বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নেতিবাচক সংবাদ প্রচারে উৎসাহ বেশি, এমন অভিযোগ করা হয়। আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে অন্যভাবে তুলে ধরেন- সংবাদপত্রের পাঠক, বেতারের শ্রোতা কিংবা টেলিভিশনের দর্শকরা যেমনটি চান, সাংবাদিকদের সেটা বিবেচনায় রাখতে হয়। ‘এ সংবাদটি পাঠক খাবে’- এমন কথা নিউজ ডেস্কে বসে অনেকবার শুনেছি।
আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা বলি। একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকে প্রথম যেদিন কাজ শুরু করি, একটি নিউজ আসে রেল দুর্ঘটনা বিষয়ে। রয়টার্স লিখেছে, আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এএফপি লিখেছে, ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ নিউজ এজেন্সি। শিফট-ইন-চার্জকে জিজ্ঞেস করি, কোনটি লিখব? উত্তর আসে চটজলদি, ‘যেটা বেশি, সেটা লিখবেন।’
তবে একই পত্রিকায় ভিন্ন অভিজ্ঞতাও আছে। এক জেলা রিপোর্টার খবর পাঠালেন, ঢোলকলমি পোকার আক্রমণে ২৪ জনের মৃত্যু। সে সময়ে প্রতিদিন ঢোলকলমিকে ‘অতিশয় বিষাক্ত পোকা হিসেবে’ প্রচার করা হচ্ছিল। চারদিকে গুজব এই পোকা নিয়ে। ওই পত্রিকার সম্পাদকের নির্দেশে আমি জেলা প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলি। তার কাছে পোকার আক্রমণে মৃত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় জানতে চাই। কিন্তু তিনি একজনের নামও দিতে পারেননি। ‘২৪ জনের কথা তিনি লোকমুখে শুনেছেন,’ যাচাই করার সময় পাননি।
সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে পালন করেননি। পত্রিকার সম্পাদক কিন্তু করেছিলেন। রিপোর্টারকেই বা দোষ দিই কী করে? একাধিক পত্রিকায় ঢোলকলমির আক্রমণে অনেকের মৃত্যুর খবর ছেপেছে। তিনি কেন পিছিয়ে থাকবেন?
এক সন্ধ্যায় বিটিভিতে (তখন প্রাইভেট টিভি ছিল না। বিটিভিই সবাই দেখত) এলেন এক কীটপতঙ্গবিদ। তিনি লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে নিজের জামা-গেঞ্জিবিহীন বুকে-পিঠে কয়েকটি ‘নিরীহ’ ঢোলকলমি পোকা ছেড়ে দিয়ে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেন, তার শরীরে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে টিভিতে আলোচনা করলেন। দুয়েক দিনের মধ্যে দেখা গেল, ঢোলকলমির গুজব উধাও। কোনো পত্রিকায় আর নিউজ নেই এই পোকা নিয়ে।
গুজবের নৌকা পাহাড় ডিঙায়, এটা প্রবাদ। করোনার ভ্যাকসিন নিয়েও কত গুজব আমরা শুনেছি। গুজব রটনাকারীর মধ্যে মতলববাজরা ছিল, আবার কেউ কেউ আশঙ্কা থেকেও এ রটনা করেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কত সমালোচনা। এর পেছনে সত্যতা যথেষ্টই। চীনে ২০১৯ সালের শেষ দিকে এই ভয়ংকর ভাইরাস ধরা পড়ে। ক্রমে গোটা বিশ্বকে তা গ্রাস করে। বাংলাদেশে কত শঙ্কা, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকবে। দাফন-সৎকারের লোক মিলবে না। হাসপাতালে চিকিৎসা মিলবে না। ওষুধ মিলবে না। চিকিৎসক পাওয়া যাবে না।
প্রথমদিকে এমনটি ঘটেছিল। শাহেদ-সাবরিনার মতো দুষ্টুলোকেরা ছিল। যে বাড়িতে একজন রোগী ছিল, পুলিশ লাল নিশান টাঙিয়ে দিয়েছে। পরিবারটি একঘরে হয়ে পড়েছে। গোটা পাড়া বা এলাকা ভয়ে কাঁপছে। পিতা বা মাতার মৃত্যুর সময় সন্তানরা কাছে যেতে পারেনি। জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে দাফন করার সময় উপস্থিত হাতে গোনা কয়েকজনের সবাই পিপিই পরা, এই দৃশ্য আমরা দেখেছি।
করোনার ভয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে গেছেন, এমন এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ৭ ফেব্রুয়ারি ফোনে জানিয়েছেন- ‘নিরাপদ দেশে’ সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনার সংক্রমণ শুরু হলে খ্যাতিমান ব্যবসায়ী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান স্ত্রীসহ বিমানে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। তাদের বহনকারী বিমানটিতে অন্য কোনো যাত্রী ছিল না। পুরোটাই মাত্র দুজনের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। এ জন্য কত ব্যয় হয়েছিল, সে প্রশ্ন অবান্তর। বাংলাদেশকে ‘অনিরাপদ’ মনে হয়েছিল এবং এখান থেকে ‘নিরাপদ’ দেশ ইংল্যান্ড চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা।
আমাদের গণমাধ্যমে করোনার শুরুতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সমালোচনায় কেউ কেউ ছিলেন কঠোর। তারা ভুলভ্রান্তি তুলে ধরেছেন। অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করেছেন। কোন দেশ কতটা ভালো করেছে, তার তুলনায় বাংলাদেশ কত পিছিয়ে, সেটাও বলা হয়েছে। কেন ভিয়েতনাম, নেপাল, ভুটান পারে কিন্তু বাংলাদেশ পারে না, সে প্রশ্ন শুনেছি।
করোনার এক বছর অন্য আলোচনা হতে পারত, বিশ্বের সীমিত যে কটি দেশে করোনার ভ্যাকসিনের মজুত ভালো এবং তার একটি বাংলাদেশ। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
এটা ঠিক যে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত কারণে এবং আরও কিছু কারণে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তুলনায় ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন যেটা করা দরকার, সেটা করেছেন। তিনি অন্য অনেক দেশের আগে ভ্যাকসিন বুকিং দিয়েছেন। তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, ধনী-দরিদ্র, সবাই ভ্যাকসিন পাবে বিনা মূল্যে। যখন সরকারের কঠোর সমালোচকরা ‘দামি ভ্যাকসিন’ গরিবরা কিনতে না পেরে অসহায়ের মতো মরে পড়ে থাকবে বলে গলাবাজি করছেন, তত দিনে বিনা মূল্যের ভ্যাকসিন তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই হাজার হাজার লোকের শরীরে স্থান করে নিয়েছে।
আমাদের এই এগিয়ে থাকাটা কিন্তু গর্ব করার মতো। বিশ্বের অনেক দেশ যখন অর্থনীতি সামাল দিতে ব্যস্ত, বাংলাদেশ তত দিনে নিজের ঘর সামলাতে পেরেছে। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর পোশাকশিল্পের মালিক ও রপ্তানিকারকরা বলছিল, সব শেষ হয়ে গেল। বিবিসির মতো নির্ভরযোগ্য সম্প্রচার সংস্থাও এটা বলেছিল। বাস্তবে সেটা ঘটেনি। বিশ্বের নানা দেশে কোটি খানেক বাংলাদেশি কাজ করেন। বিশেষজ্ঞ নামধারী ও অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ হিসাবনিকাশ করে বলছিল, কত লাখ লোক বিদেশে কাজ হারিয়ে ফেরত আসবে এবং রেমিট্যান্স-প্রবাহে কতটা ধস নামবে। বিদেশ থেকে কিছু লোক ফেরত এসেছে, সেটা ঠিক। তবে এদের একটি অংশ এসেছে ভয়ংকর বিপদের সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকার জন্য। যারা এসেছে, তাদের একটি অংশ ফিরে গেছে কর্মস্থলে। বিমানের টিকিটের পেছনে খরচ বৃদ্ধি এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে।
আর রেমিট্যান্স-প্রবাহ? বাংলাদেশে কয়েক মাস ধরে যত অর্থ বিদেশে কর্মরতরা পাঠাচ্ছেন, অতীতে তেমনটি ঘটেনি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পাকিস্তানের তিন গুণ। এর নানা কারণ থাকতে পারে। অর্থনীতিবিদরা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রিজার্ভ এখন ভালো, খুবই ভালো অবস্থায়। রপ্তানি বাণিজ্যেও ধস নামেনি।
আমরা কী এসব উদযাপন করব না? যখন দুঃসময় চলে, একটি ভালো খবর আমাদের মন ভালো করে দেয়। এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশ কিন্তু গত এক বছরে অনেক ভালো খবর দিয়েছে!
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলাম লেখক।