ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছি, তারই কিছু নিয়ে লিখব আজ।
ক. মোটাদাগে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলার সময় আমরা মাথায় রাখি ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালকে। মূলত ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।
ফলে, ভাষা আন্দোলনের নানা সূক্ষ্ম বিষয় আমরা এড়িয়ে যাই।
খ. আরেকটি সমস্যা হয়, দিন–ক্ষণের যে ছবিটি তৈরি করা হয়েছে, তা নানাজনের বর্ণনায় নানা রকম।
ভাষা আন্দোলনের অনেক পরে স্মৃতিচারণা করেছেন বলে অনেক ভাষাসংগ্রামীই অনেক ভুল তথ্য দিয়েছেন। কখনো কখনো বর্ণনা করতে গিয়ে যেখানে তারা ছিলেন না, সেখানেও নিজেরা উপস্থিত ছিলেন বলে ভেবেছেন। আবার কখনো নিজের অভিজ্ঞতা আর অন্যের অভিজ্ঞতাকে গুলিয়ে ফেলে যে তথ্য দিয়েছেন, তা ঐতিহাসিকভাবে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
গ. তৃতীয় যে সংকটটি খুবই গভীর, সেটির দিকে খুব একটা নজর দেয়নি কেউ। তবে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের চোখে ঘটনাটি ধরা পড়েছিল এবং তিনি এর প্রতিবাদও করেছেন। এটি হলো, কেউ কেউ সবার অগোচরে ভাষা আন্দোলনের মূল কৃতিত্ব দিতে চাইছে তমদ্দুন মজলিসকে। ইচ্ছে করেই তথ্য বিকৃত করে উপস্থাপন করছে। যদি এই মিথ্যেগুলোর প্রতিবাদ না হয়, তাহলে একসময় এগুলোকেই সত্য বলে ধরে নেওয়া হবে। যার ফলে ভয়ংকরভাবে ইতিহাস–বিকৃত হবে।
ক্রমান্বয়ে এই তিনটি বিষয় নিয়ে কথা বলব।
ক.
প্রথমেই চোখ রাখি ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের দিকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের রাজনীতিতে তখন তিনটি রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হয়েছিল। একটি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ইসলামি ধারা, একটি সেই আন্দোলন থেকে উঠে আসা জাতীয়তাবাদী ধারা (যারা তখনো তাদের মুসলিম পরিচয় থেকে বের না হলেও মুসলিম লীগের রক্ষণশীল রাজনীতির বাইরে এসে রাজনীতি করার চেষ্টা করছিল) এবং একটি কমিউনিস্ট ধারা।
মনে রাখা প্রয়োজন, সে সময় কেবল পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছে। এর আগের সময়টায় প্রচণ্ডভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত থেকে বাংলার মুসলমানরা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল। ফলে, তাদের কাছে প্রথম ধাক্কা হিসেবেই এসেছিল ভাষা প্রসঙ্গটি। উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে— এ রকম একটি ঘোষণার পরই প্রথম টনক নড়ল এই ভূখণ্ডের বাঙালিদের। মূলত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই সে সময় ভাষার আন্দোলনটি করেছে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনটি ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারেনি নানা কারণে, এখানে সে আলোচনা নয়।
একটু বলে রাখা ভালো, পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ২৭ নভেম্বর। অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান গঠনের প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে। সেই সম্মেলনেই প্রস্তাব গৃহীত হয়, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এটা ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বিরাট এক ধাক্কা।
দৈনিক আজাদের কট্টর মুসলিম লীগপন্থি মওলানা আকরম খাঁ পর্যন্ত এই প্রস্তাবে বিচলিত হয়েছিলেন। তিনি তার সম্পাদিত পত্রিকা আজাদে তার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন সে বছরের ৮ ডিসেম্বরে। তিনি সেখানে বলেন, ‘রাষ্ট্রের জনগণের মাতৃভাষা সেখানকার রাষ্ট্রীয় ভাষা হইবে, ইহাই সংগত ও স্বাভাবিক কথা। যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের গণভাষা অবিসম্ভাবিতভাবে বাংলা, অতএব তাহার রাষ্ট্রীয় ভাষা নিশ্চিতরূপে বাংলাই হওয়া চাই।’
বিবৃতিতে অনেক কথার মধ্যে তিনি আরও বলেছিলেন-
‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা না হইয়া উর্দু হইবে কোন দলের কোন মতের বাঙ্গালী মুসলমান আজ পর্যন্ত এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন নাই। বরং সকলেই এক্ষেত্রে তারস্বরে বাংলার দাবি সমর্থন করিতেছেন। আমার জ্ঞান বিশ্বাস মতে, কেন্দ্র হইতেও পূর্ব পাকিস্তানের উপর কোনো প্রকার এ রূপ নির্দেশ দেওয়া হয় নাই। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রীয় ভাষা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র অধিকারী পাকিস্তানের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান রচনা পরিষদ। এই পরিষদ যেকোনো অবস্থায় মোছলেম বঙ্গের অভিমতকে অগ্রাহ্য করিতে চাহিবেন এবং চাহিলেও করিতে পারিবেন, এরূপ আশঙ্কা করার বিন্দুমাত্র কারণ আমি দেখিতে পাইতেছি না।’
ডিসেম্বরের শেষদিকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। এই পরিষদের সদস্যরা ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেখা করতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে। ফজলুর রহমান ছিলেন বাংলার সন্তান, কিন্তু উর্দুপ্রেমী। তিনি যে বাংলা ভাষার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করবেন, তখনই তা বোঝা গিয়েছিল। সে মাসেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে কয়েক হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তা পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় সরকার বরাবর। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয় করাচিতে সে বছরেরই ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেখানে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ আরও কয়েকজন পরিষদ সদস্য পরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলায়ও বক্তব্য দেওয়ার দাবি তোলেন, কিন্তু তা পাস হয়নি।
এ সময় বাংলা ও উর্দু নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় পত্রিকায়। সে লেখাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো আকরগ্রন্থে সে লেখাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সন্নিবেশিত আছে। সেগুলো এক জায়গায় আনা প্রয়োজন। এই লেখাগুলো পড়লেই আমরা কয়েকটি আলোচনার মধ্যে দিয়ে যেতে পারব। একটি হলো বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা হিসেবে বাংলা, বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের সম্পর্ক, অভিজাত ও অনভিজাত সম্প্রদায় নিয়ে ভাবনা অন্য আরেকটি, কোনোমতেই কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়— বাঙালি অভিজাত ও অনভিজাত মুসলিম। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। এ নিয়ে অনেক গভীর গবেষণার অবকাশ এখনো আছে। কিছু কাজ হয়েছে বটে, কিন্তু এই সংকটের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে নানা পথ, তথা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক পথ পাড়ি দিতে হবে। আর সে প্রশ্নের মীমাংসা হলেই ভাষা আন্দোলনের মূল সংহত ভাবনাটির সন্ধান আমরা পাব।
খ.
ভাষাসংগ্রামীরা ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাদের স্মৃতিচারণা করেছেন অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর। এ কারণে আন্দোলনে তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, সে সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনাবলিতে নিজের অবস্থান ইত্যাদির কথা বলতে গিয়ে কোনো কোনো ঘটনা তারা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেখানে তারা ছিলেন না, সেখানেও নিজেদের হাজির করেছেন তাদের কেউ কেউ। এমনকি স্মৃতিস্তম্ভটি কবে তৈরি করা হয়েছিল, কে সেটার উদ্বোধন করেছিলেন, কবে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, এই তথ্যগুলো দেওয়ার সময়ও অনেক ভাষাসংগ্রামীই কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন।
অনেক ভাষাসংগ্রামী বলেছেন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১০ জন করে মিছিল বের হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলছেন, সে মিছিলগুলো ছিল ৫ জনের। কোনটা ঠিক, সে প্রশ্নের মীমাংসা আর হবে বলে মনে হয় না। তবে ১০ জনি মিছিলের কথাই বেশি মানুষ বলছেন।
কমিউনিস্ট ভাষাসংগ্রামীরা যখন স্মৃতিচারণা করছেন, তখন বহুলাংশে তাদের সংগঠনের তৎপরতার কথা বলছেন, জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষের কেউ যখন কথা বলছেন, তখন নিজেদের কথাই জোর দিয়ে বলছেন আর তমদ্দুন মজলিসের কেউ কথা বললে তারা বলতে চাইছেন, মূল শক্তি ছিলেন তারাই।
তাদের সাক্ষাৎকারগুলো থেকে নির্মোহভাবে সত্য তুলে আনার কাজটি এখনো বাকি রয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় তখনকার প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতিভাষ্য, এ বিষয়ে লেখা গবেষণাপত্রগুলো মিলিয়ে সেই সময়টিকে নির্মোহদৃষ্টিতে বিনির্মাণ করা দরকার।
গ.
তৃতীয় বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। একদল মানুষ হঠাৎ করে সত্য তথ্যের মধ্যে ছোট করে কোনো মিথ্যা তথ্য ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তমদ্দুন মজলিসের হয়েই এই প্রচারণাটি চালানো হচ্ছে। কথা খুব বেশি বাড়াব না। কতটা সূক্ষ্মভাবে এই কাজটি করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে একটু ধারণা দিয়ে দেব শুধু।
হঠাৎ করেই একজন ভাষা আন্দোলন গবেষক হাজির হয়েছিলেন। তার নাম এম এ বার্ণিক। ভদ্রলোক ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি বই লিখেছেন। তবে বইটি লেখার আগে প্রথম আলো আর জনকণ্ঠে তিনি তার লেখাগুলো ছাপিয়েছিলেন। তিনি অতি চালাকির সঙ্গে সত্য ঘটনাগুলোর মধ্যে এমন সব মিথ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, গভীরভাবে না পড়লে মিথ্যেগুলো ধরাই পড়ত না।
শহীদমিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে প্রথম ভুলটা করে ফেলেন এম এ বার্ণিক। সেখানে তিনি সেই স্মৃতিস্তম্ভের নকশা তৈরি বিষয়ে যে তথ্য দিয়েছেন, তা শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও। এই শহীদমিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, এই নির্মাণে তমদ্দুন মজলিসের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি এমন সব ভাষা সংগ্রামীর গায়ে তমদ্দুন মজলিসের লেবাস চড়িয়ে দিয়েছিলেন, যাদের কেউই সেই সংগঠনটি করতেন না।
এ ব্যাপারে আহমদ রফিক লিখছেন, ‘প্রথম আলোর ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০০৪) সংখ্যায় জনাব এম এ বার্ণিক প্রথম শহীদমিনার প্রসঙ্গে পরোক্ষে তমদ্দুন মজলিসের বিশেষ ভূমিকা নিয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নয়। প্রসঙ্গ শহীদমিনারের নকশা আঁকা। তার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে যে, স্মৃতিস্তম্ভের নকশা তৈরির কাজে লিপ্ত ডাক্তার মীর্জা মাজহারুল ইসলাম, ছাত্র সর্বজনাব বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার যথাক্রমে তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির দপ্তর সম্পাদক এবং মজলিসের ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার নেতা, যিনি তাদের ছাত্রফ্রন্ট ‘ছাত্রশক্তি’র সংগঠনের বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।’
‘প্রথমত ডা. মাজহারুল ইসলাম যে নকশা আঁকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তা তথ্যসহ শহীদমিনার’ অনুচ্ছেদে বলা আছে। মীর্জা সাহেব তখন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি চিকিৎসক। তখনকার কোনো সরকারি চিকিৎসককেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়নি, চাপ এতটাই প্রবল ছিল। নকশা আঁকার সঙ্গে তিনি যে যুক্ত ছিলেন না, তা সাঈদ হায়দারসহ সংশ্লিষ্ট মেডিকেল ছাত্রদের সাক্ষ্যে প্রমাণিত।…
‘একই সমস্যা বদরুল আলমকে নিয়ে। তাকেও কখনো তমদ্দুন রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বা মতপ্রকাশ করতে দেখা যায়নি। সবচেয়ে বড় কথা, মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রের পক্ষে তার বিপুল পাঠভার নিয়ে মজলিসের দপ্তর সম্পাদকের মতো একটি সার্বক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকা কতটা বাস্তব, তা ভেবে দেখার বিষয়। আর বদরুল আলম যে এমন একটি পদে আসীন, তা তার সহপাঠী ছাত্র কেউ জানবে না বা বদরুল মজলিসের আদর্শ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবেন না, এমনটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়। হয়তো তাই ডা. সাঈদ হায়দার তাকে মজলিসের নেতা হিসেবে চিহ্নিত করায় ক্ষুব্ধ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৪, প্রথম আলো) এককথায় এই বলে যে, ‘আমি তমদ্দুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। প্রকৃত তথ্য হলো, ওই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে তমদ্দুন মজলিসের বা ছাত্রশক্তির কোনো ইউনিট ছিল না।…তা ছাড়া আমার বিশিষ্ট বন্ধু জনাব বদরুল কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই যুক্ত ছিল না। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের চরিত্রহননে ক্ষুব্ধ হয়েছি।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সে সময়কার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ মজলিস সদস্যবিষয়ক তথ্য (২৪–২–০৪) ‘উদ্ভট ও অসত্য’ বলে উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার সাহেবদের তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত করে জনাব বার্ণিক ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন। এর সংশোধনী প্রকাশিত হওয়া দরকার এবং তা ইতিহাসের প্রয়োজনে।’
এরপর আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক স্পষ্টভাষায় লিখেছেন, ‘তমদ্দুন মজলিস–এর ভূমিকা-সম্পর্কিত বিষয়টি আমাদের কাছে বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক প্রচার বলে মনে হয়েছে আরো এ কারণে যে মজলিসের পক্ষে অনুরূপ অর্থবিকৃতি জনকণ্ঠ–এ প্রকাশিত (২৭–২–০৪) জনাব বার্ণিকের অন্য একটি লেখায়ও লক্ষ করা গেছে। বায়ান্ন সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলির বিবরণ দিতে গিয়ে জনাব বার্ণিক জনাব বদরুদ্দীন উমরের বই থেকে (ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ৩য় খণ্ড) তথ্য উদ্ধার করেছেন এভাবে, ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ভাষা–আন্দোলনের কারারুদ্ধ কর্মী আজমল হোসেনের কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব একটি বৈঠক ডাকেন। উক্ত বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক আবুল হাশিম।’
এবার দেখা যাক, মূল লেখায় কথাগুলো কীভাবে রয়েছে। জনাব উমরের বক্তব্য, ‘কাজী গোলাম মাহবুব ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে কারারুদ্ধ কর্মী আজমল হোসেনের কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম।’
এই দুই উদ্ধৃতির মধ্যে ফারাক মাত্র এক জায়গায়। জনাব বার্ণিকের লেখায় হাশিম সাহেবের নামের পূর্বে ‘তমদ্দুন মজলিসের রাজনৈতিক ফ্রন্টের আহ্বায়ক’ শব্দগুলো বসানো হয়েছে যা উমরের বইতে নেই, এমনকি নেই মূল উৎস অলি আহাদের বক্তব্যে (জাতীয় রাজনীতি, পৃষ্ঠা ১৭২)। যেখান থেকে উমর সাহেব কথাগুলো উদ্ধৃত করেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন, খুশিমতো তথ্য পরিবেশনের (তথ্য বিকৃতির) মাধ্যমে মজলিসের পক্ষে এ ধরনের প্রচার কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত? জবাব পাঠকের বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
(আবদুল ও মতিন আহমদ রফিক, ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও তাৎপর্য, সাহিত্যপ্রকাশ, ২০০৫, পৃষ্ঠা ৬১–৬৩)
সুতরাং ভাষা আন্দোলনের নির্মোহ ও নিরাসক্ত ইতিহাস তুলে আনার ব্যাপারে এখনো অনেক কাজ যে বাকি আছে, তা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক