১৯৮৭ সালের বন্যায় যখন সারা দেশ তলিয়ে গিয়েছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ক্যাম্প বানিয়ে বন্যার্তদের জন্য রুটি, স্যালাইন বানানো হচ্ছিল শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে। ট্রাকে ও ঠেলাগাড়িতে করে ছাত্রছাত্রীরাই এগুলো বিতরণ করেছিল। এরপর সিডরের সময়েও কত কাজ করেছে ছাত্রছাত্রীরা।
প্রশ্ন জাগতে পারে কেন আমরা এখন টিএসসি নিয়ে কথা বলছি? বলছি এজন্য যে, সরকার হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই স্মৃতিময় টিএসসি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটি বহুতল ভবন তৈরি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ তম জন্মদিন উপলক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী টিএসসির আধুনিকায়নের নির্দেশ দেয়ামাত্র আমাদের গণপূর্ত বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, টিএসসি একদম ভেঙে, সেখানে তৈরি করা হবে একটি আধুনিক কমপ্লেক্স।
আমাদের আলোচনার কারণ বা কষ্টটা ঠিক সেখানেই। সবাই চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পুরোনো ও ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন হোক। আরও অনেক বেশি সুবিধাদি ভোগ করুক ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা। কিন্তু আবেদন একটাই ঐতিহাসিক নিদর্শন ও স্মৃতিচিহ্নগুলো রেখেই যেন এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়, টিএসসিকে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পদচারণ ছিল যে সময়টায় অর্থাৎ ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল, সেসময়ে সমগ্র দেশে চলছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল স্থান ছিল শিক্ষক-ছাত্র মিলনায়তন, যাকে আমরা টিএসসি হিসেবে চিনি। শুধু ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকরাই নয় পথচারী, ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক, বাসচালক, দোকানদার একনামে টিএসসিকে চিনতেন। শুধু কি এরশাদবিরোধী আন্দোলন? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং এর আগে পাকিস্তানবিরোধী বহু মিটিং হয়েছে এই টিএসসিতে। দেশের সব আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল এই টিএসসি।
টিএসসিতে কী হয় বা হচ্ছে, এ সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা ছিল না, তারা যদি কোনো কারণে বিকালে বা সন্ধ্যায় টিএসসির আশপাশে দিয়ে যেতেন বা টিএসসি চত্বরে আসতেন, তাহলে তাদের প্রথম এই ধারণা হওয়াটইি স্বাভাবিক ছিল যে, এখানে কারও ওপর কোনো অত্যাচার বা কোনো ধরনের গোলযোগ চলছে। তা না হলে, চারদিক থেকে নারী-পুরুষের এত মিলিত চিৎকার বা উঁচু গলায় নানা রকম একক শব্দ শোনা যাচ্ছে কেন?
পরে অবশ্য সবাই বুঝতে পারত এখানে কোনো গোলযোগ চলছে না। বরং স্বৈরশাসন ঠেকানোর জন্য চলছে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের আয়োজন। বিকাল থেকেই চলত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুশীলন। নাটক-গান, নাচ-আবৃত্তি ও বৃন্দ আবৃত্তি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির অফিস, ফটোগ্রাফি শেখানোর স্কুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইজ সোসাইটি, ট্যুরিস্ট সোসাইটি, দাবা ক্লাব, রোভার স্কাউট, ব্যাংক, রক্তদানকেন্দ্র সবই আছে এই টিএসসিতে।
ক্লাস শেষ করেই ছেলেমেয়েরা দলেবলে এসে ভিড় জমাত টিএসসিকে। এখনো ভিড় জমায়। অনেকেই আসে গল্প করতে, বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতে, চা ও মুড়িমাখা খেতে। শুধু যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ছাত্রছাত্রীরা আসত তা নয়, কার্জন হল, এনেক্স বিল্ডিং থেকে ও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা আসত। আমাদেরই অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল যারা বুয়েট, মেডিকেলে পড়ত কিন্তু টিএসসিতে এসে গল্পগুজব করত। দুপুরে টিএসসির খোলামেলা ক্যাফিটেরিয়াতে বসে ৫ টাকা দিয়ে পোলাও-মাংস খাওয়ার আনন্দটা আমাদের সবার মনে আছে।
বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে টিএসসিতে বা টিএসসি চত্বরে লেগে থাকত কোনো না কোনো অনুষ্ঠান। টিএসসিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পীঠস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ, বিদায় অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গেট টুগেদার, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব হতো টিএসসি ঘিরেই।
এছাড়া বাংলা একাডেমির বইমেলার একটি সম্প্রসারিত অংশ হচ্ছে টিএসসি। পয়লা বৈশাখেও বটমূলে গান শুনে আমরা সবাই এসে টিএসসিতে সমবেত হতাম। একুশের প্রথম প্রহরে টিএসসিতে সমবেত হয়ে, এরপর যেতাম শহীদমিনারে ফুল দিতে। কত প্রেম, কত ভালোবাসাবাসি, মান-অভিমান, বন্ধুত্ব, প্রেম ভেঙে যাওয়ার গল্প লেখা আছে টিএসসির দেয়ালে।
এত গেল আমাদের ব্যক্তিগত সুখস্মৃতি। কিন্তু শুধু ব্যক্তির কথা নয়, টিএসসি ঘিরে এরকম আবেগময় স্মৃতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর। এখনো অনেকেই তাদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের হাত ধরে টিএসসি, কার্জন হল, অপরাজেয় বাংলা, হাকিম চত্বর, লাইব্রেরি, আর্ট ইনস্টিটিউট দেখাই আর পুরোনো দিনের গল্প শোনাই।
১৯৬১ সালে টিএসসি তৈরি করা হয়েছিল এজন্য যে, এখানে ছাত্র-শিক্ষকরা মিলিত হয়ে পড়াশোনার বাইরেও অনেক কাজ করবেন, করবেন আনন্দ। এটা হবে শুধু তাদেরই জায়গা। টিএসসির ডিজাইন করেছিলেন গ্রিক স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ Constantions Apostolos Doxiadis। এই স্থাপত্যশৈলিতে গুরুত্ব পেয়েছে আদিবাসী সংস্কৃতি, দেশের আবহাওয়া, বায়ু চলাচল ব্যবস্থা, যথাযথভাবে জায়গার বিস্তার। ভবনটি যেন শীতল থাকে, সেজন্য দেওয়া হয়েছিল দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদ। তিনি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক ডিজাইন অনুসরণ করে এর নকশা এঁকেছিলেন। টিএসসির এই ডোম শেইপটি সবার কাছে খুব পরিচিত।
টিএসসির সবুজ ঘাসের লনের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটি গ্রিক সমাধি। ১৯১৫ সালে তৈরি এই সমাধিসৌধটি গ্রিক স্থাপত্যকলার ডরিক ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে। যে অল্পসংখ্যক গ্রিক পরিবার ১৯ শতকে ঢাকায় বসবাস করত, এটি ছিল তাদেরই সাক্ষী। এই সমাধির পাশে গ্রিক ভাষায় লেখা কিছু এপিটাফও রয়েছে।
মানব ইতিহাস গণনায় স্থাপত্যরীতি দেখেই অনুমান করা হয় যে, কোন জাতির সভ্যতার যাত্রা কবে থেকে শুরু হয়েছে? সাহিত্য প্রমাণ দেয় কোন জাতি কত আগে থেকে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত আছে। কাজেই অসাধারণ সুন্দর, ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলাটা রীতিমতো অন্যায় হবে। আমাদের পরের জেনারেশন জানতেই পারবে না এরকম এটা নিদর্শন সম্পর্কে। মূল অংশটাকে ধরে রেখে কি এর সম্প্রসারণ সম্ভব নয়?
বিশ্বের অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন আছে, যেগুলোর পুরোনা ভবন এবং স্টাইল ঠিক রেখেই, আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাতো আছেই, পাশের দেশ ভারতেও কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙা হয় না, মেরামত করা হয়। বিশ্বে অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে যা, খ্রিষ্টের জন্মের আগের। অথচ মানুষ এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করে ব্যবহার করছে হাজার হাজার বছর।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পুরোনো স্থাপনাগুলোকে পুরাতত্ত্ব হিসেবে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির মাপকাঠি বোঝাতে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডের কথা বলছি, এক হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ভবন আছে, যা আধুনিক ভবনগুলোর সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়েছে, উজ্জ্বল অতীতের স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে।
দ্বিতীয় পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখানেও অনেকগুলো ভবন, নির্বাহী আদেশে আইন প্রণয়ন করে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যাতে এগুলোকে কখনো ধ্বংস করা না হয়। এমনকি কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন আনার ক্ষেত্রেও স্মরণ রাখতে হবে যে, যাতে ভবনের পুরোনো চেহারা এবং ঐতিহাসিক মূল্য নষ্ট না হয়।
ভারতে অসংখ্য পুরোনো ভবন আছে, যা সরকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সরকার অধিগ্রহণ করেছে। রক্ষণাবেক্ষণসহ সব দায়িত্ব সরকারের। এগুলো দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে। সরকারের কোষাগারে অনেক টাকা আয়ও হচ্ছে।
এই ভারতেই সাতটি অতিপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলো ১৮০০ দশকের কোনো না কোনো সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রীরামপুর কলেজ, ইন্ডিয়ান ইনসটিটিউট অব টেকনোলজি, মুম্বাই, মাদ্রাজ, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানকালের ছবি দেখলেই বোঝা যায় যে, ব্রিটিশ আমলে তৈরি কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখেই সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে, বুলডোজার দিয়ে ভেঙে নয়।
ঐতিহাসিক নিদর্শনকে ধরে রেখে যদি হাজার বছরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের আধুনিক বানাতে পেরেছে, আমরা পারব না কেন? পারব, শুধু ইচ্ছাটা থাকতে হবে। বিশ্বজুড়ে স্থাপত্যবিদদের কাছে এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোকে কীভাবে আধুনিকায়নের সঙ্গে সংগতি রেখে রক্ষা করা যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ, টিএসসি ও পাবলিক লাইব্রেরি আধুনিকায়নের কথা বলেছেন। টিএসসিতে একটি অডিটরিয়াম হবে ১৫০০ আসনবিশিষ্ট। দুটি হবে ৩০০ আসনের। নতুন রিহার্সাল রুম, ক্যাফেটেরিয়া, ইনডোর গেম, পার্কিং, গেস্ট রুমসহ আরও অনেক কিছু হবে।
আমরা টিএসসির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের বিরুদ্ধে নই। ছাত্রছাত্রীদের ও সময়ের প্রয়োজনেই এর দরকার আছে। তবে সবটা ভেঙেচুরে নতুন করার পক্ষেও নই। টিএসসি আধুনিকায়নের কাজটি কি কোনোভাবেই বর্তমান কাঠামোর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে করা যায় না?
ঝকঝকে তকতকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভবনের চেয়ে এই পুরানো টিএসসির স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমাদের টানে বেশি। কারণ, আমাদের মতো লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর ব্যক্তিগত আবেগ ও ইতিহাস জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে।
পুনশ্চ: লালন ফকিরের সমাধিস্থল উন্নয়ন করার নামে সেখানে যা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে, তা দেখে আমার মনে হয়েছে, এখন শুধু ভবনগুলোই আছে, সেখানে লালন ফকির নেই।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন