বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হরিণের চামড়া যায় কোথায়?

  •    
  • ৩০ জানুয়ারি, ২০২১ ১৮:২৮

সুন্দরবন থেকেই হরিণের চামড়ার জন্য এখনও সবচেয়ে বড় খুনখারাবিটি চলে। যারা হরিণ ধরে ও খুন করে এবং স্থানীয়ভাবে চামড়া, শিং বা বন্যপ্রাণীর ট্রফি বিক্রি করে তাদেরকে মাঝে মধ্যে আটক করে প্রশাসন। কিন্তু যারা এসব চামড়া ও ট্রফি ব্যবহার করে তাদের কোনো শাস্তি বা দৃষ্টান্তমূলক আটকের কথা কিন্তু সচরাচর আমরা দেখি না।

আবারও হরিণের চামড়া উদ্ধার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। বাগেরহাটের শরণখোলার রায়েন্দা থেকে ২৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে ১৯টি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়। করোনা মহামারিকালে আমরা ভেবেছিলাম মানুষ কিছুটা হলেও প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি সদয় হবে। নিজের সুরক্ষা আর অস্তিত্বের স্বার্থেই। কিন্তু কিছু মানুষের এলোপাথাড়ি লোভ আর লাগামহীন অন্যায় বিলাসিতা কিছুতেই যেন থামাতে পারেনি এই নিদারুণ মহামারি।

সিলেটের হরিপুরে প্রশ্নহীনভাবে একের পর এক পাখির লাশ রান্না হচ্ছে। মানুষ সেসব লাশ খাচ্ছে আর সমানে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। দেশজুড়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘডাঁশ, বানর, মেছোবাঘ ও পাখি। বন্যপ্রাণীর লাশ নিয়ে নানাভঙ্গিতে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভাইরাল করছে অনেকে। মিলছে বন্যপ্রাণীর বিশাল চোরাচালান। এবার আবাওে উদ্ধার হলো হরিণের চামড়ার বিশাল দোকান। বিশাল তো অবশ্যই, যে দেশের নতুন প্রজন্ম নিজচোখে একটি দুটি হরিণ দেখেনি সকলে সেখানে ১৯টি হরিণের চামড়া। মানে চামড়ার জন্য এই ১৯টি হরিণকে খুন করা হয়েছে। ১৯টি হরিণের জন্য এতিম হয়েছে অনেক হরিণশাবক। ভয়ে হরিণেরা হয়তো বিচরণস্থল বদলে ফেলেছে। এমন ঘটতে থাকলে বন্যপ্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুতন্ত্র সবই জটিল বিপদের মুখে পড়বে। কিন্তু দেশে এত হরিণের চামড়া যায় কোথায়? কারা কেনে আর কারা বেচে? এই চামড়া দিয়ে মানুষ কী বানায়?

সুন্দরবন থেকেই হরিণের চামড়ার জন্য এখনও সবচেয়ে বড় খুনখারাবিটি চলে। যারা হরিণ ধরে ও খুন করে এবং স্থানীয়ভাবে চামড়া, শিং বা বন্যপ্রাণীর ট্রফি বিক্রি করে তাদেরকে মাঝে মধ্যে আটক করে প্রশাসন। কিন্তু যারা এসব চামড়া ও ট্রফি ব্যবহার করে তাদের কোনো শাস্তি বা দৃষ্টান্তমূলক আটকের কথা কিন্তু সচরাচর আমরা দেখি না। যদি ব্যবহার ও চাহিদা বন্ধ না করা যায়, তবে হরিণ খুন হবেই; হরিণের চামড়া বিক্রি হবেই। আটকাতে হবে চাহিদার উৎস, আইনের আওতায় আনতে হবে ব্যবহারকারীকে।

বন্যপ্রাণী আইনের সংজ্ঞায় বন্যপ্রাণীর চামড়া, হাড়, শিং, দাঁত ও শরীরের অংশকে বলে ‘ট্রফি’। ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত র‌্যাব প্রায় ৭টি বাঘের চামড়া, ৩টি বাঘ দাঁত ও ৬৯টি হরিণ চামড়া উদ্ধার ও আটক করেছিল।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখেছি, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে ২৮ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৯টি বাঘ চামড়া উদ্ধার হয়েছে। এর বড় অংশটিই করেছে র‌্যাব। বনবিভাগ, পুলিশ, কোস্টগার্ডও বাঘ-হরিণের চামড়া এবং ট্রফি উদ্ধারে ভূমিকা রেখেছে। এর আগে ২০১১ থেকে ২০১৫-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাঘ ও হরিণের চামড়া উদ্ধার-বিষয়ক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখেছিলাম মোট ১৪টি বাঘের চামড়া আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হরিণের চামড়া আটক হয়েছে ৯২টি।

এ তো গেল আটক হওয়া চামড়ার তথ্য। আর এখান থেকে খুব ছোট একটা ধারণা পাওয়া যায় কেমন হারে হরিণ খুন হচ্ছে সুন্দরবনে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যেসব চামড়া বা ট্রফি উদ্ধার কিংবা আটক হচ্ছে না তার হিসাব কীভাবে হবে? মানে শুধু আটক হওয়া চামড়ার সংখ্যা গুণেই কি আমরা বলব সুন্দরবনে এতগুলো হরিণ হত্যা হয়েছে?

১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি কার্যক্রমের সভায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের ধ্বংসের আশঙ্কার বিষয়টি প্রথম উত্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ২১টি দেশের সাক্ষরদানের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদপ্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সম্মেলন ১৯৭৩ (সাইটেস) সনদ’।

বাংলাদেশ ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর এই সনদ অনুমোদন করে এবং ১৯৮২ সনের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে এই সনদটি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হয়। সাইটেস অনুযায়ী বাঘ, হরিণ বাণিজ্য নিষিদ্ধ। দেশে বিদ্যমান ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ অনুযায়ী বাঘ ও হরিণ হত্যার ক্ষেত্রে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব বিধান দিয়ে কি হরিণের চামড়ার বাণিজ্য রোধ করা যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে না? কারণ বন্যপ্রাণীর এক দশাসই কর্পোরেট বাজার চাঙা আছে। আর এই বাজারকে প্রশ্ন না করতে পারলে, এই বাজারকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে হরিণ, বাঘ বা বন্যপ্রাণীরা কোনোদিন নিরাপদে বিচরণ করতে পারবে না।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম খেলোয়াড় সৌম্য সরকার। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাতক্ষীরায় নিজ বাড়িতে হরিণের চামড়া বিছিয়ে বিয়ের নানা কৃত্যে অংশ নেয়া এই বিখ্যাত ক্রিকেটারের ছবি ভাইরাল হয় গণমাধ্যমে। কিন্তু ঘটনার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি, হরিণের চামড়ার জন্য কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচারও হয়নি। এরপর নিদারুণভাবে শুরু হয় করোনা মহামারি, আর ঘটনাটি ঢাকা পড়ে যায়। হরিণের চামড়া ব্যবহারের জন্য সৌম্য সরকারের বিচার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারত। তবে যারা এই চামড়া বা ট্রফি ব্যবহার করেন তারা কিছুটা হলেও একটা চাপের ভেতর থাকতেন। হয়তো ব্যবহারকারী ও চামড়ার চাহিদা না থাকলে সুন্দরবন থেকে হরিণ খুন করে চামড়ার জন্য আশেপাশের গরিব মানুষ আর জীবনবাজি রাখতো না।

করোনা মহামারিতে এসব প্রশ্ন জোরেসোরে তোলা জরুরি। বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য ও বাজার রুখতে হলে এর ক্রেতা-ভোক্তার নাম-পরিচয় সবার সামনে তুলে ধরা জরুরি। এদেরকে আইন ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি। কারণ তা না হলে একের পর এক প্রশাসন বন্যপ্রাণী কী হরিণের চামড়া আটক করবে কিন্তু এর চাহিদা ও ব্যবহার বাড়তেই থাকবে। আশা করব কেবল হরিণের চামড়া বিক্রেতাকে নয়, এর ক্রেতা-ভোক্তা-ব্যবহারকারীকেও ধরা হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুরক্ষিত হবে হরিণসহ বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণস্থল।

লেখক: উন্নয়নকর্মী, গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য-বিষয়ক।

এ বিভাগের আরো খবর