বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কার্বন নিঃসরণে ঘনিয়ে আসছে ভয়াবহ এক দুর্যোগ

  • আতাহার খান   
  • ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১২:৪০

আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হলো, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো।

জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান দু’টি পদার্থ কয়লা আর ডিজেল। এ দু’টি পদার্থের ব্যবহার এখন পৃথিবীতে সব থেকে বেশি। ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়ে গেছে মারাত্মকভাবে। কার্বনের এই নিঃসরণ যদি কমিয়ে আনা না-যায় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে এক বার করে ৩০ কোটি মানুষ বসবাসের বিশাল এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে।

এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় শহর। দেড় শতাধিক দেশের ১১ হাজারের বেশি বিজ্ঞানী এই সতর্ক করে আরও জানিয়েছেন, পরিবেশ প্রশ্নে প্রচলিত পথ না-পালটালে মানব জাতির ওপর নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের মাসিক বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনের একটি সংখ্যায় প্রকাশিত এই খবর বিশ্ববাসীর জন্য রীতিমতো উদ্বেগজনক ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে!

তার মানে কয়লা আর ডিজেলের সর্বাধিক ব্যবহারের ফলে আজ ভয়াবহ এই দুর্যোগ বিশ্ববাসীর সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনও গুরুত্ব দিচ্ছি না। যেন কিছুই ঘটছে না- এরকম ভাব বজায় রেখে আমরা আছি দিব্যি। এই মানসিকতা দুঃখজনক বৈ আর কিছু নয়। অথচ বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি হিসেবে কয়লা, ডিজেলের ব্যবহার যেভাবে বেড়ে গেছে, তাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, কয়লা ও ডিজেলের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ ঘটে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের। এই গ্যাস শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতাই বাড়াচ্ছে না, ওজোনস্তরকেও দুর্বল করে দিচ্ছে দিন দিন।

তাই প্রশ্ন উঠছে যে, কয়লা ও ডিজেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব? আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে জলবায়ু। দক্ষিণ ও উত্তর মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের পানির পরিমাণও গেছে বেড়ে। তার ওপর আবার বহুগুণ বেশি দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ সব কারণ চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় শিল্পোন্নত দেশগুলো মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করছে কয়লা, ডিজেল। এতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উদ্গীরণ বেড়ে গেছে ভয়াবহরকমভাবে। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন স্তরকে।

আমরা জানি, পৃথিবীর চারদিক ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডল বেশকিছু গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। এসব গ্যাস মশারির মতো পরমযত্নে ঘিরে রাখে এই পৃথিবীকে। হ্যাঁ, প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, কোন কোন গ্যাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বায়ুমণ্ডল? বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সেই গ্যাসগুলো হলো অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি। এ কথা স্বীকার না-করে উপায় নেই, জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব সীমাহীন। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ, পৃথিবীকে আবৃত করে থাকা বায়ুমণ্ডল দিন দিন তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। মানুষ তার অপরিণামদর্শী কৃতকর্মের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। তারপরও পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই কিছু রক্ষাবর্ম আছে। তার মধ্যে একটি ওজোন স্তর। বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন আবার দুটি স্তরে বিভক্ত।

প্রথম স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০-১৬ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত, এই অংশকে বলা হয় ট্রপোস্ফিয়ার- সেখানে ১০ শতাংশ ওজোন বিরাজ করে। আর দ্বিতীয় স্তর ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে শুরু করে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত, এই দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। সাধারণভাবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের অংশটাই হলো ওজোনস্তর। সেখানে ৯০ শতাংশ ওজোন বিরাজ করে।

এই দ্বিতীয় স্তরটি ওজোন গ্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের বিশেষ আচ্ছাদন, যাকে বলা হয় ছাকনি। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের রশ্মি পরিশোধিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। ফলে ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে জীব জগৎ। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই ওজোন স্তর যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিতক খেয়াল রাখার পবিত্র দায়িত্ব আমাদেরই।

ওজোন গ্যাস যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের শৃঙ্খলিত নিয়ম ভেঙে পড়বে। এলামেলো হয়ে যাবে সব কিছু। মানুষের ত্বকে ক্যান্সার, চোখে ছানি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি ঝুঁকি বেড়ে যায়। শ্বেতবর্ণের মানুষের ত্বকে ক্যান্সারের জন্য অতিবেগুনি রশ্মি দায়ী। সামুদ্রিক প্রাণিকুলও অতিবেগুনি রশ্মির কারণে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। সে অবস্থা যদি সত্যিই দেখা দেয়, তাহলে মানুষের জন্য প্রকট হয়ে দেখা দেবে প্রোটিন ঘাটতি। সামুদ্র থেকে আহরিত খাদ্যশৃঙ্খখলাও পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।

শুধু কি তাই, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধিতেও বাধা দান করে। ফলে শস্যের উৎপাদন হ্রাস পায় এবং বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা জানি, বৃক্ষরাজি কার্বন ডাই অক্সাইড শোধন করে। যদি উদ্ভিদ ও বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসে তবে বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোটা শোধন হয় না, অবশিষ্ট কিছু অংশ অপরিশোধিত অবস্থায় থেকে যায়। এভাবে অপরিশোধিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুমণ্ডলকে করে তুলছে অনিরাপদ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন করছে ত্বরান্বিত। আজ, আমরা আসলেই সেই মারাত্মক ঝুঁকির মুখোমুখি এসে পড়েছি।

পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ওজোন স্তরকে তার আগের অবস্থায় যেকোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এজন্য প্রয়োজন মন্ট্রিল প্রটোকলের বাধ্যবাধকতাগুলো অনুসরণ করা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটা যদি ঠিকমতো পালন করা হয় তাহলে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি ওজোন স্তরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাই আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী বাকি যেসব দ্রব্য রয়েছে সেগুলোর উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং সেক্টরে এইচসিএফসি’র ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বন্ধ করার জন্য উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হলো, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

আমরা জানি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পর তা শোধন করে সবুজ গাছগাছালি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমাদের এই পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার একটি প্রধান কারণ হলো জীবাশ্ম গ্যাস, যাকে আমরা বলি গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট। বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন ও মিথেনসহ অন্যান্য গ্যাস এত বেশি বেড়ে গেছে যে, গত দেড় লাখ বছরের চেয়েও তা অনেক বেশি। আমাদের স্বীকার করতে হবে, এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা।

হ্যাঁ আমরা মানছি, এই মহাবিপদ সত্যিই কোনো একটি দেশের পক্ষে একা মোকাবিলা করা যাবে না। বিষয়টি যেহেতু বৈশ্বিক, তাই একে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। মানব জাতিসহ জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার বিষয়। একে হাল্কাভাবে দেখা মানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে আহ্বান করা। তাই সময়ক্ষেপণ না করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে এনে কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়ার যে আহ্বান ১৮৭টি দেশ প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে করেছিল তাকে বাস্তবরূপ দিতে হলে পরিবেশ প্রশ্নে প্রচলিত ধারণা পালটাতে হবে প্রথমে। সুখবর হলো, মাদ্রিদ সম্মেলনের পর পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়টি ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশই গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে এর বিকল্প উপায়ও বেছে নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একদিন না একদিন সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে বাসযোগ্য সুন্দর এক পৃথিবী।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি

এ বিভাগের আরো খবর