১৯৫১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে প্রকাশ্য জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা কী হইবে তাহা প্রদেশবাসীই স্থির করিবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উর্দু।’
অথচ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তিনি যে ৮ দফা চুক্তি করেছিলেন তাতে সমগ্র পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবির তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি করেছিলেন এবং নিজেই পূর্ব বাংলা আইনসভায় প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে পূর্ব বাংলার অফিশিয়াল ভাষা বাংলা হবে। তা ছাড়া যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রস্তাব পূর্ব বাংলার আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যেই ঢাকায় বসে তিনি ওয়াদা করেছিলেন, সেই ঢাকায় বসেই উল্টা বললেন। দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ এর তীব্র প্রতিবাদ করে।’ [পৃষ্ঠা ১৯৬]
বঙ্গবন্ধু তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। দরজার বাইরে গোয়েন্দারা পাহারা দিচ্ছেন। তবে গভীর রাতে তারা ঘুমাচ্ছেন। এ সময়ে ছাত্র-যুবনেতারা গোপনে তার সঙ্গে দেখা করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে।’... ‘পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করতে হবে। আমি আরও বললাম, আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৯৬-১৯৭]
যিনি একাধারে সংগঠক-কর্মী ও নেতা, তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাখা মুসলিম লীগ সরকার সমীচীন মনে করেনি। ২৯ জানুয়ারি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি তিনি ও মহিউদ্দিন আহমদ জেল কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘটে যাবেন। জেলের চার দেয়ালের বাইরে যাতে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন মহল থেকে মুক্তির দাবি ওঠে সে ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার পর পূর্ব বাংলা প্রকৃত অর্থেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগ নেতা কাজী গোলাম মাহবুব রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি দিবসটি নির্ধারণের কারণ ছিল, ওই দিন পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। হরতালের পাশাপাশি কর্মসূচি প্রদান করা হয়, আমতলায় ছাত্র-জনসমাবেশ শেষে মিছিল করে আইনসভায় স্মারকলিপি প্রদান।
ঐতিহাসিক আমতলা ছিল চানখাঁর পুলের কাছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পেছন দিকে। আর আইনসভা ছিল জগন্নাথ হলের বর্তমান অক্টোবর স্মৃতি ভবনের স্থানে। দুটি স্থানের দূরত্ব আধা কিলোমিটারের মতো হবে। কিন্তু এ স্থানেই সৃষ্টি হলো অনন্য ইতিহাস। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ক্রমে রূপান্তরিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। এ পর্যায়ের আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকলেন সামনের সারিতে, নেতৃত্বের আসনে।
২১ ফেব্রুয়ারির হরতালের কর্মসূচি সামনে রেখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের অনশন কর্মসূচি পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে, এ শঙ্কায় পূর্ব পাকিস্তানের নুরুল আমিন সরকার সিদ্ধান্ত নিল শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদ, এই দুজনকেই ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হবে। এই প্রক্রিয়াতেও আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাই। ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল কর্মসূচি সফল করায় তিনি যেন কোনোভাবেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থেকে ভূমিকা রাখতে না পারেন সেজন্যই তাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফরিদপুরে। সরকার এটাও জানত, হরতাল সামনে রেখে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয় নেতা ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করলে দেশে এর প্রতিক্রিয়া হবে। তাকে মুক্তিদানের চাপ বাড়বে। দুই বছরের বেশি বিনা বিচারে এক রাজনৈতিক নেতাকে আটক রাখার সপক্ষে কোনো যুক্তিই তো তারা দিতে পারছে না।
বঙ্গবন্ধু জানতেন, সকাল ১১ টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমার যায় গোয়ালন্দ ঘাট। ফরিদপুর যেতে হলে এই স্টিমারেই প্রথমে যেতে হবে গোয়ালন্দ ঘাট। তারপর সড়কপথে যাত্রা। তাকে যে ফরিদপুর সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, সেটা দলীয় নেতা-কর্মীদের জানানোর জন্য অভিনব কৌশল বের করলেন, ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নারায়ণগঞ্জ স্টিমারঘাট যাত্রা যতটা সম্ভব বিলম্বিত করা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি দেরি করতে শুরু করলাম, কারণ তা না হলে কেউই জানবে না আমাদের কোথায় পাঠাচ্ছে! প্রথমে আমার বইগুলি এক এক করে মেলাতে শুরু করলাম, তারপর কাপড়গুলি। হিসাব-নিকাশ, কত টাকা খরচ হয়েছে, কত টাকা আছে। দেরি করতে করতে দশটা বাজিয়ে দিলাম। রওনা করতে আরও আধা ঘণ্টা লাগিয়ে দিলাম।...ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, বেশি জোরে চালাবেন না, কারণ বাবার কালের জীবনটা যেন রাস্তায় না যায়।’ [পৃষ্ঠা ১৯৯]
কেন তিনি এমনটি করেছিলেন? তিনি চেয়েছেন, তাদের অনশনের সিদ্ধান্ত যেন দেশবাসী জানে। বড় ধরনের আন্দোলনের সফলতার জন্য দেশবাসীর সমর্থন দরকার। তা ছাড়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে কী প্রস্তুতি চলছে, ছাত্র ও শ্রমিকদের মনোভাব কেমন- এসবও জানা জরুরি ছিল। ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ধীরে চল’ কৌশলের কারণে গোয়ালন্দগামী স্টিমার ফেল করলেন। পরের স্টিমার গভীর রাতে। মহিউদ্দিন আহমদসহ তাকে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় থানায়। সেখানে চেনা এক লোক পেয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতাদের খবর দিতে বলেন। খবর পেয়ে কয়েকজন এলেন। তাদের বলেন, স্টিমার ছাড়বে রাতে। সন্ধ্যার পর থানা থেকে স্টিমারে যাওয়ার পথে পুলিশকে কৌশলে রাজি করিয়ে হোটেলে খাবেন। সেখানে যেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা হাজির থাকেন।
প্রকৃতই, আন্দোলন মানেই কেবল মিছিল-সমাবেশ-বক্তৃতা নয়। অনেক কৌশল করে চলতে হয়। প্রয়োজনে নমনীয় হতে হয়, কিংবা যেতে হয় কঠোর অবস্থানে। এ বুঝ বঙ্গবন্ধুর ছিল বলেই অনশনের সময় পিছিয়ে দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে জানিয়েছিলেন, অনশন করবেন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে। কিন্তু সেদিন রয়েছেন স্টিমারে। সেখানে অনশন করলে কে জানবে? তাই অপেক্ষা ফরিদপুর জেলে পৌঁছানোর।
পরদিন সকালে ফরিদপুর পৌঁছে নাশতা খাওয়ার অজুহাতে হোটেলে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের কাছে খবর পৌঁছালেন, তাদের অনশন ধর্মঘট শুরু ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে।
এ খবর ফরিদপুর থেকে ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে পৌঁছে গেল। স্থানীয়ভাবেও দলের নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ কর্মসূচি নিলেন। ভাষা আন্দেলন বেগবান করার কাজেও এ অনশন কর্মসূচি কাজ দিল। ২১ ফ্রেব্রুয়ারি ফরিদপুরে হরতাল পালনের সময় ছাত্রছাত্রীরা জেল গেটে এসে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’য়ের পাশাপাশি ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ স্লোগান তোলে।
২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল ঢাকায় সফল হয়েছে। ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করেছে। গুলি হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। অনশনে থেকেও এ খবর পেয়েছেন জেলের কয়েদিদের সূত্রে এবং সংবাদপত্র পাঠ করে। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। অনশনরত শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন ‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শীতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই।... রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নাই।’ [অসসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২০৪]
একুশের রাতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা ও কারফিউয়ের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। সর্বত্র বিক্ষুব্ধ মানুষের জটলা-সমাবেশ।
একুশের পরদিনও গুলি হয়। ছাত্রজনতা মুসলিম লীগের সমর্থনকারী পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’ জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের লোকেরা শহরে এসে মিছিল করে। অফিস, দোকান সব বন্ধ থাকে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেলওয়ে কারখানায় ধর্মঘট হয়। সরকার ধর্মঘটের চাপে বিকল হয়ে পড়েছিল। মুসলিম লীগ নিয়ন্ত্রিত পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রীয় গণপরিষদের কাছে সুপারিশ পেশ করতে বাধ্য হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনা জেনে শহর ও শহরতলির হাজার হাজার নারী-পুরুষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে চলে আসে। শহীদ হওয়া ব্যক্তিরা তাদের কাছে হয়ে ওঠেন মৃত্যুহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলা ও পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার মধ্যবর্তী ছাত্রহত্যার স্থান যেন তীর্থক্ষেত্র। পরবর্তীকালে এখানেই নির্মিত হয় কেন্দ্রীয় শহীদমিনার।
বাঙালি আনন্দ-শোকে, উৎসব-বেদনায়, শপথ-সংকল্পে যেখানে সমবেত হয় কেবল নির্দিষ্ট দিনে নয় বছরের সব সময়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানের আয়োজনও হয় এই কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে।
এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে। দিনের পর দিন হরতাল পালিত হয় ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল টানা হরতাল। শুরুতে যা ছিল ছাত্রদের আন্দোলন, ক্রমে তাতে শামিল হয় মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী এবং কৃষক ও মজুররা। বঞ্চনা কেবল ভাষাতে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সেটা তারা বুঝতে পারে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করেছে যে, তাদের ওপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতে অবিচার চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী হওয়ায় বাঙালিরা সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি এবং শেষ পর্যন্ত সর্বদলীয় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায় বাঙালিদের মনোভাব ফুটে উঠেছে।’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮]
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ বাঙালি ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি (প্রথমটি ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে) ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। এ আন্দোলন দমাতে পুলিশি ব্যবস্থা গৃহীত হয় এবং কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। মুজিব এ সময়ে চতুর্থবারের মতো কারাগারে এবং সরকারি নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে সেখানে অনশন পালন করেন। পুলিশের হাতে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে গণজাগরণ সৃষ্টি হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে জনপ্রিয় দাবির প্রতি নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। পরের বছর শেখ মুজিব একটি বিবৃতি প্রকাশ করে পুলিশের হাতে ছাত্রহত্যার দিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান।... বিদ্যমান শোষণের বিষয়েও বাঙালিরা সচেতন হয়ে উঠতে থাকে।… ধারণা হতে থাকে যে বিদ্যমান পরিস্থিতি চিরস্থায়ী হতে পারে না এবং আজ হোক বা কাল, পশ্চিম পাকিস্তানি ও বাঙালিরা চূড়ান্ত শোডাউনে মুখোমুখি হবেই।’ [পৃষ্ঠা ৬১]
এ শোডাউন হয়েছিল এবং ধাপে ধাপে সে পথেই এগিয়ে চলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রক্রিয়ায় তিনি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন শ্রেণি-পেশানির্বিশেষ আপামর বাঙালিকে।
মুক্তিপ্রদানে পূর্ব পাকিস্তান সরকার সম্মত হওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান অনশন ভঙ্গ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তির আদেশ আসে ১ মার্চ। বঙ্গবন্ধু পাঁচ দিন পর ফিরলেন গোপালগঞ্জ। শিশুকন্যা শেখ হাসিনা বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল। যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।... সাতাশ-আঠাশ মাস পরে আবার সেই পুরানো জায়গায়, পুরানো কামরায়, পুরানো বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলির কথা মনে পড়ল। ঢাকার খবর সবই পেয়েছিলাম। মহিউদ্দিনও মুক্তি পেয়েছে। আমি বাইরে এলাম আর আমার সহকর্মীরা আবার জেলে গিয়েছে।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২০৭]
একুশের হরতাল ও আন্দোলন কর্মসূচি থেকে কী শিক্ষা নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু? অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ভরসা হলো, আর দমাতে পারবে না। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই। এই আন্দোলনে দেশের লোক সাড়া দিয়েছে। ওরা এগিয়ে এসেছে। কোনো কোনো মওলানা সাহেবরা ফতোয়া দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তাঁরাও ভয় পেয়ে গেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। জনমত সৃষ্টি হয়েছে, জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়।’ [পৃষ্ঠা ২১০]
কিন্তু শাসক-শোসকদের চক্রান্ত থামেনি। দীর্ঘ কারাজীবন ও অনশনের ধকল কাটাতে তিনি মাসখানেক গোপালগঞ্জে পরিবারের সান্নিধ্যে কাটালেন। কিন্তু মুক্তির তৃতীয় দিন ১ মার্চেই ফরিদপুর পুলিশ সুপারের কাছে ঢাকা থেকে টেলিগ্রাম গেল, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখুন। যদি তিনি আবার বেআইনি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন, তাকে গ্রেফতার করতে হবে।’
তিনি হুমকির কাছে নতিস্বীকার করেননি। আদালত গোপালগঞ্জের একটি মামলায় খালাস দিলে তিনি ১৬ এপ্রিল (১৯৫২) ঢাকায় এসে মেসে ওঠেন। ২৭ এপ্রিল বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সভায় তিনি মুসলিম লীগ সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রশ্নে রেফারেন্ডাম বা গণভোট চাই। তিনি কর্মীদের গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দাবি মানা ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
এই সমাবেশে চার-পাঁচশ কর্মী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যোগ দিয়েছিল। এই বৈঠকের খবর নিয়েছেন এমন একজন গোয়েন্দা তার প্রতিবেদনে বলেছেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা নয়, কেবল পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিলে শেখ মুজিবুর রহমান তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।
ওই সময়ে বিভিন্ন মহলে সোহরাওয়ার্দীর এই অবস্থান জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ অনুরাগী হওয়ার পরও বাঙালির স্বার্থ থেকে একচুলও সরে আসতে রাজি হননি। কিছুদিন পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে নেতাকে বাংলা ভাষা প্রশ্নে তার অবস্থান পরিবর্তনে রাজি করান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি কোনো পরিবর্তন ছাড়াই মেনে নিতে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সম্মত করাতে পারেন। এভাবেই আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক দলে পরিণত হয়, যার কেন্দ্রীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পূর্ব পাকিস্তানের নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
এখানে উল্লেখযোগ্য, অনশন ধর্মঘট শেষে মুক্তিলাভ করে ঢাকা আসার পর পরই শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। ৩০ মে তিনি করাচি গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভার নির্বাচন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের দাবি করেন। দলের সভাপতি মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকসহ সব রাজবন্দির মুক্তি প্রদানের জন্যও তিনি অনুরোধ করেন। করাচি অবস্থানকালে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যে অপপ্রচার চলছে, তা নিরসনের চেষ্টা করেন। পরে তিনি লাহোর গিয়েও সংবাদ সম্মেলন করে বাংলা ভাষা আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অবস্থান তুলে ধরেন।
২১ ফেব্রুয়ারির প্রবল আন্দোলনের পরও তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে করাচি গিয়ে স্মারকলিপি প্রদানের মতো রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল অনুসরণ করেছেন। তিনি নির্বাচনের দাবি বিশেষভাবে সামনে এনেছেন। কারণ, তার স্থির বিশ্বাস ছিল নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হবেই। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘একটা কথা লাহোরে পরিষ্কার করে বলে এসেছিলাম, ইলেকশন হলে খবর পাবেন মুসলিম লীগের অবস্থা। তারা এমনভাবে পরাজিত হবে আপনারা ভাবতেও পারবেন না।’ [পৃষ্ঠা ২১৮]
তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে, জাতীয় পর্যায়ের দাবি আদায় করতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত পক্ষে আনা জরুরি। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থন চাই। ২১ ফেব্রুয়ারির পর পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দক্ষতার সঙ্গে এ কাজটি করতে পেরেছেন। সেখানে অপপ্রচার ছিল, বাঙালিরা সমগ্র পাকিস্তানের জন্যই বাংলাকে একক রাষ্ট্রভাষা করতে চায়।
পাকিস্তানের দুই অংশের রাজনীতিতে প্রভেদের বিষয়টিও তার বিবেচনায় ছিল। তিনি লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্য রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে।
শাসক-শোসক ও গণবিরোধী শক্তি কুৎসা ও মিথ্যা রটনাতে বরাবরই পারদর্শী। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বেতার ভাষণে বলেছিলেন, ‘সরকারকে হিংসাত্মক উপায়ে ধ্বংস করিয়া তৎস্থলে নিজেদের মতলব হাসিলের উপযোগী একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত করিতে চক্রান্তকারীরা চাহিয়াছিল। ইহা উল্লেখযোগ্য যে গোলযোগের সময় নারায়ণগঞ্জে একটি শোভাযাত্রায় বিক্ষোভকারীরা খোলাখুলি যুক্ত বাংলা চাই বলিয়া ধ্বনি তুলিয়াছিল।’
হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে মুসলিম লীগ এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নেতারা কত অভিনব কৌশলই না গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানের পরবর্তী বছরগুলোতেও এটা আমরা দেখেছি। এমনকি বাংলাদেশেও সেটা দেখেছি।
অজয় দাশগুপ্ত : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক-কলাম লেখক।