পুরো পৃথিবীর সঙ্গে তাল রেখে সাইবার জগতে বিচরণ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যেও এক নিয়মিত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে দ্বারপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, উন্নত অনেক দেশই ইতিমধ্যে এই বিপ্লবকাল অতিক্রম করছে, সেই শিল্পবিপ্লবকে দ্বিতীয় তথ্যবিপ্লব হিসেবে আখ্যা দেয়ার ফলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যে আমাদের জীবনকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করছে বা করবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। এমনকি বহুদিন আগেই বিজ্ঞাপনের বাজার সরে গিয়েছে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে, ফলে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বাধ্য হয়েছে অনলাইনে সরে আসতে কিংবা কোনো না কোনোভাবে প্রচলিত পদ্ধতির সঙ্গে তাদের অনলাইন কার্যক্রমেও আসতেই হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চলমান করোনা মহামারির সময় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা রেকর্ডসংখ্যক বৃদ্ধির তথ্য গত বছরই সংবাদে পরিণত হয়েছে।
বিবেচনায় আনা জরুরি যে বর্তমান সময়ে তথ্যকেই শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং তথ্যের দখল নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে নানা ধরনের দ্বন্দ্বের উদ্ভব শুনতে অদ্ভুত শোনালেও একেবারেই অসম্ভব নয়, বরং এরই এক সংস্করণ সাইবারযুদ্ধের সঙ্গে আমরা নানা সময় পরিচিত হয়েছি।
ইসরায়েলের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি একবিংশ শতাব্দীতে ডাটা বা তথ্যকে ভবিষ্যতের ধর্ম হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
বর্তমান তথ্য ও এর গুরুত্ব নিয়ে এতগুলো কথা বলার মূল কারণই হলো তথ্যের প্রকৃত সম্ভাবনা ও এর সঙ্গে আমাদের বসবাসের অবশ্যম্ভাবিতাকে উপলব্ধিতে সহায়তা করা। মজার বিষয় হলো, তথ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্যে এখানে তথ্য সম্পর্কেই অনেকগুলো তথ্য দিতে হলো, এতেই হয়তো তথ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়ে যায়।
লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল, সাইবার জগতে বিচরণ আমাদের দেশের নাগরিকদের জন্যেও এখন এক বাস্তবতা ও নিত্যদিনের চর্চা। মূলত, গত দশকের শেষ দিকে সরকারি পর্যায়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও তার ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়ায় দেশের ভেতর ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। যদিও দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর যে সংখ্যা বিটিআরসি প্রকাশ করে, তা প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা নিশ্চিত।
অন্যদিকে এটিও সত্য, ইন্টারনেটের প্রকৃত ক্ষমতা বা সম্ভাবনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষ খুব এগোতে পারেনি। আপামর জনসাধারণের ইন্টারনেট ব্যবহার মূলত সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ও বিনোদন মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ভেতরই সীমাবদ্ধ। যদিও ক্রিটিক্যালি বিবেচনার ক্ষেত্রে এটিও সত্য, সারা পৃথিবীতেই সাধারণ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার মোটাদাগে এসব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণ যা-ই হোক না কেন, সাইবার স্পেসে এথিক্স বা নৈতিকতার চর্চা এই সময়ে ও অদূরভবিষ্যতের জন্য এক চিন্তার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে নিশ্চিতভাবেই।
প্রচলিত ভাবনার ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এথিক্স বা নৈতিকতার পরিবর্তন হতে দেখা গেলেও সাইবার স্পেস বা নেটিকেটের ক্ষেত্রে এই এথিক্স স্থান-কাল-পাত্রভেদে আলাদা হবে নাকি একধরনের প্যান-এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড থাকবে, তা বিতর্কের বিষয়।
বাংলাদেশের সাইবার পরিসরে এই এথিক্স বা নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বারবার উপলব্ধি করা গিয়েছে। আমাদের দেশের নেটিজেনদের সিংহভাগের সাইবার লিটারেসির দারুণ সংকট থাকায় ব্যবহারকারীদের ভেতর নেটিকেট গড়ে ওঠার বিষয়টি একেবারেই অস্তিত্বহীন। আবার নেটিজেনদের সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার দারুণ অভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় খুব সহজেই সাইবার জগতে এক ধরনের ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে অহরহ। তা ছাড়া সাইবার জগতে গুজব, বিভ্রান্তি, অপতথ্য ও অতথ্য ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে অর্থ উপার্জনকেও পেশা হিসেবে নেয়ার চল রয়েছে। তা ছাড়া সাইবার বুলিং, সাইবার স্টকিং, হ্যারেজমেন্টসহ অনেক ধরনের অনৈতিক তথা অপরাধমূলক আচরণের ঘটনাও নিয়মিতভাবে সাইবার স্পেসে সংঘটিত হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের প্রকৃত সংখ্যার বিপরীতে খুব অল্পই নথিভুক্ত হয়ে থাকে।
সাইবার জগতের এসব অন্ধকার দিকের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আমাদের মূল পদক্ষেপগুলো মূলত বিভিন্ন ধরনের আইন ও নজরদারির ভেতর সীমাবদ্ধ। কিন্তু একদিকে এসব অপরাধ দমনে নজরদারির মতো কার্যক্রম যেমন অনুপযোগী হিসেবে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন আইন প্রণয়নের ফলে আইনের সুফল যে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তাও বোধ হয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায় না।
এই যখন সার্বিক পরিস্থিতি, তখন সাইবার জগতে নানা ধরনের অপরাধমূলক ও অনৈতিক কার্যক্রম থেকে নেটিজেনদের ফিরিয়ে আনার জন্য নৈতিক দিক থেকে কাজ করার কোনো বিকল্প কি আদৌ আছে?
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই এমন, সে নিয়ম ভেঙে আনন্দ পায়। এ কারণেই আইন করে মানুষকে আটকানোর বা তার আচরণ পরিবর্তনের নজির খুব বেশি নেই, যদি না তা মানুষের জীবনকেই হুমকির মুখে ফেলে কাজ আদায় করে নেয়। বরং সমাজের ভেতর থেকে নৈতিক মান বা এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড তৈরি ও সামাজিকভাবে তা অনুসরণ করার চর্চা গড়ে ওঠার মাধ্যমেই অফলাইন ও অনলাইন উভয় জগতে নৈতিক আচরণের মাধ্যমে অপরাধমূলক ও অনৈতিক তৎপরতা থেকে মানুষকে সরিয়ে আনা সম্ভব। যদিও অনলাইন ও অফলাইনে ব্যবহারকারীদের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র তৈরি বা একধরনের জেকিল-হাইড প্রবণতার বিষয়টিও সামনে চলে আসছে, তারপরও প্রাথমিক কার্যক্রম হিসেবে সামাজিক পরিসরে নৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধির কোনো ভালো বিকল্প খুব বেশি দৃশ্যমান নয়৷ তাই আইনের চেয়ে নৈতিকতা বা এথিক্সের দিকে নজর দেয়া এই মুহূর্তে খুব বেশি জরুরি, না-হলে আমাদের দেশের নেটিকেট ও সাইবার লিটারেসিহীন নেটিজেনদের ব্যাপক উপস্থিতি সাইবার স্পেস থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের অফলাইন সমাজকেও কলুষিত করবে, সেই ভবিষ্যৎ যে খুব দূরে, এমনও নয়!
লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়