধ্বনি।
দুদক চেয়ারম্যান যা বলেছেন, তাতে মনে হতে পারে, পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনকালে তার নেতৃত্বাধীন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না, সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তারের দায় একা দুর্নীতি দমন কমিশনের। সমস্যার মূলে আলো ফেলতে হবে। চোরকে চুরি করতে বলে, গৃহস্থকে সজাগ থাকতে বলে লাভ নেই। আগে চুরিটা বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতি না হলে আর দমন করতে হবে না। সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়ে দমন করতে যাওয়ার তো কোনো মানে নেই। দুদক চেয়ারম্যান যা বলেছেন, এটাই এখন বাংলাদেশের বাস্তবতা।
মোটামুটি যাদের কাছে দুর্নীতি করার সুযোগ আছে, তাদের বেশির ভাগই দুর্নীতির সুযোগটা নেয়। মজা করে বলা হয়, অনেকে আছেন, সুযোগের অভাবে সৎ। বাংলাদেশে দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণাটাই আসলে পালটে গেছে। ঘুষ নিয়ে চাকরি দেয়া এখন বাংলাদেশে দুর্নীতিই নয় যেন। বরং যিনি ঘুষ নিয়ে চাকরি দেন, তাকে সবাই উপকারী মানুষই মনে করে। দুর্নীতিবাজ হলেন তিনি, যিনি ঘুষ নিয়ে চাকরিও দেন না, নেয়া ঘুষও ফেরত দেন না। বাংলাদেশে দুর্নীতি এখন সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে।
বিয়ের আলোচনায় ছেলের উপরি আয় কেমন, এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই করেন। উপরি আয় মানেই যে দুর্নীতি, সেটা সবাই জেনেও সাদরে গ্রহণ করেন। দুর্নীতিবাজ এলাকায় গিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় দানখয়রাত করে দানবীর বনে যান। আমরা জানি, টাকাটা দুর্নীতির, কিন্তু প্রশ্ন করি না।
বেতন পান ৫০ হাজার টাকা, বাসা ভাড়া দেন ৬০ হাজার টাকা, সন্তান পড়ে দামি স্কুলে, বছর বছর ইউরোপ-আমেরিকা ট্যুর করেন। আমাদের চারপাশে এমন লোকের সংখ্যা অনেক। কিন্তু আমরা কখনও প্রশ্ন করি না। ফলে দুর্নীতি একধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। সন্তান যদি জেনে যায়, পিতা দুর্নীতিবাজ, তার কাছ থেকে আপনি উচ্চ নৈতিকতা আশা করতে পারবেন না। আপনি দুর্নীতিবাজ হলে, আপনার সন্তানও কিন্তু জড়িয়ে যাবে নানান অনৈতিক কাজে।
মানুষও এখন প্রকাশ্যেই দুর্নীতি করে। আগে যেটুকু চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন তাও নেই। সরকারি চাকরিতে ট্যাক্স, কাস্টমস, পুলিশের চাহিদা বেশি; কারণ এখানে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি। সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বেশি। ইদানীং নানান আলোচনায় দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বেশি। কারণ, তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি। চতুর কর্মকর্তারা একটা প্রকল্প বানান। তারপর চলে হরিলুট- গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহার, ঠুনকো অজুহাতে লম্বা টিম নিয়ে বিদেশভ্রমণ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কাজের মান নিয়ে আমরা ঠিকাদারদের গাল দিই বটে। কিন্তু ঠিকাদারদের কিছুই করার থাকে না। কাজ পেতে হলে তাকে নানান ঘাটে নির্ধারিত কমিশন দিতে হয়। সব কমিশন দিয়ে মানসম্পন্ন কাজ করতে হলে তাকে জমিজমা বিক্রি করতে হবে।
দুর্নীতি আসলে একটা কঠিন চক্র। এই চক্র ভাঙতে হলে সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে ঘৃণা করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ঘাড়ে সব দায়িত্ব দিলে লাভ হবে না। তাদের একার পক্ষে দুর্নীতির শিকড় ওপড়ানো সম্ভব নয়।
গত সোমবার রাষ্ট্রপতির কাছে ২০১৯ সালের দুদক রিপোর্ট পেশের পর দুদক চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দুর্নীতি থামাতে জনগণের সোচ্চার আন্দোলন দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার, সুশীল সমাজ, এনজিও, দুদক- কেউই জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। সবাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার, সেটা কবে জেগে উঠবে- এটা দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রশ্ন হয়েই আছে।’ এই ঘুম ভাঙাতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নিতেই হবে।
গত এক যুগে অর্থনৈতিক নানা সূচকে আমাদের দারুণ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে না পারলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না, উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাবে না। যত উন্নয়ন, তত দুর্নীতি; এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে বৈষম্য আরও বাড়বে। অল্প কিছু মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে।
শুধু ভালো ভালো কথা বলে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। নইলে এত ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশে দুর্নীতির এমন ব্যাপক বিস্তার ঘটত না। দুর্নীতি করলে পরকালে সাজা হবে, এই কথা বলে আপনি দুর্নীতি দমন করতে পারবেন না। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি নিয়ে এগোতে হবে। দুর্নীতি করলে পার পাওয়া যাবে না, এই ভয় দেখাতে হবে। এটা মানতেই হবে, বাংলাদেশে মানুষ এখন শুধু দুর্নীতি দমন কমিশনকেই ভয় পায়। কমিশনের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। দলমতনির্বিশেষে সব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।লেখক : সাংবাদিক।