বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

একুশে চেতনার উৎস এবং অসহায় প্রভাতফেরি

  •    
  • ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৬:০৯

পাশ্চাত্যের চব্বিশ ঘণ্টা গণনায় দিনের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিট। পাশ্চাত্যের অনুসরণেই যেন মাঝরাতে চলে গেল একুশে তর্পণ এবং প্রায় বিনা প্রতিবাদেই। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে তো প্রত্যুষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রভাতফেরি একুশের সকালে শহিদমিনারে বাঙালির শ্রদ্ধা নিবেদনের মিছিলের প্রতীকী শব্দ। শ্রদ্ধাবনত বাঙালির শহীদমিনারে যাত্রার প্রভাতি এই মিছিল তো প্রভাতফেরিতেই জড়িয়ে আছে।

ভাষাপ্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশপ্রেম। সাধারণ সরল উক্তিতে বলা হয়, বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল বলেই সেই চৈতন্য বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহসী করেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ যা পারেনি, বাঙালি কেমন করে তা পারল? রক্ত দিল ভাষার জন্য! রক্তমূল্যে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার উদ্দীপনা সে পেল কোথা থেকে? অর্থাৎ অমন মর্যাদার বায়ান্ন তৈরি হলো কেমন করে? ইতিহাসে ফিরে তাকালে এর উত্তর পাওয়া কঠিন নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মায়ের ভাষার জন্য মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারে শুধু বাঙালিই।

আট শতকের সেই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য, যাদের মাতৃভাষার পরিচয় অজ্ঞাত কিন্তু তারা বুঝেছিলেন এদেশের প্রাকৃতজনের কাছে বৌদ্ধধর্মের বাণী পৌঁছে দিতে হলে তাদের ভাষাতেই বলতে হবে। কিন্তু সে ভাষার লিখিত রূপ তো তৈরি হয়নি। তাই তারা অনেক মমতায় জন্ম দিলেন বাংলা সাহিত্যের ভ্রূণ শিশু চর্যাপদের। একই মনোভঙ্গি ছিল উনিশ শতকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের। উইলিয়াম কেরি বুঝেছিলেন এদেশে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের সামনে ইংরেজিতে যিশুর বাণী প্রচারের মানে হয় না। তাদের মুখের ভাষায় ধর্মপ্রচার করতে হবে। এর বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বাংলা গদ্যের যাত্রা শুরু করিয়ে দিলেন এই মিশনারি।

মধ্যযুগ ছিল পাণ্ডুলিপি লেখার যুগ। শত-সহস্র মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে পাণ্ডুলিপির ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল কেরিকে। ইউরোপ থেকে ছাপাখানা এনে প্রতিষ্ঠা করলেন সিরামপুর মিশনে। প্রকাশ পেল ‘সমাচার দর্পণ’ ‘দিগদর্শন’। এভাবে গদ্য সাহিত্যচর্চার ভুবন তৈরি হলো।

পালযুগে আট থেকে দশ শতকে চর্যাপদচর্চা এবং উনিশ শতকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশের মাঝখানে সাময়িক ছন্দপতন ঘটেছিল এগারো-বারো শতকে সেন রাজাদের শাসনকালে। সেনযুগে রাষ্ট্রযন্ত্রের বৈরী দৃষ্টিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা শুরুতে থমকে গিয়েছিল। সেনরা এককালে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট থেকে পাল রাজাদের সৈন্যবাহিনীতে চাকরি করতে আসে। পালদের দুর্বলতার সুযোগে বাংলার রাজদণ্ড দখল করে নেয় সেনরা। পররাজ্য গ্রাস করার হীনম্মন্যতা থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা নিজেদের বিযুক্ত করতে পারেনি। নিজেদের শাসন নিষ্কণ্টক করতে প্রথম বৌদ্ধ পীড়ন করতে থাকে। অত্যাচারিত অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিত দেশান্তরী হন। সাধারণ বৌদ্ধদের অনেকেই হিন্দুধর্মে নিজেদের আত্তীকরণ করে ফেলেন। অন্যরা অন্ত্যজ শ্রেণিতে নিপতিত হয়।

ব্রাহ্মণ সেন শাসকরা মানসিক ঔদার্যে সাধারণ হিন্দু ও অন্ত্যজ শ্রেণিকে কাছে টেনে নিতে পারেনি। বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে গণরোষের আশঙ্কা তাদের ছিল। তাই সাধারণ বাঙালিকে সংস্কৃতি বোধহীন করে রাখতে চেয়েছে। সেন শাসকরা ঠিকই বুঝেছিলেন ভাষাচর্চার মধ্য থেকে প্রাণ পাবে সাহিত্য। সে যুগের ধর্ম-সাহিত্যচর্চা ও অধ্যয়ন সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলবে। ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণ করার সুযোগ হারাবে তারা।

সেনদের বৈরী আচরণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চৌদ্দ শতকে বহির্ভারতীয় অবাঙালি শাসক সুলতানরা সে সংকট ঘুচিয়ে দিলেন। তারা বাংলা সাহিত্যের বিকাশকে শুধু সমর্থনই দিলেন না, পৃষ্ঠপোষকতায় ভরিয়ে দিলেন। মঙ্গলকাব্য এবং পরবর্তী সময়ে বৈষ্ণব সাহিত্য এবং চৈতন্যচরিত কাব্যের মধ্যদিয়ে হিন্দু কবিরা বাংলা ভাষাকে বিশেষ মর্যাদার জায়গায় পৌঁছে দিলেন। পিছিয়ে থাকলেন না মুসলমান কবিরাও। তারাও রোমান্টিক কাব্য, বীরগাথা ও জীবনী সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে বিশেষ অবস্থানে এনে দাঁড় করালেন। মোগল যুগে এসে যুক্ত হলো মর্সিয়া সাহিত্য আর বাউল সংগীত।

এভাবে দীর্ঘকালজুড়ে যে ভাষা শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে দিগন্তবিস্তারী হয়েছে, তার উত্তরাধিকারীরা তো সে ভাষা নিয়ে অহংকার করবেই। কোথাকার কোন ভুঁইফোড় এসে মাটিতে শক্ত প্রথিত ভাষামূলে আঘাত করলে এই গর্বিত জাতি তা মানবে কেন! পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে এদিক থেকে সেনশাসকদের মানসিক অবস্থানে ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। এদের মনেও ছিল সেনদের মতো একধরনের উপনিবেশিকতা। ধর্ম ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হলেও শাসকদের মনে ছিল শোষণ মানসিকতা। তাই সংস্কৃতিবোধে উজ্জ্বল বাঙালির প্রতি ভীতি তাদের ছিল। সেনদের মতো এরাও যথার্থ বুঝেছিল বাংলা ভাষাচর্চা বিচ্ছিন্ন করতে পারলে দেশপ্রেমের শক্তি হারাবে বাঙালি। সংস্কৃতিবোধহীন বাঙালিকে তখন নতজানু করা কঠিন কিছু হবে না। তাই সাতচল্লিশে পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিতর্ক তৈরি করে ফেলে। ইতিহাসবোধহীন স্থূল বিবেচনার পাকিস্তানি শাসকরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্যের শক্তিকে বিবেচনায় আনল না। তারা কেড়ে নিতে চাইল মুখের ভাষাকে। এ অবস্থায় ঐতিহ্যস্নাত বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই রক্তমূল্যে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসে। তাই পূর্ব বাংলার বাঙালি ১৯৪৮ এবং ১৯৫২-তে ঐতিহ্য তৈরি করতে পেরেছিল। ভাষা যে দেশাত্মবোধে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ভাষা আন্দোলন।

ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধ তৈরিতে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি প্রেরণাদায়ী শক্তি। একুশে তাই আমাদের ঐতিহ্য- আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অপূর্ণ ইতিহাসচর্চার কারণে নতুন প্রজন্মের সামনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের চর্যাপদচর্চা বা স্বাধীন সুলতানি যুগের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার উজ্জ্বল দিনের কথা অস্পষ্ট। একুশেই তাদের প্রেরণার প্রথম উৎস। তাই একুশের আবেগ বিচ্ছিন্ন হলে প্রজন্ম প্রাণিত হওয়ার এই শেষ সূত্র হারিয়ে ফেলবে।

মানতেই হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে তার সংস্কৃতিভাবনায় ভিন্ন আবেগ যুক্ত করেছে। নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে তাই মৌলিক আবেগ থেকে একুশে তর্পণের বিকল্প নেই। কিন্তু নাগরিক জীবনে একুশের আবেগকে খণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে। প্রায় তিন দশক আগে আগে সামরিক শাসক নিজের নিরাপত্তার দিক বিচারে একুশের প্রথম প্রহর নাম দিয়ে রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের রেওয়াজ চালু করে। একে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয় নগরবাসী সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বশ্রেণির মানুষ। আর সেই সঙ্গে একুশের চেতনায় জড়িয়ে থাকা প্রভাতফেরি নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা হয়ে যায়।

অথচ বায়ান্নের পর থেকে একুশের প্রত্যুষে প্রভাতফেরির মধ্য দিয়ে শহিদমিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন একুশের মহিমাকে আলাদা ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে। কাকডাকা ভোরে সাজ সাজ রব। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পাড়ামহল্লার ক্লাবকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল হাতে নগ্নপায়ে এগিয়ে যেত শহিদমিনারের দিকে। কণ্ঠে থাকতো “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...” গানের সুর মূর্ছনা। এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করত। এভাবে একুশ যেকোনো জাতীয় দিবস থেকে আলাদা মাত্রা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছিল।

বাঙালি সংস্কৃতি রাত ১২টা ১ মিনিটকে দিনের প্রথম প্রহর বিবেচনা করে না। আবহমান বাংলার দিনের শুরু প্রত্যুষে আর দিনের অবসান সন্ধ্যায়। পাশ্চাত্যের চব্বিশ ঘণ্টা গণনায় দিনের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিট। পাশ্চাত্যের অনুসরণেই যেন মাঝরাতে চলে গেল একুশে তর্পণ এবং প্রায় বিনা প্রতিবাদেই। কিন্তু স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবসে তো প্রত্যুষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রভাতফেরি একুশের সকালে শহিদমিনারে বাঙালির শ্রদ্ধা নিবেদনের মিছিলের প্রতীকী শব্দ। শ্রদ্ধাবনত বাঙালির শহীদমিনারে যাত্রার প্রভাতি এই মিছিল তো প্রভাতফেরিতেই জড়িয়ে আছে।

আমাদের নাগরিক জীবনের বাইরে গ্রাম-গঞ্জে এখনও বাঙালি একুশের শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রভাতফেরির মধ্য দিয়ে। একুশের গানের মূর্ছনায় প্রভাতফেরির যাত্রার এই অভিনবত্ব নতুন প্রজন্মকে কৌতূহলী ও আবেগাপ্লুত করে তুলবে। নতুন করে ভাববে আমাদের ভাষাপ্রেম আর দেশপ্রেমের কথা। এভাবেই প্রাণিত হবে তারা। এখন একুশে শুধু বাংলাদেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে বিশ্ববাসী। এই ভাষা দিবসে একবার বিশ্ববাসী ফিরে তাকাবে ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার এদেশটির দিকে। অনুকরণ করবে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলির রেওয়াজকে।

প্রভাতফেরি শব্দটির জন্মই হয়েছে যেন একুশে প্রভাতের মিছিলকে বোঝাতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উৎসভূমির অনুকরণে বিশ্ববাসীও প্রভাতফেরিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। অথচ আমরাই হঠকারী সিদ্ধান্তে প্রভাতফেরিকে বিসর্জন দিয়ে মধ্যরাতে একুশের চেতনা খুঁজে ফিরছি। সংস্কৃতিভাবনার সুস্থ ধারা বলবে আমরা প্রভাতফেরিকে হারাতে চাই না। হারাতে চাই না একুশের আবেগকে। রাত ১২টা ১-এর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে আবার প্রভাতফেরির একুশে উদযাপনে ফিরে যেতে চাই। কারণ, একুশকে তার স্বমহিমায় পুনঃস্থাপন না করে প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না দেশপ্রেমের জন্ম তার ভাষা প্রেমের মধ্য থেকেই।

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে আমি এই আক্ষেপ করে কাগজে লিখে আসছি। সুযোগ পেলে টিভি টক শোতে অরণ্যেরোদন করছি। ভেবেছিলাম, আর যা-ই হোক অন্তত আমাদের সাংস্কৃতিকবলয়ের নেতা-কর্মীরা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কথা বলা প্রভাবশালী চিহ্নিত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা এই বিষয়টি নিয়ে কণ্ঠে আওয়াজ তুলবেন। কিন্তু তাদের নিদারুণ নীরবতা আমাদের মনে কেবল প্রশ্নের মিছিল তৈরি করছে। এ থেকে বেরিয়ে এসে ভাষা আন্দোলনের চেতনার অন্যতম ধারক প্রভাতফেরিকে মধ্যরাতের বন্দিত্ব ভেঙে প্রভাতে পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় দায়িত্ব পালন করা জরুরি।

লেখক: অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যাল‌য়‌‌‌

এ বিভাগের আরো খবর