বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলন ও বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা

  •    
  • ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৬:০১

দুর্ভাগ্যক্রমে, একসময়ে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারা দাবি করতেন যে, তিনি এই আন্দোলনে তেমন যুক্ত ছিলেন না। তারা যেটি দাবি করে থাকেন তা হচ্ছে ভাষা আন্দোলনটি গড়ে তোলা হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নামে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে। সে কারণেই শেখ মুজিবকে তারা সেই আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ১৯৪৭ সালে ঢাকায় আসার পর থেকে পূর্ব বাংলায় সংগঠিত আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম ছিলেন।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই পাকিস্তানে ভাষা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়, তা ক্রমেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রূপ লাভ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে একটি মহল সুপারিশ করে। এই মতের বিপক্ষে যুক্তি প্রদান করে ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখনী শুরু করেন।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আরও কিছুসংখ্যক শিক্ষক, সমাজসচেতন লেখক, বুদ্ধিজীবী বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করে সংগঠন গড়ে তোলেন। এর পক্ষে তরুণ সমাজসহ বেশকিছু বাঙালি রাজনীতিবিদ তাদের মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান ও যৌক্তিকতা ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলায় বিস্তৃত হতে থাকে। ক্রমেই এটি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় তিনি ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’- এই মত তুলে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা ‘না না’ বলে প্রতিবাদ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালেও তিনি রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষেই মত প্রদান করলে সেখানেও প্রতিবাদ হয়। এ থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন তরুণ-ছাত্রসমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৪৮ সালে এই আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার পক্ষে প্রথম ঢেউ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ১৯৫২ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটায় যখন পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন তরুণ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। এর ফলে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সেই থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। একসময় পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম একটি ভাষা হিসেবে মেনে নিতে। কিন্তু পাকিস্তানকালে বাংলা ভাষার সর্বত্র বাস্তবায়ন ঘটানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাধারার উন্মেষ, সাংস্কৃতিকবোধ ইত্যাদিকে জাগ্রত করে স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই আন্দোলনে অসংখ্য ছাত্রনেতা, যুবনেতা এবং রাজনীতিবিদ তাদের অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।

এদের মধ্যে সেই সময়কার তরুণ নেতা পরবর্তী সময়ের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান নেতা এবং ৬ দফা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম ছিলেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, একসময়ে ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারা দাবি করতেন যে, তিনি এই আন্দোলনে তেমন যুক্ত ছিলেন না। তারা যেটি দাবি করে থাকেন তা হচ্ছে ভাষা আন্দোলনটি গড়ে তোলা হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নামে ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে। সে কারণেই শেখ মুজিবকে তারা সেই আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ১৯৪৭ সালে ঢাকায় আসার পর থেকে পূর্ব বাংলায় সংগঠিত আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে গভীরভাবে একাত্ম ছিলেন। তিনি জেলে থাকা অবস্থায়ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর নবগঠিত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক এমনকি সভাপতি পদ অলংকৃত করার পরও বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মাতৃভাষা হিসেবে মর্যাদা দান এবং শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশে গুরুত্ব প্রদান করেন।

পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় বঙ্গীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার পর তিনি প্রথমে গোপালগঞ্জ, পরে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে তিনি এসেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা দেখতে পান এবং এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। তিনি প্রথমে ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজকে মুসলিম লীগের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার ছাত্র ও যুবকদের সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো আন্দোলনে নির্যাতন ধরপাকড় এবং জেলে আটক রাখা শুরু করে।

বাংলা ভাষার আন্দোলনকে মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করতে থাকে। সে কারণে নবগঠিত মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য এই সংগঠনটিকে দাঁড় করান।

তিনি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি এই সময়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন।

বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) ১১ মার্চ প্রাদেশিক গণপরিষদে অধিবেশন শুরু হওয়ার প্রাক্কালে গণপরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এবং ২৩ ও ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও কজন ছাত্রনেতা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দাবি জানিয়ে একটি প্রচারপত্র ৪ মার্চ (১৯৪৮) বিতরণ করেন। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের দাবিতে বর্ধমান হাউস অভিমুখে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার সময় গ্রেপ্তার হন। তার এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গোপালগঞ্জে ১৬ মার্চ হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর আগেই তিনি মুক্তিলাভ করেন।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার অংশগ্রহণের বিবরণ তুলে ধরা হয়। এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে ফরিদপুরের এসএম একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের তীব্র সমালোচনা করেন। এই সময় থেকে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য, কাপড়চোপড়, কৃষিজ পণ্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং মহাজনের অত্যাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন নেতা বিভিন্ন জেলার জনসভায় বক্তৃতাকালে উল্লেখ করে জনমত গঠন করতে থাকেন। নেতারা একই সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতির দাবিতে ছাত্র-যুবকদের আন্দোলনের প্রতিও সমর্থন জানাতে থাকেন। পাকিস্তানের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে ১৩ আগস্ট স্বাক্ষরিত শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রদত্ত বিবৃতিতে লেখেন ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম ছাত্র সমাজের উপর এবং আরও কতিপয় ক্ষেত্রে জনতার উপর লাঠী চার্জ্জ, কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার ও গুলী চালনা করিয়া তাঁরা আজাদীকে কলঙ্কিত করিয়াছেন।’

১৩ আগস্ট প্রকাশিত ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় শেখ মুজিবের পরিচয় সম্পর্কে লেখে, ‘অধুনা বিলুপ্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের সদস্য ও পূর্ব্ব-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা’।

১৯৪৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে, অন্যান্য ইস্যুতে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ এবং দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে থাকেন।

১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের এক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন।

তিনি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের জেলে বন্দি রাখা হয়েছে তাদের মুক্তি, জাতীয় মেডিক্যাল স্কুল অধিগ্রহণ ও শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত থাকার ব্যবস্থা সৃষ্টি ইত্যাদি দাবি আদায় করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ছাত্র সমাজের ৮ জানুয়ারি জুলুম ও প্রতিবাদ দিবসে প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক ছাত্র ধরপাকড় হয়। এই উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন ধর্মঘটী শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের দুশমন, কমিউনিস্ট, পঞ্চম বাহিনী ইত্যাদি নামে অভিহিত করে তাদের দমন করার কথা ব্যক্ত করেন।

নুরুল আমীনের এই বিবৃতির বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনামূলক জবাব দেন জুলুম প্রতিরোধ সাব-কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমান। বিবৃতিতে তিনি নুরুল আমীনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এবার জনসাধারণের পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থন আমাদের পিছনে রহিয়াছে, এ সম্বন্ধে আমরা সুনিশ্চিত।’

মার্চ মাসেও তিনি নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন সমাবেশে সরকারের আরবি বর্ণমালা চালু করার নীতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন। এছাড়া ৪ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান ১৫০, মুগলটুলিতে সাবেক ছাত্র নেতাদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ১৭ মার্চ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিকেটিং করেছিলেন। ১৯ মার্চ ভিসির বাসভবনের সামনে থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ইউ/এস ৫৪ সি আর পিসি ধারাতে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঢাকা জেলে থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল ২৩ জুন রোজ গার্ডেন হোটেলে প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মওলানা ভাসানী এই সংগঠনের সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।

তখন তিনি ছিলেন জেলে। ২৬ জুনে তিনি ঢাকা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। এই সময় থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার জনগণের বিভিন্ন দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার জন্য প্রদেশব্যাপী জনসমাবেশে বক্ততা করেন।

অক্টোবর মাসে তাকে পাকিস্তানের জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করে গ্রেপ্তারের জন্য পাকিস্তান সরকার গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাজী দেয়ান ঠিকানা থেকে তাকে সি/ডব্লিউ কোতোয়ালী পি.এস. কেস নং-১৯ (১০)৪৯ ইউ/এস ১৪৭ আইপিসি আর/ডব্লিউ ৭(৩) বিএসপিও এবং ইউ/এস ১৮(২) বিএসপিও ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের পর তার কারাবাস ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র আন্দোলন আবার ফুঁসে উঠতে থাকে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে মর্মে ঘোষণা দেয়ার পর এই আন্দোলন নতুন কর্মসূচিতে শুরু হয়। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে মওলানা ভাসানী, জেলে অবস্থানরত শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতাদের যোগাযোগ ছিল। তাদের পরামর্শেই ছাত্রনেতারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে রাস্তায় নামেন।

২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট আহ্বান করে। জেলে অবস্থানরত শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন কর্মসূচি পালনের কথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। সেই পরিস্থিতিতে কারা কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহম্মদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে প্রেরণ করে। সেখানে তারা অনশন শুরু করেন। এরই মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন নিহত ও আহত হন। ঢাকা মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সারা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রছাত্রীরা স্কুল-কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়ে এর প্রতিবাদ করতে থাকে।

২১ ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণ ছিল ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়ার বেদনার্ত ঘটনা। ২১ ফেব্রুয়ারির পর ঢাকা শহর উত্তাল হয়ে ওঠে। এর প্রতিক্রিয়া দেশে সর্বত্র পড়তে থাকে। শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহম্মেদসহ কারাবন্দিরা রাজবন্দির মুক্তি এবং ছাত্রদের রক্তদানের প্রতি সংহতি জানিয়ে তাদের অনশন অব্যাহত রাখতে থাকেন। কিন্তু ২৩, ২৪ তারিখের দিকে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহম্মেদসহ অনশনকারী নেতাদের স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় জেল কর্তৃপক্ষ সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানালে ২৫ তারিখ সরকার তাদের মুক্তিদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে। এরপরই অনশনকারীরা অনশন ভঙ্গ করেন।

২৭ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বের হয়ে আসেন। তখন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তিনি কিছুদিন গোপালগঞ্জেই কাটান। সে কারণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের পক্ষে এই দীর্ঘ কারাবাস এবং কারা-পরবর্তী কিছুদিন অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি ঢাকায় ফেরার পর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনের দাবি বারবার পুনর্ব্যক্ত করতে থাকেন।

১৯৫৩ সালের ফেব্রয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ২১ তারিখে ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আতাউর রহমান খান এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থান গ্রহণ করে। মুহূর্তের মধ্যে সমাবেশটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে বিশাল জনসভায় রূপান্তরিত হয়। তাতে বেশ কয়েকজন নেতা ভাষণ দেন। সভায় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দীর্ঘ বক্তৃতা করেন।

বক্তৃতায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে তিনি ‘কারবালা দিবস’ বলে অভিহিত করেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খোলা রহিয়াছে- হয় বাংলাকে তারা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন।’

১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সম্মেলনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি তিনি উত্থাপন করেন। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে এই দাবি করে। শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবির কথা কয়েকবার উল্লেখ করা হয়। গঠিত যুক্তফ্রন্টের একুশ দফাতেও এই দাবি যুক্ত করা হয়।

১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৃতীয় সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়টি শেখ মুজিবুর রহমান তার সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।

পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেন এবং সেটি গৃহীত হয়। এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষার দাবি অব্যাহত থাকে। পূর্ব পাকিস্তান গণপরিষদেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলে তার এসব উদ্যোগ সফল হয়নি। কিন্তু ষাটের দশকে তিনি আবারও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিকে সমানভাবে গুরুত্ব প্রদান করেন।

১৯৬৬ সালে ছয় দফা উত্থাপন করা হলে পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকে বন্দি ও কারাগারে প্রেরণ করে।

এরপর ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি শুধু নয়, শেখ মুজিবসহ অনেককেই রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারে দণ্ডিত করার আয়োজন করে। এর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় শেখ মুজিবকে ২২ ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি দিতে। ২৩ তারিখ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত সভায় তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু এই সময় থেকে ৬ দফা বাংলা ও বাঙালির দাবিতে অনেকটাই পাকিস্তানের সরকারকে দুর্বল করতে সক্ষম হন।

এরপর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা না দেয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও মুক্তির যে আহ্বান জানান সেটি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বত্র চর্চার উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ২৫ এপ্রিল এক সরকারি আদেশে রাষ্ট্রের সকল প্রশাসনিক কাজকর্ম বাংলায় লেখার আদেশ জারি করেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৯৪৭, ১৯৪৮ সালে সূচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বাস্তবে রূপদান করেন। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫২ সালের দ্বিতীয় পর্বে তিনি জেলে থাকার কারণে যুক্ত থাকতে পারেননি। তবে তার অকুণ্ঠ সমর্থন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্রসমাজের প্রতি ছিল। ১৯৫২ সালের পর থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে তিনি রাজনৈতিকভাবে দলীয় অন্যতম দাবি হিসেবে সর্বত্র উত্থাপন করতে থাকেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে অবহেলার চোখে দেখত। তাদের পরিকল্পনা ছিল উর্দু বা আরবি বর্ণমালায় বাংলা ভাষাকে রূপান্তরিত করা। এর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করে তিনি বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ব্যবহার ও চর্চার সুযোগ করে দেন। এমনকি জাতিসংঘেও বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানকালে রক্ষার যে আন্দোলন তাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গঠনের পর এর প্রকৃত বাস্তবায়নের সুযোগ করে দেন। এখানেই তার বাংলা ভাষার আন্দোলন, সংগ্রাম ও বাস্তবায়নের ঐতিহাসিক ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও গবেষক

এ বিভাগের আরো খবর