বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ভয়, প্রতিক্রিয়াশীল, অন্ধকারের কুশীলবদের। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে তারা যেমন ভয় করত, মৃত বঙ্গবন্ধুকে তার চেয়ে বেশি ভয় তাদের। বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নৃশংসভাবে হত্যার পরেও প্রগতির পথে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে চলে, তখন মৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছায়া তাদের তাড়িত করে। বঙ্গবন্ধুকে কেন এত ভয়? ভয়ে উদভ্রান্ত হয়ে তার সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার প্রয়োজন বোধ করে তারা।
পঁচাত্তরের পরে যে প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছিল, সেই প্রচেষ্টা এখনও বহমান। বঙ্গবন্ধু ও তার নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ থেকে অর্জিত আদর্শগুলো আসলে এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর দৃশ্য, অদৃশ্য সব আদর্শবাহী স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ যে আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে আদর্শ শূন্যে মিলিয়ে যাবে বলে তারা বিশ্বাস করে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি নিষিদ্ধ ছিল। শুধু বঙ্গবন্ধু কেন? ‘জাতির পিতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জয়বাংলা’সহ অসংখ্য শব্দ পত্রিকার পাতা, পাঠ্যপুস্তক থেকে নিষ্ঠুরভাবে ছেঁটে ফেলা হয়। শুধু কি শব্দ? আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করে জাতিকে পেছনদিকে ঠেলে দেওয়া হয়। জীবিত বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর তার আদর্শের ছায়া যাতে বাংলাদেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারে, তাই উন্মাদের মতো তাকে ইতিহাসের পাতা থেকে, মানুষের হৃদয়ের কোঠর থেকে চিরতরে বিস্মৃত করে দেওয়ার সব আয়োজন চলতে থাকে।
ম্যাকবেথ নাটকে সেনাপতি ম্যাকবেথ উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সীমাহীন লোভ এবং লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনায়, তার দুর্গে অতিথি হয়ে আসা রাজা ডানকানকে ঘুমের মধ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের পর, ক্ষমতা হারানোর ভয় নানাভাবে তাড়িত করে ম্যাকবেথ ও লেডি ম্যাকবেথকে। বিভ্রম চেপে বসে মনে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও নিরাপদ করার জন্য একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে নব্য রাজা ম্যাকবেথ। কী আশ্চর্য মিল! রাজা ডানকানকে যেমন হত্যা করেছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতি, বাংলাদেশেও উচ্চাকাক্ষী সেনাপতির পরোক্ষ আদেশেই নিহত হন বঙ্গবন্ধু একদল সেনা সদস্যের হাতে। রাজা ডানকান অবশ্য খুন হন একাই, আর বঙ্গবন্ধুকে সেনা সদস্যরা খুন করে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ। রাজা ডানকান নিহত হওয়ার পর ম্যাকবেথ এবং লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে সামান্য হলেও অপরাধবোধ কাজ করেছিল, আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যাকারীরা ও তাদের আদেশদাতা সদর্পে বিচরণ করতে থাকে। তার মানে, শেকসপিয়র তার কল্পনাবোধ দ্বারা অপরাধের, নৃশংসতার যে মাত্রায় পৌঁছতে পারেননি, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা সে মাত্রা সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়।
ম্যাকবেথ নাটকে রাজা ডানকানকে হত্যা করা হয় ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষায়। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় শুধু ক্ষমতালাভের জন্য নয়। বঙ্গবন্ধু তো শুধু জাতির পিতা, রাষ্ট্রপ্রধানই ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করা এক মহান মানুষ। বঙ্গবন্ধু প্রগতি, মানবতা, বাঙালি সংস্কৃতি আর অসুন্দরের অপশক্তির মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুরক্ষা প্রাচীর। বঙ্গপোসাগরের মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে বঙ্গবন্ধু গণমানুষের শাসনপ্রতিষ্ঠা, বৈষম্য হ্রাস, ধর্মান্ধতাকে দূর করে ধর্মনিরপেক্ষ এক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অবিচল। তার অবস্থান অনেকটা হিমালয় পর্বতের মতো। ওই যে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের পর তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’ ফিদেল কাস্ত্রোর সেই হিমালয় আসলে দাঁড়িয়েছিলেন সমস্ত অপশক্তি, ধর্মান্ধতা ও মানবমুক্তির প্রত্যয় নিয়ে। শুভ ও অশুভ, আলো ও অন্ধকার, প্রগতি ও পশ্চাৎপদতার মধ্যে ছিল তার হিমালয়সম অবস্থান। তার এই দৃঢ় অবস্থানের জন্যই তাকে দেশীয় অপশক্তির দ্বারা আন্তর্জাতিক শক্তির নির্দেশে হত্যা করে আপাতভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন মানুষের পাশে ছিলেন। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, প্রান্তিক মানুষের কল্যাণে তিনি তার জীবন সঁপে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক লেখায় অসংখ্য সাধারণ মানুষের খোঁজ পাই আমরা। তাদের দুঃখে সমব্যথী এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ তিনি। নির্ভীক বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে সুস্পষ্টভাবে ঘোষাণা দিয়েছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত মানুষ। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এই যে তার সুস্পষ্ট অবস্থান, এই অবস্থান তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। সারা পৃথিবীর মানুষ বিস্মিত হয়েছিল, তাকে যারা ভালোবাসতেন, তারা তাদের অন্তরে সসম্মানে ঠাঁই দিয়েছিলেন চিরদিনের জন্য। আর যারা ভালোবাসত না, তারাও তাকে বাঁধার প্রাচীর হিসেবে সেদিন চিহ্নিত করে রেখেছিল। পরবর্তী সময়ে তারাই তাকে দৈহিকভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা’ কিংবা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে দেখা যায়, জেল থেকে বেরিয়েই তিনি সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি মহকুমায় বড় বড় সভা করেছেন। সেই সভাগুলোতে বঙ্গবন্ধু তার অসাধারণ আন্তরিক ভঙ্গিতে জনগণের সঙ্গে সংলাপের মতো করে বক্তব্য রাখছেন। এই জনসম্পৃক্ততাই তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে মুকুটবিহীন রাজার স্থান পেতে সহায়তা করেছে। জনগণের নেতাকে জনগণের সঙ্গে থাকতে হয়, আর বঙ্গবন্ধু এবং বাংলার জনগণ এতই একাত্ম ছিল যে, বঙ্গবন্ধু কোনো অবস্থাতেই জনবিচ্ছিন্ন হতে পারেননি। তার নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠস্বরে রূপারন্তরিত হয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের হাত একটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের আকার ধারণ করে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দাবিও ঠিক একটি দাবি নিয়ে এগিয়ে যায়। শোনা যায়, তাঁকে হত্যা করার পাঁয়তারা যখন চলছে বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে তাকে পূর্ণ নিরাপত্তায় সরকারি বাসভবনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে বরণ করেছেন; কিন্তু জনগণ থেকে দূরে সরে যাননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ৩২ নম্বরের তার ব্যক্তিগত বাড়িতেই তিনি অবস্থান করেছেন। মৃত্যু না জনগণের কাছে থাকা- এই দু’টির মধ্যে তিনি জনগণের কাছে থাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির রজ্জুর সামনে দাঁড় করিয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়েও তাকে জনবিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের আজকের এই অভূতপূর্ব উন্নতির বীজ রোপণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধুর দেখা স্বপ্নের বিজয়কেও প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ শক্তি সহ্য করতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বার বার ফিরে আসেন, হাজার গুণ শক্তি নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো, ছাইভস্ম থেকে উঠে আসে তাঁর জীবন্ত আদর্শ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই ফিরে আসাকেই যত ভয়, তাই জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তাদের লড়ে যেতে হয় নানা কৌশলে অবিরত।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের সামনে বিস্ময় তৈরি করতে পেরেছে। আর সব বিস্ময়ের শিকড় নিহিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ তাই বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি ও স্বপ্ন, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের রূপকার হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। রূপকারের সমান্তরাল রূপকার, ইতিহাসের সমান্তরাল মিথ্যা ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদ দাঁড় করিয়েও বঙ্গবন্ধু অনুসরিত বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতিকে কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যায়নি।
বাংলাদেশ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শবাহী যেকোনো স্মৃতিকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা চলতে থাকবে। সেই চেষ্টা যতই চলুক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা যাবে না জাতির পিতার আদর্শকে। রাতের আঁধারে তারা বার বার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙতে যাবে, মানুষের মনে লালন করা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কখনো বিলীন করা যাবে না। যেমন-স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদমিনারের ওপর বার বার আঘাত আসে; কিন্তু আমাদের ভাষা, সংস্কৃতির বিজয়রথকে থামিয়ে রাখতে পারেনি কোনো অপশক্তি। বাংলা ভাষা এখন জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত ও সমাদৃত ভাষা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যেমন রুখে দিতে পারেনি বাংলাদেশবিরোধী কোনো শক্তি, বাংলাদেশের উন্নয়নকেও স্তিমিত করতে পারবে না অন্ধকারের অপশক্তির দল। বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথরোধ করতে যারা চায়, তারা বার বার ব্যর্থ হয়েছে। তাদের জনভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল, যদিও তাদের হুংকারে আমরা কখনো কখনো বিভ্রান্ত হই। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি বাংলাদেশে লাখো কোটি মানুষ, যাদের অন্তরে বসবাস করেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতির কবি। সেই কবির দর্শনেই আজ বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য। আমরা বিশ্বাস করি, দুর্দমনীয় বাঙালি দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে অনেক দূরে। যে পথের অনেক মাইলস্টোন এরই মধ্যে আমরা পেরিয়ে গেছি, আরও অর্জন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
লেখক : উন্নয়ন-গবেষক ও কলাম লেখক