করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সারাবিশ্বই গত একবছর নাকাল অবস্থায় ছিল। কিন্তু তারপরও এই প্রথম করোনা মোকাবিলায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বেশ কয়েকটি দেশ সফল হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশও একটি টিকা উদ্ভাবনের সাফল্য দাবি করছে। ভ্যাকসিনটি এখনও ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশের উদ্ভাবিত টিকা এ বছরের মাঝামাঝি-পরবর্তী সময়ে বাজারে আসতে পারে। ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, রাশিয়া ও চীন এরই মধ্যে একাধিক টিকা উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া শেষে তা বিতরণ শুরু করেছে।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীগণ সবার আগে যে টিকাটি করোনা ভাইরাস মোকাবিলার জন্য উদ্ভাবন করেন সেটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি অস্ট্রাজিনাকার টিকা হিসেবে পরিচিতি। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান (এফডিএ), ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সকল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানই প্রয়োগের জন্য টিকাটি অনুমোদন দিয়েছে। এই টিকাটি অস্ট্রাজেনিকা কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদনের জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ভারতে সিরাম কোম্পানি এর মধ্যে অন্যতম। স্বভাবতই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে টিকাপ্রাপ্তি নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। ধনী দেশগুলোর হাতে বিপুল অর্থ থাকায় অনেক দেশই টিকাগুলো অনুমোদন লাভ করার আগেই ক্রয়ের আদেশ দিয়ে রেখেছে।
আমাদের মতো দেশগুলো টিকা কূটনীতি ও বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় এর সঙ্গে এঁটে ওঠার কথা নয়। গতবছরই আমরা এ নিয়ে বিভিন্ন দেশের উচ্চপর্যায়ে কূটনীতি ও বাণিজ্যের লক্ষণ দেখতে পেয়েছি। তারপরও বাংলাদেশ সরকার টিকালাভের জন্য পূর্ব-পশ্চিম সবদিকেই যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিল। একসময় মনে হয়েছিল চীনা টিকা আমরা কিনতে যাচ্ছি। কিন্তু চীনা কোম্পানি ট্রায়ালসহ কিছু অর্থ ও ঋণ প্রদানের কিছু শর্ত দেয়ায় বাংলাদেশ থমকে দাঁড়ায়। সেই সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করেন।
বাংলাদেশ অস্ট্রাজেনিকা কোম্পানির টিকা পাওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়। ভারতীয় সিরাম কোম্পানি স্থানীয় এজেন্ট বাংলাদেশের বেক্সিমকো এক্ষেত্রে তিনকোটি টিকা বাংলাদেশের প্রাপ্তির নিশ্চয়তা লাভ করে। টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ টিকা লাভ করার প্রতিশ্রুতি পায়। ফলে বাংলাদেশ অনেক ধনী দেশের চাইতেও টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যায়। এ নিয়ে গেল বছরের ডিসেম্বরে নানারকম খবর আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছিল।
আমাদের দেশে বিএনপি তথা সরকারবিরোধী গোষ্ঠী ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে নানারকম সন্দেহ ও অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপন করতে থাকে। সরকারকে করোনা মোকাবিলায় এবং ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে নানাভাবে ব্যর্থ বলে অভিহিত করা হতে থাকে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু দেশ সবেমাত্র ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করেছিল। বাংলাদেশ সরকারও তখন জনগণকে জানুয়ারির যেকোনো সময়ে দেশে ভ্যাকসিন আনা এবং প্রয়োগের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিল। পরে যখন অস্ট্রাজেনিকার টিকা ভারতের সিরাম কোম্পানি থেকে আসার কথা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তখন বাংলাদেশে ‘হইহই রইরই গেল গেল সব গেল’ এমন একটি চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে গেল বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কথাবার্তায়। তারা তখন দাবি করতে থাকে কেন ভারত থেকে টিকা আনা হচ্ছে। কেন একমাত্র বেক্সিমকো কোম্পানিকে টিকা আনার অনুমতি দিয়ে সরকার অর্থ লুটপাট করার ব্যবস্থা করছে বলে দাবি করতে থাকে।
১৬ জানুয়ারি ভারতে সিরাম কোম্পানির টিকাকরণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধন করার পর বাংলাদেশে স্যোসাল মিডিয়াগুলোতে নানাধরনের আজগুবি খবরাখবর দিয়ে মানুষকে টিকা সম্পর্কে ভয় পাইয়ে দেওয়ার মহামিশন প্রচার হতে থাকে। এতে বলা হয় যে, এটি অক্সফোর্ড টিকা নয়, ভারতের গোমূত্রতে তৈরি টিকা। মুসলমানদের জন্য এই টিকা নেয়া হারাম বলেও কেউ কেউ ফতোয়া দিতে থাকেন। এ ছাড়া আরও বলা হয় যে, ভারত ২ ডলার করে অস্ট্রাজেনিকা থেকে টিকা ক্রয় করেছে। বেক্সিমকো তা বাংলাদেশ সরকারকে ৫ ডলারে বিক্রি করে বিপুল অর্থ লুটে নিচ্ছে। সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ভারত বিরোধিতার জিগির এমনভাবে তোলা হয়, যেন এই টিকা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের কাছে নতজানু পররাষ্ট্রনীতির প্রকাশ ঘটিয়েছে।
আবার একথাও বলা হয়ে থাকে যে, ভারতের চিকিৎসকসহ অনেকেই এই টিকা নিচ্ছেন না, বাংলাদেশে ট্রায়াল প্রদানের মাধ্যমে আমাদের জনগণকে সরকার টিকটিকি ও তেলাপোকার মতো মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্ভট অপপ্রচার তখন অনলাইনগুলো ছেয়ে গিয়েছিল। এমনকি প্রেস কনফারেন্স করে বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অস্ট্রাজেনিকার টিকার বিরুদ্ধে মনের মাধুরী মিশিয়ে কথা বলেছেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একজন আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তারসহ আরও কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠীকেও নানারকম অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। সেসব কথাবার্তা আমাদের বেসরকারি অনেক টেলিভিশনেও সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হয় আবার টকশোগুলোতে ওই নেতৃবৃন্দ গলা ফাটিয়ে এই টিকার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলেছেন। তাদের এই কথাবার্তায় নিশ্চয় অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। অনেকেই টিকা নিয়ে বিশ্বে যে ধরনের সংকট, কূটনীতি, বাণিজ্যিক স্বার্থ ইত্যাদি রয়েছে তার সব খবরাখবর খুব একটা রাখেন না, জানেনও না। ফলে গণমাধ্যমে যখন দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যক্তিরা টিকা নিয়ে মনগড়া কথা বলতে থাকেন, তখন কজনইবা বুঝতে পারেন যে, এর পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করছে।
বাস্তবেই যেহেতু এই টিকাটি ভারতের সিরাম ইস্টিটিউট হয়ে আসার কথা, তাই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সকল অপশক্তি একযুগে তারস্বরে চিৎকার চ্যাঁচামেছচ শুরু করে দেয়। এটি যদি চীন, আমেরিকা, পাকিস্তান বা তাদের পছন্দের দেশ হয়ে আসত, তাহলে তাদের মুখে কি কোনো শব্দ উচ্চারিত হতো? কিন্তু যেহেতু এই টিকাটি ভারত হয়ে এসেছে তাই সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতির মাঠটি উত্তপ্ত করার সুযোগ হিসেবেই বিএনপি-জামায়াত এবং তার সহযোগী মিত্ররা নেয়ার চেষ্টা করেছিল।
বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে কদিন পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভারতবিরোধিতার সকল বিষ ঢেলে একটি গোষ্ঠী টিকাকরণের বিরুদ্ধে মানুষকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল, সরকার যখন টিকা প্রদান শুরু করবে তখন মানুষ যেন এটি গ্রহণ না করে। তাহলে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ভারতের সরকার যখন বাংলাদেশকে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বিশ লাখ টিকা তাদের খরচে ঢাকায় অগ্রীম প্রেরণ করে, তখন সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রশ্ন তোলা হচ্ছিল ভারত বাংলাদেশকে এই টিকা দিয়ে আগেই গিনিপিগ বানাতে চাচ্ছে নাকি? বিশ লাখ টিকা আসার পর ভারত কত লক্ষ নিন্দা বাক্য বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে পেয়েছিল তা সকলেই তখন কমবেশি দেখেছেন।
বলে রাখা ভালো টিকাপ্রাপ্তির এই উদ্যোগটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ওষুধ বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ঘটেছিল। যেহেতু একসঙ্গে পৃথিবীর সাড়ে সাত শ’ কোটি মানুষের টিকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তাই অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষে উদ্ভাবিত নতুন এই টিকা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের তাড়াহুড়া, বাণিজ্যিক লাভালাভ এবং সরবরাহ প্রদানের বহুমাত্রিক অভাব ও সংকট তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ছিল- যার অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। মানুষের এই না জানা বা কম জানার বিষয়টিকে পুঁজি করেই বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী নানা ধরনের মনগড়া তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি প্রচার প্রচারণার অপরাজনীতি বলা হয়। রাজনীতিতে এই গোষ্ঠীর অবস্থান মোটেও ছোট নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরাই অনেক বেশি দৃশ্যমান। এই অপরাজনীতির জন্য কষ্ট করতে হয় না। টাকারও অভাব হয় না। কর্মী-সমর্থকও পেতে সমস্যা নেই। এতে কোনো দায়দায়িত্ব নেই, ত্যাগ স্বীকারও করতে হয় না, জ্ঞানবুদ্ধিরও চর্চা করতে হয় না, মহৎ কোনো আদর্শের ধারও ধারতে হয় না। করোনা-সংক্রমণের পর দেশে চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করা, অবকাঠামোগত সুযোগসুবিধা সৃষ্টি করা, মৃত্যুর ঝুঁকি উপেক্ষা করে মানুষকে চিকিৎসা, খাদ্য, কাজকর্ম এবং টিকার মতো প্রতিষেধক বিদেশ থেকে আনার মতো বিষয়গুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা যাকে তাকে দিয়ে হয় না। সেটি অনেক কঠিন কাজ ছিল। গত একবছর সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং করোনার-সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি সারাবিশ্বকে কীভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে তা আমরা জানি। সেই পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ অনেক দেশের চাইতে অর্থনৈতিকভাবে যেমন ভালো আছে, করোনা-সংক্রমণ প্রতিরোধেও অনেকের চাইতে বেশ উপরে আছে। এসব অর্জন গলাবাজি দিয়ে হয়নি, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় মনের মাধুরী মিশিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। যারা দায়িত্বহীন তারাই গলাবাজি এবং অপপ্রচারের সোজা রাস্তায় নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারেন। সেটিই দেখা গেছে বাংলাদেশে। তার বিপরীতে এই প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদেরকে রক্ষা করা, চিকিৎসা নেয়া-দেয়া, মানুষের জীবন ও জীবিকাকে রক্ষা করা, দেশের উৎপাদন টিকিয়ে রাখা, আয়-উন্নতি ধরে রাখা এবং করোনা ভাইরাস থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো একের পর এক যথাযথভাবে করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার সে কাজটি মোটামুটি ভালোভাবেই করেছে। টিকা আনার ব্যাপারেও সরকার সফল হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত অস্ট্রাজেনিকা টিকাটি ভারতের সিরাম প্রতিষ্ঠান স্থানীয় নির্ধারিত এজেন্ট হিসেবেই উৎপাদন করার অধিকার লাভ করেছে। সিরাম প্রতিষ্ঠানের ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে বাংলাদেশের বেক্সিমকো কোম্পানি আগে থেকেই যুক্ত। বিশ্বে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো উৎপাদন সরবরাহ এবং ব্যবসা এই প্রক্রিয়ায় চলে আসছে। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অস্ট্রাজেনিকা টিকাটি সরাসরি ইংল্যান্ড থেকে ক্রয় করার কোনো সুযোগই ছিল না। আবার কোম্পানির বৈধ সরবরাহকারী ছাড়া অন্য কোনো উপায়েও এটি লাভ করা সম্ভব নয়। সুতরাং, আমাদের টিকালাভের একমাত্র পথ ছিল প্রতিটি টিকার জন্য কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর সাহায্য নেয়া। সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে অস্ট্রাজেনিকার টিকাটি ভারতের সিরাম থেকে পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তাদের এজেন্ট বেক্সিমকোর মাধ্যমে চুক্তি করা। সে কাজটি বেক্সিমকো বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে টিকার সংকটের বিবেচনা করে বেশ আগে থেকেই টিকালাভের উদ্যোগ নিতে থাকে। সরকারও বেক্সিমকোকে উৎসাহ প্রদান করতে থাকে। বেক্সিমকো সিরাম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তিন কোটি টিকা লাভের চুক্তি করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকারপ্রধানদের সম্মতি ও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। না-হলে বাংলাদেশ এত বেশি সংখ্যক টিকা এত সহজে লাভ করতে পারতো না। বলা হয়েছে, ভারত কিনেছে ২ ডলার দিয়ে বাংলাদেশকে কেন ৫ ডলার করে দিতে হয়েছে? এটি একটি ভুল তথ্য। প্রতি ডোজের দাম ২ ডলার করে জনপ্রতি ২ ডোজ তথা ৪ ডলার টিকার মূল্য, ১ ডলার বেক্সিমকো কর্তৃক পুনা থেকে ঢাকায় আনা এবং সংরক্ষণ ও জেলাগুলোতে সরবরাহসহ যাবতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রদান করতে হচ্ছে। এখানে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলেও বেক্সিমকোকেই তা পূরণ করে দেওয়ার বিধান রয়েছে। সুতরাং, একটি সরবরাহকারী কোম্পানি হিসেবে বেক্সিমকো ১ ডলার পাওয়ার মধ্যে বাংলাদেশি কত টাকা শেষ পর্যন্ত লাভ করতে পারবে সেটি তারাই ভালো বলতে পারবে। সুতরাং, ভারত ২ ডলার কিনেছে আমরা ৫ ডলারে কিনেছি এই দাবিটি মোটেও ঠিক নয়। তাছাড়া এই টিকাটি ভারতেরও টিকা নয়। এটি অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত অস্ট্রাজেনিকা টিকা। সুতরাং তথ্য উপাত্তগুলো সঠিকভাবে জেনে কথা বললে সাধারণ মানুষের সন্দেহ থাকে না। কিন্তু অপরাজনীতি যারা করেন তারা নানা ধরনের অপপ্রচারেই নিজেরা যেমন বুঁদ হয়ে থাকেন, জনগণকেও বিভ্রান্ত করতে পছন্দ করেন। তবে বাংলাদেশ নিয়ম অনুযায়ী টিকার প্রথম চালান পেয়েছে, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি কুর্মিটোলা হাসপাতালে টিকা প্রদান আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। দুইদিনে মোট সাড়ে পাঁচ শ’র বেশি ডাক্তার, নার্স, টেকিনিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার ফ্রন্ট লাইনারগণ টিকা গ্রহণ করেছেন। টিকা গ্রহণকারীগণ গণমাধ্যমের সম্মুখে তাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনও পর্যন্ত হয়নি বেল জানিয়েছেন। এর ফলে যাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল কিংবা অপপ্রচারে বিভ্রান্তি ছিল, তারা এখন আশ্বস্ত হয়েছে এই টিকাটি গ্রহণের ব্যাপারে।
আগামী ৭ তারিখ থেকে গণহারে টিকা প্রদান শুরু হতে যাচ্ছে। টিকা গ্রহণেচ্ছু মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ভয়ভীতি অপপ্রচার দূর হচ্ছে। মানুষ করোনাপ্রতিষেধক হিসেবে অস্ট্রাজেনিকা টিকাই এখন গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরও টিকা আসবে, হয়তো বাংলাদেশের উদ্ভাবিত বঙ্গ কোভিডও একদিন এর সঙ্গে যুক্ত হবে। ততদিনে অপপ্রচারকারীদের রসদ টিকা নিয়ে থাকবে না, অন্যকিছু নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে উঠবে হয়তো।
পুনশ্চ: এরই মধ্যে সৌদি আরব ভারতের সিরাম থেকে সোয়া পাঁচ ডলারে টিকা ক্রয় করেছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। নিশ্চয় সৌদি আরবের মুসলমানদের এই টিকা গ্রহণে ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনো সমস্যা হবে না। পাকিস্তানকে চীন পাঁচ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বিনামূলে্য উপহার হিসেবে দিয়েছে। পাকিস্তানের একটি ওষুধ কোম্পানি চীনা টিকা ক্রয়ের অনুমতি লাভ করেছে। তাহলে পাঠক, ভাবুনতো আমাদের দেশে সিরাম থেকে পাওয়া টিকা নিয়ে যারা এতো হইচই, অপপ্রচার, ধর্মীয় আবেগ ও অনুভুতি নিয়ে মিথ্যাচার করলো তারা এখন কী বলবে?
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক-কলাম লেখক।