করোনার মতো একটি অতিমারিতে সারা বিশ্ব যখন নাকাল এবং যার হাত থেকে বাঁচতে উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে, তখন এই ভাইরাসের টিকা প্রদানের প্রথম দিনে বাংলাদেশে যা হলো, তাকে এক কথায় ‘টিকা উৎসব’ বলাই শ্রেয়।
বাঙালি আসলেই উৎসবপ্রিয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে এটিই স্বাভাবিক। বাঙালির নিজস্ব উৎসব পয়লা বৈশাখ তো বটেই, ধর্মীয় নানা উৎসবেও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। যে কারণে একটা সময় পর্যন্ত এই দেশে নির্বাচনের মতো একটি সিরিয়াস পলিটিক্যাল বিষয়ও উৎসবে পরিণত হয়েছিল। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নির্বাচন থেকে উৎসব ব্যাপারটি বলতে গেলে ‘নাই’ হয়ে গেছে।
এ রকম উৎসবপ্রিয় একটি জাতি জীবন বাঁচানোর টিকা নিতে গিয়েও যদি উৎসব করে, তা নিশ্চয়ই দোষের নয়। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম দিনে যা যা হলো, তা উৎসবকে ছাপিয়ে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে।
বিশেষ করে, টিকা নেয়ার সময় মন্ত্রী-আমলাসহ বিশিষ্টজনদের শ্যান্ডো গেঞ্জি পরা যেসব ছবি গণমাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে, তা রুচির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। প্রশ্ন হলো, বিশিষ্টজনদের শ্যান্ডো গেঞ্জি পরা অর্ধনগ্ন শরীর কি মানুষ দেখতে চেয়েছে? বিশিষ্টজন দূরে থাক, একজন সাধারণ মানুষের শ্যান্ডো গেঞ্জি পরা ছবিইবা গণমাধ্যম কেন প্রকাশ করবে? গণমাধ্যম কত কিছুতে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করে, অথচ শ্যান্ডো গেঞ্জিটার সেন্সর করতে পারল না?
করোনার টিকা মানুষ নেবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এই টিকার ছবি তুলতে সবাইকে এ রকম হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে কেন? বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রাষ্ট্র, সরকারপ্রধানসহ বিশিষ্টজনরা টিকা নিয়েছেন। কোনো দেশে কি এরকম দৃশ্য দেখা গেছে, একজন মন্ত্রী টিকা নিচ্ছেন, আর তাকে ঘিরে আছেন শখানেক মানুষ এবং সেই ছবি নেয়ার জন্য টিভি ও পত্রিকার অর্ধশত ক্যামেরার পজিশন নিয়ে ঠেলাঠেলি?
সমস্যা শুধু সংবাদকর্মীদেরও নয়। বরং পুরো সিস্টেমের। আমাদের দেশে যে হারে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের বিকাশ (সংখ্যার বিচারে) হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেশাদারি যেমন গড়ে ওঠেনি, তেমনি সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একসঙ্গে তিরিশটির মতো টেলিভিশন এবং আরও অনেকগুলো পত্রিকার ক্যামেরা বসিয়ে ছবি নেয়ার মতো একটা দৃষ্টিনন্দন ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। ফলে যখনই কোথাও বড় বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেটি হোক হাসপাতাল কিংবা অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি অফিস—সেখানে ক্যামেরার এই হুড়োহুড়ি শুরু হয়। যারা এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনায় থাকেন, তারা নিজেদের চেহারাগুলো দেখানোর জন্য যতটা মরিয়া—এই ছবি নেয়ার জন্য একটা সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। শুধু এই ছবি নেয়াই নয়, বরং অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই স্বপ্রণোদিত হয়ে পর্যাপ্ত তথ্য দেয় না। বরং যতটা সম্ভব গোপন করে। আর এই গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে জন্ম নেয় অপসাংবাদিকতা।
২.
করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে তামাশার খবর পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রশিক্ষিত নার্স পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তিন জনের শরীরে করোনার টিকা দিয়ে দিয়েছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খান। তার এই টিকা পুশের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এ রকম একটি ভয়ানক কাজ তিনি কী করে করলেন? ধরা যাক, টিকা বা ইনজেকশন দিতে তিনি পারদর্শী। তারপরও তিনি নিজের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এই কাজ কীভাবে করেন? তা ছাড়া দক্ষ নার্স, চিকিৎসক বা চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া কেউ তো এই টিকা পুশ করার অধিকার রাখেন না। সুতরাং তিনি যা করেছেন, সেটি প্রথমত অতি উৎসাহ, দ্বিতীয়ত, অপরাধ। তো এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে?
৩.
কাজ করার চেয়ে কাজ দেখানোর প্রতি আমাদের বেশি আগ্রহ। যেমন কোনো বড় প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং সেটি উদ্বোধনের নামে যা হয়; এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের ছোটখাটো উন্নয়নকাজের ভিত্তিপ্রস্তর ও উদ্বোধন ঘিরে যে আয়োজন হয়, তা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় কি না, সন্দেহ। তবে কেবল রাজনীতিবিদরাই নন, সরকারের কর্মচারীরাও নিজেদের নাম পাথরে খোদাই করে রাখতে বেশ উৎসাহী। জনগণের করের পয়সায় উন্নয়ন হয়, অথচ পাথরে খোদাই করে আজীবনের জন্য নিজেদের নাম লিখে রাখেন রাজনীতিবিদ ও সরকারের কর্মচারীরা—জনগণের করের পয়সায় যাদের বেতন হয়। এ এক অদ্ভুত কারবার। টিকাদান কার্যক্রমকে উৎসবে পরিণত করার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই কাজের চেয়ে কাজ দেখানোর মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। এর ফলে কয়েকটি ক্ষতি হয়েছে। যেমন:
ক. করোনার হাত থেকে বাঁচার প্রধান শর্ত যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, বিশিষ্টজনদের টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে এটিই প্রথমে লঙ্ঘিত হয়েছে। একজন লোককে ঘিরে ধরেছেন আরও অনেক লোক। মন্ত্রীকে ঘিরে সরকারের লোক এবং তার দলের লোক। এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মন্ত্রী মহোদয় হাসপাতালের কোনো একটি কক্ষে কিংবা চেয়ারে একা বসে টিকা নিয়ে বের হওয়ার পরে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া দিতে পারতেন। তাতে করে তার শ্যান্ডো গেঞ্জি পরা ছবিটা জাতিকে দেখতে হতো না।
খ. যে করোনায় সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ গেল এবং যে অণুজীবটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তার হাত থেকে বাঁচতে এ রকম একটি উৎসব আয়োজন করে পুরো বিষয়টিকে হালকা করে ফেলা হয়েছে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ মাস্ক পরতে চায় না, শারীরিক দূরত্ব মানে না। সুতরাং টিকা নিয়ে এ রকম উৎসব করার মধ্য দিয়ে মানুষের সেই নির্ভারতা ও নির্লিপ্ততাকেই বরং উৎসাহিত করা হলো।
গ. যেহেতু টিকা নিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ছিল, ফলে সেই বিতর্ক এড়াতে যে বেশ ঘটা করে এই টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যে নতুন বিতর্কের জন্ম নিল, সেটি আরও খারাপ।
এসব বিতর্ক এড়িয়ে এখন সরকারের সামনে প্রধান কাজ হলো, যোগ্য সবাই যাতে দ্রুত টিকা পায়, সেটি নিশ্চিত করা। টিকা গ্রহণের পরে যে সামান্য প্রতিক্রিয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হয়, অর্থাৎ টিকা নিয়ে এখনও যে অনাস্থা রয়ে গেছে, সেটি দূর করা। টিকা গ্রহণের নিবন্ধনে যাতে কোনো জটিলতা না হয়, সেটি নিশ্চিত করা। এরপরও মূল যে প্রশ্নটি সামনে আসবে তা হলো, যেহেতু চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, এই টিকার কার্যকারিতা থাকবে সর্বোচ্চ এক বছর, ফলে এই সময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় না নিলে আগামী বছর আবার কোটি কোটি মানুষকে এ রকম টিকা দেয়া সম্ভব হবে কি না, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ ব্যবস্থাপনা কতটা সহজ হবে— তা এখনই বলা মুশকিল।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।