বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অটোপাসের দায় শিশুদের নয়

  •    
  • ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১৪:৪৭

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এইচএসসির ‘অটোপাস’ নিয়ে নানা রকম ফান, কৌতুক, ট্রল দেখে মনে হয়েছে আমরা খুব নিষ্ঠুর; এমনকি সন্তানদের সঙ্গেও। এই প্রজন্মটা বড্ড দুর্ভাগা। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন তাদের শিক্ষাজীবনকে বিঘ্নিত করেছে, আর এবার করল করোনা।

আমাদের সময় মানে এখন থেকে সাড়ে তিন দশক আগে এসএসসি, এইচএসসির ফলাফল ঘোষণার দিনটি ছিল জাতীয় উৎসবের মতো। স্কুল-কলেজে যাওয়ার পাশাপাশি পত্রিকায়ও বিশাল অংশজুড়ে ফলাফল ছাপা হতো। স্কুল-কলেজে তো বটেই, উৎসবের রং লাগত ঘরে ঘরে। মিষ্টির দোকানে টান পড়ে যেত। তখন ফলাফলের ধাপ ছিল স্ট্যান্ড, স্টার মার্কস, ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন এভাবে। বোর্ডে বোর্ডে স্ট্যান্ড বা মেধাতালিকা প্রকাশিত হতো। পত্রিকায় সেরা শিক্ষার্থীদের ছবি ও সাক্ষাৎকার ছাপা হতো। সেরাদের সেরার বাবা-মায়ের ছবিও ছাপা হতো।

নব্বইয়ের দশকে আমরা সাংবাদিকতা শুরুর পরও ফলাফল প্রকাশের এই নিয়ম বলবৎ ছিল। ফলাফল প্রকাশের দিন পত্রিকা অফিসেও দারুণ ব্যস্ততা থাকত। নানা গবেষণা, আগের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা ইত্যাদি রিপোর্ট হতো। মনে আছে ভোরের কাগজে জ. ই. মামুনের জনপ্রিয় সিরিজ ছিল ‘বেস্ট অব দ্যা বেস্টস’। মামুন ধারাবাহিকভাবে সেরা শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক রিপোর্ট করত। জিপিএ-৫ যুগে প্রবেশের পর ফলাফলের উচ্ছ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়ে।

এখন সেরা বাছাইয়ের সুযোগ নেই। জিপিএ-৫ এখন ডালভাত। তাছাড়া এখন ঘরে বসেই মোবাইলে ফলাফল জানার সুযোগ থাকায়, স্কুল-কলেজে উপস্থিতিও আগের মতো নেই। তবে এবারের মতো নিরুত্তাপ, উচ্ছ্বাসহীন ফলাফল কেউ কখনো দেখেনি। আমাদের সময় পাসের হার হতো ৩০ শতাংশের ঘরে। বাড়তে বাড়তে সেটা ৯০ শতাংশের ঘরও ছুঁয়েছিল। আর এবার পাস শতভাগ! তারপরও উচ্ছ্বাস নেই। কারণ, এ অর্জনে কষ্ট নেই। কষ্টের অর্জনে আনন্দ বেশি। এবার জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি। তারপরও মিষ্টির দোকানে মাছিরই রাজত্ব। কারণ, এবারের এইচএসসি পরীক্ষাই হয়নি। ফল হয়েছে জেএসসি এবং এসএসসির ভিত্তিতে। এটা যে সরকার ইচ্ছা করে করেছে, তা কিন্তু নয়। করোনার কারণে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও থমকে দাঁড়িয়েছিল। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া যায়নি। পরীক্ষা ছাড়া ফলাফল ঘোষণার কোনো নিয়ম ছিল না বাংলাদেশে। এমন পরিস্থিতির কথা কেউ কখনো ভাবেইনি। শেষ পর্যন্ত সংসদে আইন সংশোধন করে, ফলাফল ঘোষণার বাধা দূর করতে হয়েছে।করোনাভাইরাস গোটা বিশ্বকেই চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। করোনার আগের আর পরের বিশ্ব কখনোই এক হবে না। মানুষের জীবনযাপন, অর্থনীতি, পরিবেশ- করোনার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও বদলে গেছে। অনেক ক্ষতিই আস্তে আস্তে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা ক্যালেন্ডারে যে লণ্ডভণ্ড অবস্থা তা কীভাবে পুনর্গঠন করা যাবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি চলছে। মার্চ মাসে খোলার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এইচএসসি পরীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে সেটা নিয়ে আর ভাবার কিছু নেই। আমাদের তাকাতে হবে সামনের দিকে।

এইচএসসি পরীক্ষাটি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পরীক্ষাটি প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সংযোগ সেতু। এইচএসসি পরীক্ষায় পাওয়া চাবি দিয়েই শিক্ষার্থীরা খোলে ভবিষ্যতের অনেক সম্ভাবনার তালা। তাই সরকারকে অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক সিদ্ধান্তের পারমুটেশন, কম্বিনেশন করে শেষ পর্যন্ত এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের গড়ে মূল্যায়ন করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে হয়েছে। আর এই মূল্যায়ন পদ্ধতিটি বেশ জটিল ছিল। জেএসসি এবং এইচএসসির ফলাফলের গড় থেকে এইচএসসির ফল তৈরি হয়েছে।

কিন্তু জেএসসি এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পেয়েও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৭ হাজার ৪৩ জন। আবার জেএসসি এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েও এবার বঞ্চিত হয়েছে ৩৯৬ জন। এইচএসসিতে অটোপাসের সিদ্ধান্ত অনেক জটিলতা সৃষ্টি করেছে এবং করবে। ৩৯৬ জনের মত আরও অনেকে বঞ্চিত হবে। অনেক শিক্ষার্থী আছে, জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার ঘাটতিটুকু এইচএসসিতে পুষিয়ে নিতে চায়। যখন বোঝে এইচএসসির ফলাফলই ভবিষ্যতের আসল চাবি, তখন জানপ্রাণ দিয়ে খেটে শেষ দৌড়ে জিততে চায়। কিন্তু এবার সেই ওস্তাদরা শেষ রাতে মাইর দেয়ার সুযোগটাই পেল না।

আগেই বলেছি, ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়ার মতো বাস্তবতা দেশে ছিল না। তাই সরকারের এই বিরল সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বিরল সিদ্ধান্ত বলছি, কারণ এর আগে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো পাবলিক পরীক্ষা বাতিল হয়নি। এ অঞ্চলে দুইবার ডিগ্রি বাতিল হয়েছিল, একবার ৪৭ সালে দেশভাগের সময়। আরেকবার ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের পর। তবে তখন এত প্রতিযোগিতা ছিল না। এখন নম্বরের ভগ্নাংশের কারণে অনেকের অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই এইচএসসির এবারের ফলাফল কিছু জটিলতা সৃষ্টি করবে। তবে সেই জটিলতার জট খোলারও নানান চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা এবার ‘মিনি এইচএসসি’ হিসেবে নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এইচএসসির সিলেবাসের ভিত্তিতেই বড় আকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে। আর যেহেতু সমস্যাটা বৈশ্বিক, তাই আশা করি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি বা স্কলারশিপের ক্ষেত্রে এবারের শিক্ষার্থীদের বিষয়টি যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করবে।

এই শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে গেছে। কলেজের শিক্ষার্থীরা একটি বছর ঘরে বসে কাটিয়েছে। একে তো বন্দিজীবন, তারওপর পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা, ফলাফল নিয়ে শঙ্কা- এই শিক্ষার্থীদের মনের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে, আমরা বড়রা সেটা বোঝারই চেষ্টা করি না। যেখানে আমাদের সবার তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত, সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত, সেখানে আমরা তাদের নিয়ে ট্রল করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এইচএসসির ‘অটোপাস’ নিয়ে নানা রকম ফান, কৌতুক, ট্রল দেখে মনে হয়েছে আমরা খুব নিষ্ঠুর; এমনকি সন্তানদের সঙ্গেও। এই প্রজন্মটা বড্ড দুর্ভাগা। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন তাদের শিক্ষাজীবনকে বিঘ্নিত করেছে, আর এবার করল করোনা।

স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে পরীক্ষা বাতিল না হলেও ৭২ সালে ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অবাধে নকলের সুবিধা ছিল। তাই ‘বাহাত্তরে ম্যাট্রিক’ মানেই একধরনের গালি ছিল। এবারের এইচএসসির ফলাফল নিয়েও একধরনের তাচ্ছিল্যের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলাফল প্রকাশের দিন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ফল নিয়ে সমালোচনা না করার জন্য সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘এতে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী যেটা বুঝেছেন আমরা অনেকে সেটাই বুঝতে চাইছি না। নিষ্ঠুরভাবে শিক্ষার্থীদের ট্রল করছি, হেয় করছি। অথচ এমন ফলাফলের জন্য এই বাচ্চাদের কোনো দায় নেই। তারা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। আমরা বড়রা সেই পরীক্ষা নেওয়ার মতো প্রস্তুত হতে পারিনি। আমরা তাদের জীবন থেকে একটা পরীক্ষা কেড়ে নিতে পেরেছি। কিন্তু তাদের মেধা, তাদের যোগ্যতা তো কেড়ে নিতে পারিনি।

আসুন, আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়াই। তাদের সম্ভাবনাকে বিকশিত করি। ট্রল, কার্টুন বা ফান করে যেন তাদের মন ভেঙে না দিই। কারণ, এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর